বঙ্গভোটের রঙ্গমঞ্চেও কিনা শেষে লিঙ্গবৈষম্যের উসকানি! রাজনীতির ময়দানে মহিলাদের দাপিয়ে বেড়ানো-ই কি চক্ষুশূলের মূল কারণ? পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নীরিখে নারীদের চিরকালই ভোগ্যপণ্যবস্তু হিসেবে দেখা হয়। ভোট-রাজনীতিতেও সেই যৌন আবেদনের ভিত্তিতে শ্রেণীবিভাগ করা হল মহিলা প্রার্থীদের। ট্যাগিয়ে দেওয়া হল সেক্সি ননদ-বৌদি, স্টাইলিশ দিদি-বোন কিংবা কাজের মাসি বলে। একুশ শতকে দাঁড়িয়েও যেখানে কিনা নারী-পুরুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক পরিকাঠামো গঠনে ব্যস্ত, সেখানে এইধরণের মিম সমাজে মুখে কালি লেপে দেওয়া ছাড়া আর কিচ্ছু নয়। অত্যন্ত নিন্দনীয় তো বটেই! কুরুচিকরও। বলছেন শিক্ষিত নেটজনতার একাংশ। আর সেই ভাইরাল মিম নিয়েই প্রতিবাদে মুখর হলেন টলিউডের দুই বামপন্থী তারকা- শ্রীলেখা মিত্র (Sreelekha Mitra) এবং কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায় (Kamaleswar Mukherjee)।
ভাইরাল ওই মিমে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে মহিলা প্রার্থীদের। বেহালা পূর্ব ও পশ্চিম বিধানসভা কেন্দ্রে বিজেপির দুই তারকাপ্রার্থী পায়েল (Paayel Sarkar) ও শ্রাবন্তীর (Srabanti Chatterjee) ক্ষেত্রে তকমা সাঁটা হয়েছে- ‘সেক্সি ননদ-বৌদি’র। অন্যদিকে তৃণমূলের দুই তারকা-সাংসদ মিমি চক্রবর্তী (Mimi Chakraborty) ও নুসরত জাহানকে (Nusrat Jahan) আখ্যা দেওয়া হয়েছে‘স্টাইলিশ দিদি-বোন’-এর (যদিও তাঁরা একুশের বিধানসভা ভোটের প্রার্থী নন) এবং সবশেষে সংযুক্ত মোর্চা শিবিরের দুই বাম-নেত্রী প্রার্থী মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায় (Minakshi Mukherjee), দীপ্সিতা ধরকে বলা হয়েছে‘কাজের মাসি’। চেহারা দিয়ে কী অনায়াসে মহিলাদের সামাজিক অবস্থান ভাগ করে দিলেন মিম স্রষ্টাকারীরা। পেটে সুড়সুড়ি দিয়ে হাস্যরসের উদ্রেক করা এই জঘন্য মিম যে আদতে সুড়সুড়িটা লিঙ্গবৈষম্যে তথা সমাজে নারীদের অবস্থানের ক্ষেত্রে দিয়ে ফেলেছেন, তা বোধহয় আর উল্লেখ করার প্রয়োজন পড়ে না।
ওই কুরুচিকর পোস্ট শেয়ার করে শ্রীলেখা মিত্রর মন্তব্য, "ওই তথাকথিত সেক্সি ননদ-বউদি, দিদি-বোনকে ১ লক্ষ দিয়ে গুণ করে এক-একটা মীনাক্ষী বা দীপ্সিতা তৈরি করুক দেখি তবে মুরোদ বোঝা যাবে। এটাতে আবারও এদের কদর্য রুচির পরিচয় পাওয়া গেল। খেলা হবে আর রগড়ে দেব যাদের ভাষা, তাদের থেকে এছাড়া আর কী হবে?"
অন্যদিকে কমলেশ্বরের কথায়, "আমাদের সমাজের ও সংস্কৃতির পিছিয়ে যাওয়া বা প্রত্যাগতির মাত্রাটা ঠিক কিরকম - একটা ছোট্ট মিম সেটা বুঝিয়ে দিল। দুই বাম নেত্রীকে 'কাজের মাসি' বলার আসল কারণ ছিল তাঁদের অপমান করা কারণ যাঁরা মিমটি তৈরি করেছেন, তাঁরা 'কাজের মাসি' বা 'domestic help' সম্প্রদায়ের মানুষকে নিচু চোখে দেখতে অভ্যস্ত। এই অবস্থান অবশ্যই আধুনিকমনস্কতার বিপরীতে দাঁড়ানো সামন্ত (প্রভু-ভৃত্য) চিন্তার নিদর্শন। এবং বাম নেত্রীদের অপমান করার কারণ অবশ্যই রাজনৈতিক। বাম নেত্রীদের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা বাম বিরোধী নেতা-নেত্রীদের বিপাকে ফেলছে আর তার থেকে বাম নেত্রীদ্বয়ের ওপর বিরোধীদের ক্ষোভ তৈরী হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু, সমস্যা হল- 'কাজের মাসি'- এই শব্দবন্ধ বাম নেত্রীদের পক্ষেই গেল। কারণ, তাঁদের বাম আবেগ, মতাদর্শ ও দর্শনের শিক্ষায় 'কাজের মাসি' হওয়াকে গর্বের চোখে দেখেন। সংগঠন বিস্তারে 'কাজের মাসি'দেরই পাশে চান। তাঁদের লাল সেলাম। যাঁরা দুই মহিলাকে 'কাজের মাসি' আখ্যা দিলেন- তাঁরা মুখে গরিব মানুষের পাশে থাকার কথা বললেও, আদতে গরিব মানুষকে 'নিম্ন সম্প্রদায়ের চাকর' হিসেবেই দেখেন- তাও প্রমাণিত হল। এই সস্তা মিমের স্রষ্টাদের গরিব মানুষ অচিরেই ছুঁড়ে ফেলে দেবেন।"
এখানেই থামেননি টলিউড পরিচালক। শুধু বামনেত্রীদের হয়েই নয়, প্রতিবাদ করলেন বিরোধী শিবিরের চার তারকা নেত্রী মিমি, নুসরত, শ্রাবন্তী-পায়েলদের নিয়েও। বললেন, "কিন্তু, তার চাইতেও যা চোখে পড়ার মতো ঘৃণ্য 'শব্দবন্ধ' - তা হল, দুই ডানপন্থী দলের ৪ প্রার্থীর (যাঁরা আমার মতের বিরোধী হলেও কর্মসূত্রে আমার কাছের লোক) ব্যাপারে 'সেক্সি ননদ বৌদি' বা 'স্টাইলিশ বোন'- কথাগুলো বলা। এঁরা অভিনেতা এবং জনপ্রিয় হয়েছেন নিজেদের ক্ষমতায়। তাঁদের অধিকার আছে যে কোনো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়ার। তাঁরা সাহস করে সেই ভূমিকা নিয়েছেন এই পুরুষ-শাসিত সমাজে। যেখানে নারী স্বাধীনভাবে কাজ করতে গেলেই তাঁকে বিভিন্ন কটু বিশেষণে ভূষিত হতে হয়। বেশ করেছেন- রাজনীতি করছেন। তাঁরা যে দলেরই পক্ষেই থাকুন না কেন- তাঁরা রাজনৈতিক সংগ্রামে আছেন- রাজনৈতিক কর্মী। তাঁদের ঘরের গন্ডির ভেতরে আটকে রেখে 'ননদ বৌদি' বা 'বোন' বানানোর মধ্যেও তাঁদের ছোট করা হল। আর সবটাই করা হল বিকৃতরুচির 'male chauvinism' বা উগ্র পুরুষতন্ত্রের দৃষ্টিকোণ থেকে। এই মিমে ব্যবহৃত সবকটি শব্দবন্ধই তাই ঘৃণ্য। এই লিঙ্গবিদ্বেষ এরাজ্যের নারীরা মেনে নেবেন না।"