সোমবার ‘সংসার সীমান্তে’র পরপারের উদ্দেশে যাত্রা করলেন তরুণ মজুমদার। নব্বইয়ের কোঠায় বয়স হলেও তাঁর সক্রিয় মগজাস্ত্র শেষ দিন অবধি বাংলা সিনে ইন্ডাস্ট্রিকে সমৃদ্ধ করে গিয়েছে। আর তাই এমন কড়া অথচ মায়াময় শিক্ষক-অভিভাবককে হারিয়ে শোকবিহ্বল টালিগঞ্জের স্টুডিওপাড়া। ভালো নেই ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তর মন। নস্ট্যাজিয়ায় ভেসে শতাব্দী রায় মনে করলেন পুরনো সেই দিনের কথা।
ভারক্রান্ত মনে ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তর (Rituparna Sengupta) মন্তব্য, "ওঁর সঙ্গে কাজের বহু স্মৃতি রয়েছে। তরুণ মজুমদারের সঙ্গে আমার প্রথম ছবি আলো। যা বাংলা সিনেমার মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। নিঃসন্দেহে একটা ল্যান্ডমার্ক ছবি। তরুণবাবু বাংলা সিনেমার স্তম্ভ। ওঁর চাঁদের বাড়ি ছবিটিতেও অভিনয় করেছি। বাংলা সিনে ইন্ডাস্ট্রিকে সমৃদ্ধ করতে ওঁর অবদান অপরিসীম। তরুণবাবুর চলে যাওয়ার খবরে মনটা খুব অস্থির হয়ে আছে।"
স্মৃতি হাতড়ে শতাব্দী রায় (Satabdi Roy) বললেন, "তরণ মজুমদার এমন একজন মানুষ, যাঁর সঙ্গে শুধু কাজ করার অভিজ্ঞতা নয়, গল্প করার অভিজ্ঞতাও দারুণ। আমি যখন এনটিওয়ান স্টুডিওতে শুটিং করতাম, কাজের অবসরে খালি ওঁর সঙ্গে গল্প করার সুযোগ খুঁজতাম। মুখিয়ে থাকতাম, কথা বলার জন্য। তখন ওঁর অফিসও ছিল ওই স্টুডিওতেই। কী দারুণ সেন্স অফ হিউমর মানুষটার। পুরনো দিনের কত গল্প করতেন। শিক্ষকরা যেমন ছাত্রদের প্রতি কড়া ছিলেন, উনিও তেমনি আমাদের কাছে অভিভাবকের মতো ছিলেন। কোনও ভুল হলে সঙ্গে সঙ্গে ধরিয়ে দিতেন। এত মিষ্টি প্রেমের ছবি যে হতে পারে, সেটা তরুণ মজুমদার দেখিয়েছিলেন বাঙালি দর্শকককে। নবীন প্রজন্ম সেসব ছবি দেখেনি সম্ভবত।"
পরিচালক অভিজিৎ গুহ জানালেন, "তরুণদা সিনেমা বানিয়ে আগে মাণিকদাকে দেখাতেন। তারপর সত্যজিৎ রায় একদিনে চায়ের আড্ডায় সিনেমাটা নিয়ে মতামত দিতেন তরুণবাবুকে।" "বাঙালির জীবনে দুর্ভাগ্যজনক দিন। তাঁর গল্প বলার ধাঁচ আমাদের অনুপ্রাণিত করেছেন। ওঁর ছবিতে সমাজচেতনা দারুণভাবে উঠে এসেছে", বললেন কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়।
<আরও পড়ুন: বাংলা চলচ্চিত্র জগতে নক্ষত্র পতন, প্রয়াত তরুণ মজুমদার>
গৌতম ঘোষ (Goutam Ghosh) বললেন, "৪০ বছরের পরিচয়। অভিভাবক হারালাম। উনি যেটা করেছেন- শিক্ষিত বাঙালি সমাজের জন্য পরিচ্ছ্নন্ন ছবি তৈরি করে গিয়েছেন। ভিভিন্ন স্বাদের ছবি করেছেন। 'কাঁচের স্বর্গ', 'পলাতক', 'বালিকা বধূ', শেষের দিকে 'শ্রীমান পৃথ্বীরাজ' বাঙালি আপন করে নিয়েছিল ওঁর ভিন্ন স্বাদের ছবিগুলো। হলভর্তি করে দেখতে আসত বাঙালি দর্শকরা। 'সংসার সীমান্তে' আমার প্রিয়। নিউ থিয়েটারে সেট তৈরি করা হয়েছিল। ফিল্ম মেকিংয়ের বিষয়ে উনি খুব নিঁখুত ছিলেন। এমনকী সেটের প্রপসের দিকেও নজর থাকত ওঁর। ওঁর লেখা, প্ল্যানিং, সবকিছু দেখেই শিখেছি। এরকম একজন অভিভাবককে হারালাম। উনি শেষবয়স পর্যন্ত সক্রিয় ছিলেন। 'সিনেমাপাড়া দিয়ে' টালিগঞ্জ স্টুডিও পাড়াও নিয়ে এত নিঁখুত তথ্য আর কারও লেখায় উঠে আসেনি এর আগে। ভীষণ রসিক মানুষও ছিলেন। আমি মর্মাহত তরুণবাবু চলে যাওয়াতে।"
সঙ্গীত পরিচালক দেবজ্যোতি মিশ্র বললেন, তরুণদা সঙ্গে সম্প্রতি অপরাজিত স্ক্রিনিংয়ের সময় কথা হয়েছিল। আমি তরুণ মজুমদারকে খুব অল্প বয়স থেকে চিনি। তাঁর সিনেমা ও সিনেমায় ব্যবহৃত গানের সুবাদে। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর জুটি। গণদেবতার ভোর হইল.. দারুণ। পলাতক-এ মন যে আমার.. কী সব দুর্ধর্ষ গান। গানবাজনা ভীষণ ভালবাসতেন। গণনাট্যের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ওঁর সিনেমার গান সারাজীবন বিখ্যাত থাকবে। সত্যজিৎ-মৃণাল-ঋত্বিকের যুগে দাঁড়িয়ে নিজের জন্য আলাদা মাইলস্টোন তৈরি করেছিলেন তরুণ মজুমদার।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন