তাঁকে ঠিক চেনা ছকে ফেলা যেত না। সেলেব্রিটি হয়েও তিনি ছিলেন ব্যতিক্রমী। ছিলেন এমন এক অভিনেতা, যাঁর ভাবনার আকাশ জুড়ে থাকত মহাশূন্যের অপার রহস্য। তাঁকে হাতছানি দিত গ্রহ, নক্ষত্র, ছায়াপথ। আর সুদূর কৈশোরে হারিয়ে ফেলা মায়ের স্মৃতি৷ সদ্যপ্রয়াত বলিউড তারকা সুশান্ত সিং রাজপুতের ইন্সটাগ্রামের পাতায় চোখ রাখলে উঠে আসছে এমন ছবিই। মাত্র ৩৪ বছরে চলে যাওয়া সুশান্তের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তাঁর 'ব্যতিক্রমী' চরিত্রের কথাই বলছেন বলিউডের বিশিষ্টরা।
চলতি মাসের তিন তারিখে ইন্সটাগ্রামে মায়ের সঙ্গে নিজের ছবি পোস্ট করেছিলেন সুশান্ত। সেপিয়া টোনের ছবিটি এখন নেট দুনিয়ায় ভাইরাল। স্বাভাবিক। তাঁর ইন্সটাগ্রাম প্রোফাইল তো ঠিক অন্য তারকাদের মতো নয়। সেখানে থাকত চাঁদ, তারা, মহাকাশ নিয়ে অসংখ্য পোস্ট। থাকত মহাশূন্যের দিকে চেয়ে থাকা টেলিস্কোপের উল্লেখ। গতকাল মৃত্যুসংবাদ পাওয়ার পর বেড়ে গিয়েছে সুশান্তের ইন্সটাগ্রামের ফলোয়ারের সংখ্যা। চুলচেরা বিশ্লেষণ শুরু হয়েছে ইঞ্জিনিয়ারিং ছেড়ে রুপোলী পর্দায় পা রাখা অভিনেতার পছন্দ-অপছন্দ নিয়ে। এমনটাও হয়তো স্বাভাবিক।
আরও পড়ুন, সুশান্তের ‘শেষ মুহুর্তের’ ছবি পোস্ট না করার আর্জি মুম্বই পুলিশের
অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন সুশান্ত। সর্বভারতীয় এন্ট্রান্সে সপ্তম হয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে শুরু করেছিলেন। মহাকাশচারী হওয়ার স্বপ্ন সফল করতে যেতে চেয়েছিলেন নাসায়। কিন্তু ১৮ বছর বয়স থেকে বদলে গেল জীবন। ইঞ্জিনিয়ারিং ছেড়ে নিজেকে সঁপে দিলেন অভিনয়ে। নাচ শেখার পাশাপাশি অনেকগুলি নাটক এবং একটি সিরিয়ালে পার্শ্বচরিত্রেে অভিনয় করলেন। তারপর এল 'পবিত্র রিস্তা' নামে একটি টেলি-সোপে অভিনয়ের সুযোগ। বেশ জনপ্রিয় হল সুশান্তের অভিনীত 'মানব' চরিত্রটি। এরপরই এল প্রথম ব্রেক। বলিউডে পা রাখার সুযোগ। কাই পো চে (২০১৫) ছবির ঈশান সুশান্তকে তুলে দিল বলিউডের নতুন নায়ক হওয়ার স্পিডবোটে। এল বিপুল জনপ্রিয়তা। ছুটতে লাগলেন মহাকাশে পাড়ি দিতে চাওয়া যুবক, বদলে গেল জীবন।
কাই পো চে ছবিটি সম্পাদনা করেছিলেন দীপা ভাটিয়া। দীপার কথায়, "ভাল অভিনেতার একটা 'অরা' থাকে। তার উপস্থিতিই যেন গোটা দৃশ্যটাকে একার হাতে টেনে নিয়ে যায়। সুশান্তকে দেখে ঠিক তেমন অভিনেতা বলেই মনে হয়েছিল। ওর বডি ল্যাঙ্গোয়েজকে অনবদ্য বললে কম বলা হয়।" দীপা জানান, এডিট করার ফাঁকেই তিনি পরিচালককে বলেছিলেন, সুশান্তের অভিনয়ে একটা খিদে আছে। অনেক বড় অভিনেতা হওয়ার খিদে।
আরও পড়ুন, বিবেকানন্দের উপর তথ্যচিত্র বানানো স্বপ্নই রয়ে গেল সুশান্তের
এরপর কেবলই সাফল্য। 'শুদ্ধ দেশি রোম্যান্স' ছবিতে ছোট শহরের ছেলে রঘুর চরিত্রে অভিনয় করার পর ২০১৫ সালে বাঙালী গোয়েন্দা ব্যোমকেশ ব্রক্সীর ভূমিকায়। তারপর ২০১৬ সালে বক্সঅফিস কাঁপানো এম এস ধোনির বায়োপিক 'দ্য আনটোল্ড স্টোরি'তে ধোনির চরিত্রে। সুশান্তের রথ সাফল্যের সোনালী রাস্তা ধরে এগিয়েছে তরতরিয়ে। নিজের বায়োপিক দেখে ধোনি বলেছিলেন, সুশান্তের হেলিকপ্টার শট যে এত নিখুঁত হবে, তিনি ভাবতে পারেননি।
ব্যোমকেশের পরিচালক দিবাকর বন্দ্যোপাধ্যায় এখনও বিহ্বল। বলছিলেন, "আমি কথা বলার জায়গায় নেই। সুশান্ত কোনও পারিবারিক কানেকশনের জোরে বলিউডে আসেনি। ওর উত্থানের নেপথ্যে কোনও নেপোটিজম ছিল না। বলিউডের কোনও শিবিরের সঙ্গে ও ঘনিষ্ঠ হয়নি। কেবল অভিনয়ের জোরেই সুশান্ত সফল হয়েছিল। ওর আশ্চর্য ইনোসেন্স এবং জেদী, মেধাবী অভিনয় দেখেই আমি ওকে ব্যোমকেশের চরিত্র অফার করেছিলেন।" দিবাকর জানান, গত দেড় বছর সুশান্তের সঙ্গে প্রায় কোনও কথা হয়নি তাঁর। এই আক্ষেপ হয়তো আজীবন রয়ে যাবে।
আরও পড়ুন, ”মা স্মৃতিগুলো চোখের জলে ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে”
২০১৯ সালে রিলিজ করেছিল 'ছিঁচোড়ে'। পরিচালক নীতিশ তিওয়ারি। এখানে সুশান্ত একজন মধ্যবয়সী বাবা, যে আপ্রাণ চেষ্টা করছে আইআইটিতে সুযোগ না পাওয়া আত্মহত্যাপ্রবণ সন্তানকে জীবনে ফিরিয়ে আনতে। নীতিশের কথায়, "টিভি দেখে জানলাম। কী বলব, কী করব বুঝতে পারছি না। আমি চূড়ান্ত শকড।"
প্রায় এক দশক আগে, ২০১০-১১ সালে সুশান্ত একটি সর্বভারতীয় ডান্স রিয়েলিটি শো-তে অংশ নিয়েছিলেন। ঝলক দিখলা যা নামের ওই শো-এর অন্যতম বিচারক ছিলেন রোমিও ডি'সুজা। মৃত্যুসংবাদ পেয়ে দৃশ্যত মূহ্যমান রোমিও কেবল বললেন, "আশ্চর্য প্রতিভা। এভাবে অকালে চলে যাওয়া মেনে নিতে পারছি না। আসলে খ্যাতির আড়ালে অনেক যন্ত্রণাও তো থাকে। সেসবের খবর ক'জন রাখি আমরা!"