গ্ল্যামারের হাতছানি। ঝকঝকে, চাকচিক্য জীবনযাপনের আড়ালে লুকিয়ে থাকা অন্ধকার মনোজগত। একের পর এক রহস্যমৃত্যু। ১৫ মে পল্লবী দের ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার হয় তাঁর ফ্ল্যাট থেকে। তার দিন দশেকের মাথায় আরেক মডেল-অভিনেত্রী বিদিশা দে মজুমদারের অস্বাভাবিক মৃত্যু। ২৪ ঘণ্টা পেরতে না পেরতেই আরও এক অভিনেত্রী মঞ্জুষা নিয়োগীর একই পরিণতি। পল্লবী, বিদিশা, মঞ্জুষাদের মতো তরতাজা প্রাণ কেন অকালেই নিজেকে শেষ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে? ভাবিয়ে তুলছে সমাজকে। কলম ধরলেন শ্রীলেখা মিত্র।
'Suicidal thought', আত্মহননের চিন্তা প্রত্যেকের জীবনে কোনও না কোনও সময়ে হলেও আসে। সেটার পরিসর বড়ও হতে পারে কিংবা ছোট। জীবন তো কখনও একটা খাতে বয়ে চলে না। চড়াই-উতরাই থাকবেই। এটার নামই জীবন। যদি খারাপ অভিজ্ঞতার সম্মনুখীন না হওয়া যায়, তাহলে ভালর মূল্যায়ণ করা সম্ভব নয়। ভাল সময়গুলো উপভোগ করতে পারবে না। বিশ্বে এমন একটা মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর যার গোড়ার দিন থেকে শেষ অবধি সবটাই দারুণ গিয়েছে। প্রথমত নিজের মজ্জায় এই বিষয়টিকে এক্কেবারে ঢুকিয়ে নেওয়া দরকার।
রাতের অন্ধকারের পর যেমন ভোরের আলো ফোটে। নতুনভাবে সূর্যোদয় হয়, আমাদের জীবনও কিন্তু সেরকমই। ভাবতে হবে, এখন যদি আমার খুব খারাপ সময় যায়, ঠিক আছে। এটা জীবনের একটা অস্থায়ী পর্যায়। এই কঠিন সময়টাও কাটিয়ে উঠতে পারব। আর কিছুদিনের মধ্যেই আমার দারুণ একটা সময় আসবে।
<আরও পড়ুন: সোমবারই বাড়ি থেকে ফেরেন বিদিশা, বৃহস্পতিবারই ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার! কান্নায় ভেঙে পড়েছেন মা>
'দ্য সিক্রেট' বলে একটা বই রয়েছে। সেটার কথা মাথায় রেখেই বলব, কেউ যদি পজিটিভ চিন্তাধারণা বজায় রাখে, তাহলে এই মহাজগত কিংবা প্রকৃতি আপনা-আপনিই সেই ব্যক্তির জীবনকে ইতিবাচক খাতে বওয়াতে বাধ্য। শ্রীলেখা মিত্রও নিজের জীবনে সেই চড়াই-উতরাইয়ের সাক্ষী। সুশান্ত সিং রাজপুতের মৃত্যুর পর ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে অনেককিছু বলেছিলাম রাগের মাথায়। সেটা কিন্তু নিজেকে ভাইরাল করার জন্য নয়। মুখ খুলেছিলাম, কারণ একজন স্পর্শকাতর মানুষ হিসেবে সুশান্তের মৃত্যু আমাকে নাড়া দিয়েছিল।
"প্রতিটা ইউনিটে এক সপ্তাহ অন্তর অন্তর শিল্পী-কলাকুশলীদের কাউন্সেলিং করানো হোক.."
একটা সময়ে যখন, ব্যক্তিগত জীবনে, কেরিয়ারে খুব চাপানোতর চলছিল, আমারও কয়েক মুহূর্তের জন্য আত্মহননের কথা মাথায় এসেছিল। কিন্তু যেহেতু আমি একজন পজিটিভ মানুষ, সেটাকে কাটিয়ে উঠেছিলাম। ভাবলাম, আমার তো মেয়ে রয়েছে। ও কী বলবে বড় হয়ে? ওর জীবন তো নষ্ট করাতে পারি না আমি। বাবা-মা খুব খুব বকেছিলেন। যাঁরা আমাকে পৃথিবীতে এনেছে, তাঁদের আমি এত কষ্ট দেব কী করে? ওঁরা আমাকে কত যত্ন করে মানুষ করেছেন। আমার ভাল দেখলে খুশি হন, আমার দুঃখে দুঃখ পান। আমি কেন স্বার্থপরের মতো কাজ করব? নিজেই নিজের মূল্যায়ণ করে পিঠ চাপড়ে বললাম, এই খারাপ সময়টাও তো একটা জীবনের একটা পর্ব। ঠিক যেন স্কুলের একটা বিষয়। এই কঠিন সময়টা আমাকে কী শেখালো? এই শেখাটাকেই নিজের জীবনে কাজে লাগাতে হবে।
<আরও পড়ুন: পল্লবী কাণ্ডের পর মা-কে চিন্তা করতে বারণ করেন বিদিশা, তার পরেও মেয়ের ‘রহস্যমৃত্যু’>
মানুষ ভুল করে, ঠেকে-ঠকে শেখে। জীবনের মতো বড় সুন্দর জিনিস আর কিচ্ছু নেই। সুতরাং, গোটা জীবনটাকে বর্তমানের নেতিবাচক সময়ের প্রেক্ষিতে বিচার করা একেবারেই উচিত নয়। নিজেকেই নিজের দায়িত্ব নিতে হবে। কাটিয়ে উঠতে হবে এই খারাপ সময়। একটা মানুষ নিজেই পারে এই কঠিন সময় থেকে উতরাতে। মাথায় রাখতে হবে, এই খারাপ সময় দীর্ঘদিন চলতে পারে না। পৃথিবীতে কত জায়গা আছে দেখার, খাবার আছে খাওয়ার, কত সম্পর্ক আছে। ভালবাসা মানে একটা ব্যক্তিকে ভালবেসে ওঠা নয়। আমার প্রেম জীবনের প্রতি প্রেম। গাছের সঙ্গে কথা বলো, পাখির সঙ্গে কথা বলো, আকাশের দিকে তাকিয়ে হাসো, যে আজকে কী সুন্দর একটা দিন দেখতে পাচ্ছি। রাস্তায় অসহায় মানুষদের সাহায্য করো। ওদের মুখের হাসি দেখেই আনন্দ পাবে। পথসারমেয়দের খাওয়াও। ওদের ল্যাজ নাড়া দেখেও তো আনন্দ পাওয়া যায়।
আরেকটা কথা বলব, সোশ্যাল মিডিয়া থেকে দূরে থাকো। ট্রোলাররা যারা ট্রোল করে, নেগেটিভ কথা বলে, তারা নিজেরা ভালো নেই বলেই অন্যের সমালোচনা করে। নিজেরা ব্যক্তিগতজীবনে অনেক সমস্যায় জর্জরিত, তাই সোশ্যাল মিডিয়ায় কারও খুশির মূহূর্ত দেখে হয়তো কটু কথা বলে। যে মানুষটা পজিটিভ চিন্তাভাবনা করেন, তারা অন্যের সম্পর্কে খারাপ কথা বলেন না। সে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে, কিন্তু অন্যের সমালোচনা করবে না। নেটদুনিয়ায় মন্তব্য শুনে কষ্ট পাওয়ার কিছু নেই। ব্র্যাড পিট, জেনিফার লোপেজ, দীপিকা-প্রিয়াঙ্কারাও তো ট্রোলড হয়। মনে রাখতে হবে, সমাজ তোমাকে খাওয়াবে না, পড়াবে না কিংবা অসুস্থ হলে ওষুধ বাড়িয়ে দিয়ে যাবে না। অতঃপর সোশ্যাল মিডিয়ায় কে কী বলল? তা নিয়ে মাথাব্যথার কোনও দরকার নেই। নিজের জন্য বাঁচো। মনের স্বাস্থ্যের খেলায় রাখো। যারা পালাতে চায়, তারাই আত্মহননের পথ বেছে নেয়।
আমার অবাক লাগে যে, মানুষ সুইসাইডের খবরেও হা-হা রিয়েক্ট করে। শেষ একটাই কথা বলব, নিজেই নিজের Boss হও। প্রতিটা ইউনিটে এক সপ্তাহ অন্তর অন্তর শিল্পী-কলাকুশলীদের কাউন্সেলিং করানো হোক। কী হল? কেন হল? কোন টানাপোড়েনের জেরে এমন কাজ করল? বিচারসভা না বসিয়ে একে-অপরের খেয়াল রাখা উচিত সবার।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন