স্টার জলসা-র নতুন ধারাবাহিক 'মোহর' দিয়েই আবারও টেলিপর্দায় ফিরলেন জনপ্রিয় টেলি-নায়ক প্রতীক সেন। 'খোকাবাবু' ধারাবাহিক শেষ হওয়ার পর ছোটপর্দা থেকে অনেকটা লম্বা বিরতি নিয়েছিলেন তিনি। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি বাংলা ছবি করেছেন। এই প্রত্যাবর্তনের সূত্র ধরেই ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা-র সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় উঠে এল তাঁর পারিবারিক ঐতিহ্যের কথা। পরিচালক বিজলীবরণ সেনের নাতি তিনি। বাংলা ভাষার প্রথম ছবি যা আন্তর্জাতিক মঞ্চে প্রদর্শিত হয়, সেই 'সীতা'-র পরিচালক দেবকী কুমার বসু ও ১৯৬৬ সালের ছবি 'সুভাষচন্দ্র'-অভিনেতা অমর দত্তের উত্তরসূরিও। নারী-পুরুষের সমানাধিকার থেকে বাংলা ছবির জগতের সাম্প্রতিক ক্রাইসিস-- সবকিছু নিয়েই আলোচনা করলেন অভিনেতা।
তোমার নতুন ধারাবাহিকের সারমর্ম তো অপ্রেশন থেকে বেরিয়ে মেয়েদের আত্মপ্রতিষ্ঠা। এই প্রসঙ্গেই তোমার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ নারীদের কথা একটু শুনতে চাই। তার মধ্যে অবশ্যই তোমার মায়ের নামটাই আসবে প্রথমে...
হ্যাঁ নিশ্চয়ই। একজন নারীই বলে দেয় তার সন্তানকে যে তার বাবা কে, তার পরিবার কে। মায়ের সঙ্গে সন্তানের প্রথম বন্ধুত্ব হয়, তার শরীরের অংশ তো... মা হচ্ছে পরম বন্ধু। আমার সঙ্গে মায়ের সব কথা হয়। আমি মরোজড থাকলে মায়ের সঙ্গে কথা বলি, খুব হ্যাপি থাকলে কথা বলি। মা হল সেই নারী, যে মাঝরাতে ফিরলেও জিজ্ঞাসা করে... বাবু খেয়েছিস? আর স্ত্রী থাকলে সে তো অর্ধাঙ্গিনী হয়। একজন পুরুষকে তো মাথা নত করতেই হয়, প্রথম জীবনে মায়ের কাছে, পরে স্ত্রী বা বান্ধবীর কাছে। আমার জীবনে এই মুহূর্তে মাথা নত করার মতো একমাত্র মা রয়েছেন। আর বন্ধু বা বান্ধবী সেই অর্থে কেউ নেই।
আরও পড়ুন: বিয়ের পরে অভিনেত্রী হওয়া কঠিন, আমি নিজেকে লাকি মনে করি: সোনা
পেশাগত জীবনে এমন কেউ আছেন, ধরো লীনাদির মতো কেউ... যিনি তোমাকে খুবই অনুপ্রেরণা দিয়েছেন। এটা তো তোমার প্রথম কাজ লীনাদির সঙ্গে?
হ্যাঁ, লীনাদির সঙ্গে প্রথম কাজ। আসলে লীনাদি বা স্নেহাশিসদা এঁদেরকে আমি ঠিক নারী-পুরুষভেদে দেখি না। এঁদের কর্মকাণ্ডটা নারী-পুরুষের ঊর্ধ্বে। একজন মানুষের সত্যটা তার মুখের সামনে তুলে ধরতে পারেন... এঁরা সেই ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষ। তাই এঁদের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ ভেদাভেদটা আমার আসে না। 'মোহর'-এর শঙ্খদীপ চরিত্রটা নিয়ে লীনাদি আমাকে যে ব্রিফিংটা দিয়েছেন সেটা খুব সুন্দর। তুমি যেটা বলছিলে প্রশ্নে, এই সিরিয়ালটার ক্ষেত্রে, ডেফিনিটলি লীনাদিই তেমন একজন মানুষ। ভবিষ্যতে যদি কখনও আমি এই কাজটা করতে গিয়ে আটকে যাই, তখন লীনাদির কাছেই যাব।
মাঝখানে যে তুমি টেলিভিশন ছেড়ে বড়পর্দায় অনেক কাজ করলে সেটা কি বিভিন্ন ধরনের চরিত্র এক্সপ্লোর করবে বলেই?
হ্যাঁ, এটাই কারণ। এখন তো আর হিরোইজম বলে আলাদা করে কিছু নেই। আর যদি তেমন বাণিজ্যিক ছবি হয়েও থাকে তবে সেটা বাস্তব হিসেবে মানুষকে মানতে বাধ্য করার মতো গ্র্যাঞ্জার তৈরি করতে হবে। টলিউডে এই মুহূর্তে ওই অরা বা গ্র্যাঞ্জার তৈরি করাটা একটু ডিফিকাল্ট।
বাজেটের জন্য বলছ তো?
না, না বাজেটটা সমস্যা নয়। বাংলা ছবির বাজেট বেশি হতো যদি আমাদের সিনেমা হলগুলো অত বেশি হতো, সেখানে মানুষের ফুটফল যদি অত বেশি হতো। কিন্তু সেরকম ইনফ্রাস্ট্রাকচার যেহেতু নেই তাই বিরাট বড় স্কেলের ছবি এখানে হওয়া সম্ভব নয়। এখন ভালো মৌলিক গল্পের ছবি মানুষ বেশি দেখতে চাইছেন। যদি সেটা রিমেকও হয়... দেখো 'সিংহম'-ও রিমেক কিন্তু মূল ছবিতে যিনি অভিনয় করেছিলেন সূর্য, তিনি নিজেই কিন্তু টুইট করে অজয় দেবগণকে বলেছিলেন যে 'ইউ আর বেটার দ্যান মি'। তাই যদি রিমেক করতেই হয়, তাহলে ওর থেকে বেটার করতে হবে, অ্যাভারেজ থাকলে চলবে না... কিন্তু টিভি চিরকাল ছিল। বিগত প্রায় ৪০ বছর ধরে মানুষ টিভি দেখছেন। আর নিজের নিজের পেশা সামলে সকলের পক্ষে সিনেমাহলে গিয়ে সিনেমা দেখার সময় হয় না এবং বাজেটও সবার থাকে না। শুধু কলকাতা দিয়ে তো পশ্চিমবঙ্গ নয়। এই রাজ্যের সাড়ে দশ কোটি মানুষের মধ্যে এমন বহু মানুষ রয়েছেন যাঁরা মাল্টিপ্লেক্স সম্পর্কে অবগতই নন। সেই জায়গা থেকে, টিভিটা তাদের কাছে অনেক বেশি আপন। চালালেই তারা দেখতে পায়। অনেক বেশি সুবিধাজনক। অনেক রকমের শো। যার যেটা ভালো লাগে সে সেটা দেখে। সেই জায়গা থেকে এই মিডিয়ামটা খুব গুরুত্বপূর্ণ।
তোমার অভিনেতা হয়ে ওঠার জার্নিটা যদি আরও একবার শেয়ার করো।
অভিনেতা হব বলে কোনওদিন কোনও স্বপ্ন ছিল। এখানে ঘটনাচক্রে চলে আসা। আমি আগে সাউথ ইস্টার্ন রেলওয়েতে চাকরি করতাম। বক্সিং করেছি বহু বছর। স্টেট লেভেলে ৩ বার চ্যাম্পিয়ন হয়েছি হেভিওয়েট ক্যাটেগরিতে। কিন্তু কোনও কারণে আমার রোজকার জীবনটা ঠিক মানিয়ে নিতে পারছিলাম না। তাই মা-কে এসে বলেছিলাম যে মা আমি আর কী করতে পারি। মা বলল ফিল্ম করো... এটাই একটা ভীষণ বড় সাপোর্ট। যেটা তুমি আগে বলছিলে। দুশো-আড়াইশো বছর পরাধীন থাকার মানসিকতার যে প্রেশার, সেটা সত্তর বছরে কভার করা সম্ভব না। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে একজন মা তাঁর সন্তানকে বলছেন, যাও তুমি ছবি করো। এটা যে কত বড় সাপোর্ট, কত বড় অনুপ্রেরণা একজন মানুষের কাছে, সেটা আমি প্রকাশ করতে পারব না। তার পরে অনেক স্ট্রাগল হয়। প্রথমে হরদার ছবি করি, তার পর বাপ্পাদিত্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবি করেছি, 'সোহরা ব্রিজ'। ওই ছবিটা ২০১৫ সালে ইন্ডিয়ান প্যানোরামাও পেয়েছিল। এছাড়া কিছু কমার্শিয়াল সিনেমাও করেছি। রিসেন্টলি 'অতিথি' করলাম, তার আগে' চল কুন্তল' করেছি। 'অতিথি' খুবই ভালো ব্যবসা করেছে। টানা ৭৯ দিন হাউসফুল ছিল। আবার এখন ধারাবাহিকে এলাম। আর আমার ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ডে তো ফিল্মটা ছিলই...
আচ্ছা, আমাদের একটু বলো সেই বিষয়ে...
আমার দাদু হচ্ছেন বিজলীবরণ সেন। পাহাড়ি সান্যাল, ছায়া দেবী-কে নিয়ে ছবি করেছিলেন-- মানিক (১৯৬১)। সুচিত্রা সেন, বসন্ত চৌধুরীদের নিয়ে অনেক কাজ করেছেন। আর আমার জাঠতুতো দাদু হলেন দেবকী কুমার বসু। আমার আর এক দাদু হলেন অমর দত্ত। পীযূষ বসুর সুভাষচন্দ্র ছবিতে নেতাজী-র ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। সেই ছবিরই বিখ্যাত গান ছিল 'একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি'। ১৯৬৬ সালে সেরা অভিনেতার জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলেন তিনি। তার পরের জেনারেশনটা আবার কেউ ফিল্মে যায়নি, বিজনেসে ছিল। আমি যদিও অনেক পরে জেনেছি এতকিছু। কিন্তু যা হয়... একটা টান থাকে হয়তো।
ভবিষ্যতে কি অন্য ভাষার ছবি করার কথা ভেবেছ?
হ্যাঁ, ডেফিনিটলি। আমাদের দেশে এত সুন্দর একটা মিশ্র সংস্কৃতি রয়েছে। আসলে আমরা এখনও ইন্ডিয়ান হয়ে উঠতে পারিনি তো। আমরা এখনও পঞ্জাবি, এখনও ওড়িয়া, এখনও বাঙালি-- আঞ্চলিকতাবাদে রয়েছি। তার মধ্যে থেকেই উজ্জ্বলতম ভাষা হল হিন্দি। যাকে আমরা রাষ্ট্রীয় ভাষা কখনও বলি, আবার কখনও বলি না। এই নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে মাঝেমধ্যেই বচসা চলে। হিন্দিতে কাজ করার ইচ্ছে রয়েছে। হিন্দি ধারাবাহিকে আমার অফারও ছিল কিন্তু সেই মুহূর্তে আমার এখানে কিছু কমিটমেন্ট ছিল তাই করতে পারিনি। কিন্তু ভবিষ্যতে কাজ করার ইচ্ছে তো আছেই।