উত্তম কুমার না সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়? বাংলা সিনেমার স্বর্ণযুগের দুই ম্যাটিনি আইডলের মধ্যে চিরকাল তুলনা টেনে গিয়েছেন অনুরাগীরা। ক্যামেরার সামনে একে অপরকে সূচাগ্র মেদিনি ছেড়ে দিতে প্রস্তুত না থাকলেও উত্তম-সৌমিত্রর সম্পর্কের সমীকরণটাই ছিল আলাদা। যত না তাঁরা নিজেদের মধ্যে বিভেদ টেনেছেন, সিনেপ্রেমীরা ততোধিক লড়ে গিয়েছেন উত্তম বনাম সৌমিত্র টপিকে।
একসঙ্গে প্রায় নয়টা সিনেমায় অভিনয় করেছেন। সেই তালিকায় 'ঝিন্দের বন্দী', 'স্ত্রী', 'দেবদাস', 'যদি জানতেম', 'দর্পচূর্ণ', 'অপরিচিত'-র মতো সিনেমাগুলো রয়েছে। যে সব ছবিতে একসঙ্গে স্ক্রিনস্পেস শেয়ার করেছেন, সেগুলোর প্রতিটাতেই উত্তম-সৌমিত্র একে-অপরকে টেক্কা দিয়ে গিয়েছেন। উত্তম-অনুরাগীরা যতই বলুন- 'বাংলা সিনেমার ইতিহাসে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বহু সময় ধরে উত্তমকে ছাপিয়ে যেতে পারেননি।' তবে টালিগঞ্জ স্টুডিওপাড়ার 'দাদা' কিন্তু ভ্রাতৃপ্রতীম অনুজ 'পুলু'কে সমীহ করার পাশাপাশি একটু বুঝেও চলতেন।
একাধিকবার হয়েছে। উত্তম কুমার পরিচালক, প্রযোজকের কাছে সৌমিত্রের নাম সুপারিশ করেছেন। আবার অনেক সময় এও হয়েছে যে, সৌমিত্র মাণিকবাবুর যে ছবিতে অভিনয় করতে চেয়েছিলেন, সেখানে তিনি উত্তম কুমারকে কাস্ট করেছেন। তার জন্যে যদিও খানিক কষ্ট পেয়েছিলেন উত্তমের স্নেহের পুলু। তবে কোনও প্রতিবাদ করেননি।
টালিগঞ্জ স্টুডিওপাড়ায় উত্তম-সৌমিত্রর এরকম কত মজার ঘটনা রয়েছে। উত্তমের স্ত্রী গৌরীদেবীর সঙ্গেও দারুণ ভাল বন্ধুত্ব ছিল সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের। রসিকতা করে ডাকতেন 'টুনটুনি বৌদি' বলে। একবার নাকি আউটডোর শুটে তাসের আসরে গৌরীদেবী সৌমিত্রবাবুর কারচুপি ধরে ফেলে তাড়া করেছিলেন। সেটা 'ঝিন্দের বন্দি' ছবির শুটিং যখন উদয়পুরে চলছিল, তখনকার কথা। যা দেখে 'মহানায়ক'-সহ উপস্থিত সকলে হতবাক হয়ে যান! শেষমেশ রাস্তা দিয়ে দৌড়তে দৌড়তে গৌরীদেবীর উদ্দেশে সৌমিত্রকে চিৎকার করতে শোনা যায়- "আরে ইয়ে পাগলি হ্যায়, বাঁচাও….।"
তেমনই এক মান-অভিমানের বরফ গলার মূহূর্তে বসুশ্রী হলে সকলের সামনে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে উত্তম কুমার বলে বসলেন, "বড় ভাই আমি। পায়ে হাত দিয়ে পেন্নাম করতে পারিস না!" আরেকটা 'দেবদাস' ছবির সংলাপ রেকর্ডিংয়ের ঘটনা। উত্তমের লম্বা-চওড়া ডায়লগ। বারবার একটা শব্দে হোঁচট খাচ্ছেন। ভালভাবে উচ্চারণ হচ্ছিল না। রেকর্ডিং রুমে সেদিন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ও ছিলেন। সেইসময়ই পুলু-কে ঘর থেকে বের করে দেন উত্তম। কেন?
শোনা যায়, রেকর্ডিংয়ের মাঝে আচমকাই উত্তম কুমার বলে ওঠেন, "পুলু, তুই একটু বাইরে যা তো..!" উপস্থিত সকলেই হতবাক। হঠাৎ সৌমিত্রবাবুকে কেন বাইরে চলে যেতে বলছেন দাদা? 'অনুজ চাটুজ্যে' নিজেও অবাক। উত্তমই তখন হেসে ধন্দ মেটান। সৌমিত্রের উদ্দেশে বলেন- "আসলে তোর উচ্চারণটা খুব ভালো তো!" দাদার আবদারে সেদিন 'দেবদাস'-এর রেকর্ডিং রুম থেকে বেরিয়ে যেতে বাধ্য হন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। এরকম কত মজার ঘটনা রয়েছে উত্তম-সৌমিত্র যুগে। ব্যক্তিগত জীবনে মান-অভিমান হয়ে থাকলেও নিজেদের সম্পর্কের সমীকরণ বদলাতে দেননি ওঁরা।