বঙ্কিমচন্দ্র আক্ষেপ করেছিলেন বাঙালির ইতিহাস নিয়ে। সে আক্ষেপের দিকে নজর না দিলেও আমরা বলতে পারি যে বাঙালির সিনেমা ইতিহাস একেবারেই নেই। যিনি আমাদের চলচ্চিত্র নির্মাণে প্রথম আঁচড় কেটেছিলেন সেই হীরালাল সেনের তো কোনও ছবিই পাওয়া যায় না। তেমনি অনাদিনাথ বসুরও অর্ধেক ছবি নেই। সত্যি কথা বলতে কী, ১৯৩০ সালের আগে বাংলা চলচ্চিত্রে যে আদৌ কোনও কাজ হয়েছিল, এমন কোনও প্রমাণ আমাদের হাতের সামনে নেই। সম্প্রতি অবশ্য ১৯১৯ সালে তৈরি করা ম্যাডানদের ছবি 'বিল্বমঙ্গল' উদ্ধার হয়েছে।
এসব কথা এল সদ্য প্রয়াত মৃণাল সেনের ছবির বিষয়ে ভাবার কারণে। যে মৃণাল সেনের বিষয়ে আমাদের এত আবেগ, যে চলচ্চিত্র স্রষ্টা সম্বন্ধে আমরা বলে চলেছি যে ঋত্বিক, সত্যজিতের সঙ্গে তিনি বাংলা চলচ্চিত্রকে বিশ্ব সংস্কৃতির পরিসরে বিশেষ মর্যাদার আসন দিয়েছিলেন। সেই মৃণাল সেনের একাধিক ছবি হারিয়ে গেছে।
আরও পড়ুন: মৃণাল সেন ছিলেন অ্যানার্কিস্ট: শ্যাম বেনেগাল
ঘটনাটি এমনই মর্মান্তিক যে বললে বিশ্বাস হতে চায় না। স্বয়ং মৃণাল সেন তাঁর নিজের একাধিক ছবির কপি কেনার জন্য সচেষ্ট ছিলেন। যেমন আমি বলতে পারি, সাত দশকের প্রথমদিকে তাঁর তোলা ছবিগুলো। মৃণাল সেনের তিনটি ছবি আছে যার কোনও চিহ্নই আজকে বাঙালি খুঁজে পাবে না। অথচ সেই ছবিগুলি বাঙালির মধ্যবিত্তের জীবনযাত্রার একটা আয়না। সাতের দশকের বাঙালি কীভাবে বেঁচে ছিল তা এই ছবিগুলি বলে। ছবিগুলির নাম যদি কেউ জিজ্ঞেস করেন, হয়তো নামও অনেকে জানেন না।
যেমন 'পুনশ্চ'। এই ছবিটি ১৯৬১ সালে তৈরি হয়। নায়ক-নায়িকা বেশ পরিচিত, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও কণিকা মজুমদার। আরও আশ্চর্যের কথা, এই ছবি জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাহিনীচিত্র ছিল। কিন্তু 'পুনশ্চ'-র প্রিন্ট স্বয়ং মৃণাল সেন চেষ্টা করেও খুঁজে পাননি। যে কারণে মৃণাল সেনের ছবি প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে আমরা 'রাত ভোরের' অপ্রাপ্তির কথা মেনে নিয়ে তারপরে 'নীল আকাশের নীচে' এবং সরাসরি 'আকাশ কুসুমে' চলে যাই, তার কারণ আমাদের সংরক্ষণে 'পুনশ্চ' নেই।
শুধু যে 'পুনশ্চ' নেই তা নয়, এমনকি তার পরের ছবি 'অবশেষে', যা ১৯৬৩ সালে নির্মিত, তাও নেই। সেই ছবির নায়ক-নায়িকারাও যথেষ্ট পরিচিত, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়-অসিতবরণ। সবথেকে বড় কথা, মৃণাল সেনের যিনি পারিবারিক আত্মীয়, যিনি গীতা সেনের ভাই, সেই অনুপ কুমার এই ছবিতে অভিনয় করেছিলেন। অনুপ কুমার এর পরবর্তী ছবি, ১৯৬৪ সালে তৈরি 'প্রতিনিধি'-তেও অভিনয় করেছিলেন এবং সেই ছবিরও সঙ্গীত পরিচালনা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের, সেখানেও সৌমিত্র-সাবিত্রী অভিনয় করেছিলেন। তারও কোনও চিহ্ন পাওয়া যায় না।
আরও পড়ুন: এবছর না ফেরার দেশে চলে গেলেন যাঁরা
অথচ মৃণাল সেন নিজে আমার কাছে আক্ষেপ করেছিলেন যে, "আমার খুব খারাপ লাগে মানুষের চোখর সামনে যে থাকে তাকে অনেক সময় মানুষ মনে করতে পারে না। অনুর (অনুপ কুমারের জন্য তাঁর ডাকনাম) সঙ্গে আমরা থাকতাম।" সত্যি কথা বলতে কী, গতকাল যে বাড়ি থেকে অন্ত্যেষ্টি শুরু হল, সেই মতিলাল নেহেরু রোডের মূল ভাড়াটিয়া ছিলেন অনুপ কুমার। তখন মৃণালদার আর্থিক অবস্থা ভাল ছিল না, ফলে মৃণালদা, গীতাবৌদি এবং কুণাল সেখানে থাকতেন।
কিন্তু সমস্যা হল, অনুপ কুমারের উপস্থিতি সমৃদ্ধ যে দুটি ছবি মৃণাল সেনের, সেই দুটিই অবলুপ্ত। আমার হাত ধরেই একসময় উত্তেজিত হয়ে মৃণালদা বলেছিলেন, "এক কপি 'পুনশ্চ' পেলে যেকোনও দাম দিয়ে দিতে পারতাম।" সম্ভবত একবার খবরের কাগজে বিজ্ঞাপনও দিয়েছিলেন। কিন্তু তখনকার সেলুলয়েডে তৈরি ছবির সংরক্ষণ সম্বন্ধে আমাদের তো কোনও ধারণা নেই, তাই হয় সেগুলো পুড়ে গেছে, নতুবা সেগুলোতে ফাঙ্গাস জমেছে। কোনও ডিহিউমিডিফায়ারের (dehumidifier) ব্যবস্থা নেই, কোনও তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রনের ব্যবস্থা নেই। ফলে সেগুলো গাদাগাদি হয়ে খবরের কাগজের মতো পড়ে থেকে একসময় কালের অতলে চলে গেছে, এবং বাঙালি 'পদাতিক' মৃণাল সেনকে নিয়ে নানারকম গল্পকথা ফেঁদে বসেছে।
আসলে আমাদের দুর্ভাগ্য, তাৎক্ষণিক ঘটনায় উত্তেজিত হই, কিন্তু আমরা ইতিহাসকে তার প্রাপ্য মূল্য দিই না। সেই অবহেলার অন্যতম শাস্তিপ্রাপ্ত দুর্নীত প্রতিনিধি হয়ে রইলেন মৃণাল সেন।