লকডাউনে বসে বেশ কিছু ছোট ছবি তৈরি হয়েছে বিগত দু'মাসে। সম্প্রতি তেমনই একটি কাজ স্বর্ণেন্দু সমাদ্দার পরিচালিত 'মৃন্ময়ী' মুক্তি পেল ইউটিউবে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোট গল্প 'সমাপ্তি' অবলম্বনে তৈরি হয়েছে এই শর্ট ফিল্ম যেখানে অভিনয় করেছেন 'ত্রিনয়নী'-নায়িকা শ্রুতি দাস। কেন 'সমাপ্তি'-কে বেছে নিলেন পরিচালক আর কেমন ছিল কাজের অভিজ্ঞতা, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা-কে জানালেন শ্রুতি ও স্বর্ণেন্দু।
যাঁরা গল্পটি পড়েননি, তাঁরা সত্যজিৎ রায়ের 'তিন কন্যা' ছবিটি নিশ্চয়ই দেখেছেন। যাঁরা ছবিও দেখেননি, গল্পটিও পড়েননি তাঁদের জন্য বলা যাক রবি ঠাকুরের গল্পের সারমর্ম-- গ্রামের ছেলে অপূর্ব পড়াশোনা করে শহরে। ছুটিতে বাড়ি এলে মা তাকে জোর করে বিয়ে দিতে চায়। কিন্তু মায়ের পছন্দ করা মেয়ে নয়, সারা গ্রাম দৌড়ে বেড়ানো ডানপিটে মেয়ে মিনুকেই পছন্দ তার। জোর করে বিয়ে দেওয়া হয় কিশোরী মিনুকে অপূর্বর সঙ্গে। বন্ধ হয়ে যায় প্রকৃতির বুকে মৃন্ময়ীর অবাধ দৌরাত্ম্য। সে অভিমান করে, অপূর্বর সঙ্গে শহরে যেতে চায় না। কিন্তু কিছুদিন পরেই অনুভব করতে থাকে একটা অপরিচিত শূন্যতা।
আরও পড়ুন: লকডাউন শেষে নতুন ছন্দে ‘রাসমণি-নেতাজি’, নতুন পরিকল্পনা চ্যানেলের
'সমাপ্তি' গল্পের এই অংশটি অর্থাৎ 'মৃন্ময়ী' ও অপূর্বর সাময়িক বিচ্ছেদ, মৃন্ময়ীর মধ্যে প্রেমের অনুভূতির বিকাশ, তার কিশোরী থেকে নারী হয়ে ওঠা-- এই সবকিছুকেই লকডাউন ও ডিসট্যান্সিংয়ের সময়ে ফিরে দেখতে চেয়েছেন স্বর্ণেন্দু তাঁর এই ছোট ছবিতে। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা-কে তিনি জানালেন, ''রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোট গল্প 'সমাপ্তি', অনেক আগেই পড়া। লকডাউনে বসে আরও একবার পড়ছিলাম। ওখানে একটা ছোট অংশ, অপূর্ব যখন শহরে চলে যায় বিয়ের পরে কিন্তু মৃন্ময়ী যেতে চায় না... চলে যাওয়ার পরে মৃন্ময়ীর মনে হয় যে তার ভাল লাগছে না। সে নিজেও বুঝতে পারে না যে কেন, এটা কি ভালবাসা না কি। ওই অংশটা পড়তে গিয়ে মনে হচ্ছিল লকডাউনে যে ভালবাসার মানুষেরা পরস্পরকে ছেড়ে আলাদা রয়েছেন, তাদের সঙ্গে কোথাও যেন মিলে যাচ্ছে। মোবাইল ফোনে পুরোটাই শুট করা হয়েছে কেউ কারও সামনে না গিয়ে। তিনটি চরিত্রের ডায়ালগ কম রেখে, যতটা সম্ভব মুহূর্তগুলো ধরার চেষ্টা করেছি। তিনটি চরিত্রে যাঁরা অভিনয় করেছেন শ্রুতি, পলাশ ও শ্রাবন্তীদি, এরা কেউ কাউকে দেখেনি, এদের মধ্যে যাবতীয় মধ্যস্থতা করেছি আমি। প্রত্যেকেই নিজের নিজের অংশগুলি শুট করেছে। তার পর ওদের থেকে ফুটেজগুলো কালেক্ট করে একটি অ্যাপের মাধ্যমে ফোনেই এডিট করেছি। এখন দর্শকের কেমন লাগে সেই অপেক্ষায় আমরা সবাই।''
শ্রুতি ছাড়াও এই ছবিতে বাকি দুটি চরিত্রে অভিনয় করেছেন পলাশ মণ্ডল ও শ্রাবন্তী মালাকার মুখোপাধ্যায়। ছবিতে ব্যবহৃত হয়েছে 'যদি আকাশের গায়ে কান না পাতি' গানটি, গেয়েছেন অভিনেতা নীল চট্টোপাধ্যায়। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা-কে শ্রুতি জানালেন, বেশ চ্যালেঞ্জিং ছিল কাজটি তাঁর কাছে। ''প্রথমত রবি ঠাকুরের গল্প নিয়ে কাজ। তার উপর আমরা পাঁচজন অর্থাৎ স্বর্ণেন্দুদা আমি নীল পলাশদা ও শ্রাবন্তীদি-- পাঁচজন পাঁচটা জায়গায় থাকি। স্বর্ণেন্দুদা পুরোটা এডিট করেছে। আমি একা ক্যামেরা করতে পারিনি, আমাকে সাহায্য করেছে আমার দুই বন্ধু রৌনক দাস ও উদয়শঙ্কর সাহা'', জানালেন শ্রুতি, ''উদয়দার বাড়ি অর্থাৎ কাটোয়ার বিখ্যাত সাহাবাড়িতে শুট করেছি আমার অংশটা। বাকি দুজন নিজেরাই শুট করেছেন। একটু ভেরিয়েশন দরকার ছিল বলেই আমাকে রৌনক ও উদয়দার সাহায্য নিতে হয়েছে। সবার ক্ষেত্রেই কাজটা চ্যালেঞ্জিং ছিল। আমি আমার অংশটা নিজে শট ডিভিশন করেছি, সেভাবেই রৌনক শুট করেছে আমার মোবাইলে। আসলে সবটাই টিমওয়ার্কের উপর নির্ভর করে। এরকম একটা কঠিন পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে আমরা যৌথভাবে চেষ্টা করেছি।''
দেখে নিতে পারেন ছবিটি নীচের লিঙ্কে ক্লিক করে--
নিঃসন্দেহে এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে, দীর্ঘ দু'মাসের সোশাল ডিসট্যান্সিং পেরিয়ে, মৃন্ময়ীর এই বিরহ-প্রতীক্ষার বিষয়টি বহু মানুষের ক্ষেত্রেই প্রাসঙ্গিক। বহু মানুষ আচমকা লকডাউন ঘোষণায় প্রিয়জনের থেকে দূরে থেকেছেন। হয়তো কেউ চাকরি করেন কলকাতার বাইরে, লকডাউনের ফলে দু'মাস বাড়ি ফিরতে পারেননি। আবার কেউ হয়তো কয়েকদিনের কাজে বাড়ি থেকে বেশ খানিকটা দূরে, অন্য কোনও জেলায় গিয়েছিলেন, ট্রেন-বাস বন্ধ থাকায় আর ফেরা হয়নি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে। প্রেমিক-প্রেমিকা-দম্পতিদের এই দীর্ঘ দূরে থাকাই হয়তো মানুষকে সম্পর্কের মূল্য শিখিয়ে দিয়েছে নতুন করে।
রবি ঠাকুরের গল্পের এই অ্যাডাপ্টেশনে সেই উপলব্ধি ও অনুভূতিগুলিকেই তুলে ধরতে চেয়েছেন স্বর্ণেন্দু। শ্রুতি জানালেন এই কাজটি করতে গিয়ে কীভাবে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের অভিজ্ঞতাগুলি তাঁকে সাহায্য করেছে অভিনয়ে। ''লকডাউনে আমি দুর্ভাগ্যবশত আমার পার্টনারের থেকে দূরে আছি। সেটা চিত্রনাট্যেও ছিল যে-- 'দুমাস হয়ে গেছে তুমি নেই আমার কাছে'। ভালবাসার মানুষ দূরে থাকলে কী হয় বা এই রকম পরিস্থিতির শিকার হলে কী হতে পারে তার সঙ্গে রিলেট করতে পেরেছি। সেই জায়গা থেকেই চেষ্টা করেছি অভিনয় করার। চোখের জলটাও তাই আপনা থেকেই এসেছে'', বলেন শ্রুতি।