Advertisment

'মানুষ ভাল নেই, প্রকৃতি ভাল আছে', রইল দুই পরিচালকের দু'টি ছোট ছবি

মুক্তি পেল লকডাউনে তৈরি দুটি ছোট ছবি 'স্ট্রিপড' ও 'মাইগ্রেটরি'। দুটি ছবিতেই বর্তমান সময়, সভ্যতার সংকট, মানুষের সংকট ধরা পড়েছে দুটি স্বতন্ত্র ভঙ্গিমায়।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Two important short films on COVID-19 and lockdown by 2 Bengali directors Amitabha Chaterji and Tathagata Mukherjee

অমিতাভ চট্টোপাধ্যায় (বাঁদিকে) ও তথাগত মুখোপাধ্যায় (ডানদিকে)।

লকডাউনে বসে শিল্পীরা তাঁদের কাজ করে চলেছেন। কেউ ছবি আঁকছেন, কেউ কবিতা লিখছেন। আর দৃশ্য-মাধ্যমের শিল্পীরা তৈরি করছেন ছবি। দুই বাঙালি পরিচালক তথাগত মুখোপাধ্যায় ও অমিতাভ চট্টোপাধ্যায় সম্প্রতি তৈরি করেছেন সাম্প্রতিক সংকট নিয়ে দুটি ছবি যা খুব অল্প কথায় বা কোনও কথা ছাড়াই এই সময়কে ব্যাখ্যা করে, দর্শককে সেই দর্শনে পৌঁছে দিতে চেষ্টা করে যা লকডাউনের নিত্যনৈমিত্তিক সমস্যা সমাধানে মানুষের 'মন' এড়িয়ে যাচ্ছে।

Advertisment

প্রাকৃতিক বিজ্ঞান নিয়ে যাঁরা অল্পবিস্তর পড়েছেন, তাঁরা ডায়নামিক ইকুইলিব্রিয়াম বিষয়টি জানেন। যাঁরা পড়েননি তাঁদের কাছেও খুব দুর্বোধ্য হবে না যদি বলা হয় যে প্রকৃতিতে কোনও কিছুই চিরকালীন নয়। প্রকৃতি নানাভাবে ভাঙে গড়ে। একটা স্থিতাবস্থা থেকে আর একটা স্থিতাবস্থা-- এটাই হল প্রকৃতির ডায়নামিক ইকুইলিব্রিয়ামের দর্শন। প্রকৃতি সৃষ্টি করে, সেই সৃষ্টিগুলির মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়, আর সেই দ্বন্দ্বের ফলাফলই হল প্রকৃতির রূপ যা চাক্ষুষ করা যায়। পাহাড় ক্ষয়ে যায়, নদী তার খাত পরিবর্তন করে, টেকটনিক গতিবিধিতে আবার স্থলভূমি জেগে ওঠে।

আরও পড়ুন: বাঙালিরা যে বিশেষ ৩টি কারণে দেখবেন নেটফ্লিক্স-ছবি ‘এক্সট্র্যাকশন’

ঠিক এই কথাটাই আবার অন্যভাবে বলে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ। একটা সৃষ্টির মধ্যেই সেই সৃষ্টির ধ্বংসের বীজ তৈরি হতে থাকে-- থিসিস ও অ্যান্টিথিসিসের মধ্যে পার্থক্য তৈরি করে দ্বন্দ্ব অর্থাৎ কনফ্লিক্ট। সেখান থেকে জন্ম নেয় সিন্থেসিস। এই সিন্থেসিস ক্রমেই একটা নতুন প্রতিষ্ঠান বা নতুন 'থিসিস' হয়ে ওঠে। আবার সেই প্রতিষ্ঠানের মধ্যেই জন্ম নেয় প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতা (অ্যান্টিথিসিস)। এভাবেই একটা চক্রাকার আবর্তনে চলে পৃথিবী। মানুষ প্রকৃতির সৃষ্টি, মানবসভ্যতা নয়। কিন্তু মানবসভ্যতা প্রকৃতি ও বস্তুর এই অমোঘ চক্র থেকে কোনওদিন বেরোতে পারেনি। অর্থনীতি থেকে সম্পর্ক সবকিছুই চক্রাকারে আবর্তিত হতে বাধ্য। তাই যা ঘটছে তা কিছুটা প্রকৃতির প্রতিশোধ আবার কিছুটা দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক বা প্রাকৃতিক অমোঘ পরিণতি।

এই বিষয়গুলি নিয়েই নাড়াচাড়া করেছেন তথাগত এবং অমিতাভ, লকডাউনে তৈরি তাঁদের ছোট ছবি 'স্ট্রিপড' ও 'মাইগ্রেটরি'-তে। দুই পরিচালকের প্রকাশভঙ্গিমা আলাদা। একজন তাঁর ছবিকে রেখেছেন সংলাপহীন। শুধু ছবির শেষে রয়েছে রিলকে-র একটি কবিতার আবৃত্তি। আর অন্যজন তাঁর ছবিতে দুই চরিত্রের কথোপকথনকে রেখেছেন প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্যানভাসে। তথাগত তাঁর ছবিতে ব্যবহার করেছেন তাঁর কিছু স্টক ফুটেজ যা বিভিন্ন বিদেশযাত্রায় সংগৃহীত। অমিতাভর ছবিতে ব্যবহৃত ভিস্যুয়ালগুলি সবটাই এই সময়ে শুট করা। দু'টি ছবির মেজাজ সম্পূর্ণ আলাদা কিন্তু দুটি ছবিই একসূত্রে বাঁধা এই সংকটের বিশ্লেষণের প্রচেষ্টায়।

ঠিক কীভাবে মারণ রোগ ছড়িয়ে পড়ল সারা পৃথিবীতে তার কারণগুলি বিতর্কিত। কোনও একটি এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষিত নয়। কিন্তু মানুষ গৃহবন্দি থাকার ফলে, মানবসভ্যতার চাকা কিছুটা হলেও শ্লথগতিতে চলার ফলে, প্রকৃতি কিন্তু প্রাণভরে শ্বাস নিচ্ছে সারা পৃথিবীতেই। অনেকে এই অতিমারীর শুরুতে ম্যালথাসের সেই কুখ্যাত তত্ত্বের কথা মনে করিয়েছেন যেখানে বলা হয় যে অতিমারী, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইত্যাদি হল প্রকৃতির নিজস্ব কায়দায় জনসংখ্যার নিয়ন্ত্রণ।

ম্যালথাসকে সমালোচনা করা হয়েছিল তাঁর নৈর্ব্যক্তিক এই ব্যাখ্যার জন্য। কিন্তু সত্য সব সময়েই নৈর্ব্যক্তিক, তাই আইনের দেবী চোখে কাপড় বেঁধে বার বার ভারসাম্য আনার চেষ্টা করেন। প্রকৃতিও তাই। বাঘ, পাখি, মানুষ, গাছপালা সবই তার সৃষ্টি। খাদ্য শৃঙ্খলও। বসুন্ধরার এই জটিল ইকোসিস্টেম এত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র লোকাল সেলে ভর্তি, আর সেখানে মানুষের তৎপরতা এত বিচিত্র 'নয়েজ' সৃষ্টি করে যে প্রকৃতিরও মাঝে মাঝে কানে তালা লেগে যায়। হয়তো তাই প্রকৃতি ঘাড় ধরে চুপ করে থাকতে বাধ্য করে--

কোভিড-১৯ প্রকৃতির প্রতিশোধ নাকি জিওপলিটিক্সকে নতুন ছন্দে বাঁধার প্রচেষ্টায় জৈব-অস্ত্র প্রয়োগে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ, তা এখনও জানা নেই। মজার ব্যাপার হল, যদি দ্বিতীয়টি হয়, তাহলেও রাশ কিন্তু বাঁধা আছে প্রকৃতির হাতেই! শুধু রাষ্ট্রনায়কেরা ভাবলে হবে না। সাধারণ মানুষকে বুঝে নিতে হবে এই অমোঘ সত্য। তবেই হয়তো ভবিষ্যতের পৃথিবী এমন কোনও সংকট এড়িয়ে চলতে পারবে। সেই কারণেই তথাগত ও অমিতাভের এই ছোট ছবি দুটি দেখা জরুরি কারণ দুটিই এই সময়ের প্রতিবিম্ব।

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন

coronavirus Lockdown Bengali Film
Advertisment