অতিমারীর কোপে প্রেক্ষাগৃহের দরজায় তালা ঝুললেও, এবছর একাধিক ভাল সিনেমা উপহার পেয়েছেন দর্শকরা। কোনওটা বক্স অফিসে ছক্কা হাঁকিয়েছে, আবার কোনটা ভাল কন্টেন্ট হওয়া সত্ত্বেও মুখ থুবড়ে পড়েছে বক্স অফিসে। ভাল-মন্দ মিশিয়ে করোনার কোপে তালিকা নাতিদীর্ঘ হলেও দেখে নেওয়া যাক একুশের দৌড়ে টলিউডে কারা এগিয়ে?
গোলোন্দাজ - ভারতীয় ফুটবলের জনক নগেন্দ্রপ্রসাদ সর্বাধিকারীর বায়োপিক। পরিচালনায় ধ্রুব বন্দ্যোপাধ্যায়। এই সিনেমার দৌলতেই বছর খানেক বাদে প্রযোজনা সংস্থা এসভিএফ-এর সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছেন অভিনেতা দেব। নগেন্দ্রপ্রসাদের ভূমিকায় অভিনয় করে বাজিমাত করেছেন দেব। যে ছবি এক অনন্য লড়াইয়ের গল্প বলে। গোরাদের বিরুদ্ধে ফুটবলের ময়দানে জবাব দিতে দেখা যায় বাংলার ফুটবলারদের। উল্লেখ্য, এই ছবির জন্য কম কসরত করেননি দেব। পায়ের ভাঙা আঙুল নিয়ে ফুটবল প্র্যাকটিস পর্যন্ত করেছেন। এমনকী, ফুটবল খেলার অ-আ-ক-খ যিনি জানতেন না, দিন-রাত এক করে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। বিফলে যায়নি। মুগুর ভাজা থেকে ফুটবল পায়ে ময়দানে গোল হাঁকানো, পারদর্শীতার সঙ্গে তুলে ধরেছেন অভিনেতা। বাংলা স্পোর্টস ড্রামাগুলোর মধ্যে অন্যতম সেরা। দেবের বিপরীতে ইশা সাহা। উল্লেখ্য, শ্রীকান্ত আচার্য, পদ্মনাভ দাশগুপ্তের মতো পর্দায় আনকোরা মুখগুলো পরিচালকের চমক।
টনিক - ‘টনিক’… শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা টনিক-ই ভরসা… সিনেমার এই সংলাপ আমাদের বাস্তব জীবনের সঙ্গে অক্ষরে অক্ষরে মিলে যায়। অসুখ করলেই আমরা ক্যাপসুল, সিরাপ, টনিকের দ্বারস্থ হই। আর এই ছবির গল্পের মূল চরিত্র মানে টনিক, সেও তাই। মৃতপ্রায় সম্পর্ককে চাঙ্গা করতে তার জুড়ি মেলা ভার! বৃদ্ধ দম্পতির স্বপ্নপূরণ করতে, তাদের ভগ্নপ্রায় পরিবারকে জোড়া লাগাতে ‘টনিক’-ই মুশকিল আসান। আবেগ, রোমাঞ্চ, ড্রামা-মেলোড্রামা কি নেই? আমাদের প্রত্যেকের সংসারের বাস্তব সমস্যার এক টুকরো দলিল তুলে ধরেছেন পরিচালক অভিজিৎ সেন। পরিচালকের 'তুরুপের তাস' এখানে আশিটা বসন্ত পার করা পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়। পরাণের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অভিনয় করেছেন দেব। গল্পের পরতে-পরতে কমিক এলিমেন্ট জুড়ে ‘টনিক’ মন চাঙ্গা করে। বক্স অফিসেও বাজিমাত করে ফেলেছে এই ছবি। সিনেমার গল্পই ফিল গুড ফ্যাক্টর। ফ্রেশ গল্প।
হবু চন্দ্র রাজা গবু চন্দ্র মন্ত্রী - আগের ২টো ছবিতে দেব অভিনয় করলেও এই সিনেমার প্রযোজকের ভূমিকায় রয়েছেন তিনি। ‘হবু চন্দ্র রাজা গবু চন্দ্র মন্ত্রী’। থাকেন বোম্বাগড়ে। সেই রাজা বেজায় খামখেয়ালি। তবে মন্ত্রী বেজায় কূটনৈতিক। সর্বদাই তটস্থ। আর বুদ্ধিমতী রানি কুসুম কুমারী। দক্ষিণারঞ্জন মিত্রের দুটো গল্প নিয়ে ছবির প্রেক্ষাপট। তবে ছোটদের ছবি বললে ভুল হবে, কারণ সিনে-কাহিনির দর্শন অন্য কথা বলে। অভিনয়ে শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়, অর্পিতা চট্টোপাধ্যায়, খরাজ মুখোপাধ্যায়, শুভাশীষ মুখোপাধ্যায়ের মতো তুখড় অভিনেতারা। তবে একটাই আক্ষেপ বড়পর্দায় দেখা মিলল না 'হবু-গবু'র। এবছর টলিউড ইন্ডাস্ট্রিতে যে বাজিমাত করেছেন প্রযোজক-অভিনেতা দেব, তা বলাই বাহুল্য।
অভিযাত্রিক - ঠিক যেখানে সত্যজিৎ রায়ের 'অপুর সংসার' শেষ হয়েছিল, তার পরের গল্পটাই সিনেপর্দায় তুলে ধরেছেন পরিচালক শুভ্রজিৎ মিত্র। বলা ভাল, অপুকে আরও বছর খানেক এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন তিনি। ১৯৩০-৪০ সালের প্রেক্ষাপটে সাজানো ছবির গল্প। অপুর ভূমিকায় অর্জুন চক্রবর্তী। অপুর চাকরিজীবনে ছেদ পড়েছে, নিজের সন্তানকে নিয়ে সে বেরিয়ে পড়েছে বারাণসীর উদ্দেশে। ট্রেনে দেখা হয় তাঁর শৈশবের বন্ধু লীলার সঙ্গে। সত্যজিৎ তাঁর সিনেমা থেকে লীলা-প্রসঙ্গ বাদ দিলেও শুভ্রজিৎ বিভূতিভূষণের রচনার প্রতি বিশ্বস্ত থেকেই অপু-লীলার হারিয়ে যাওয়া প্রেমকে পুনরুদ্ধারের সাহস দেখিয়েছেন। সাদা-কালো ফ্রেমে এই সিনেমার হাত ধরেই দিব্যি ডুব দেওয়া যায় নস্ট্যালজিয়ায়। অপুর নিঃসঙ্গতা, একাকীত্ব, ছেলে কাজলের সঙ্গে সম্পর্ক পারদর্শীতার সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছেন পরিচালক।
হীরালাল- অরুণ রায় একটা মাস্টার পিস তৈরি করে ফেলেছেন। খরাজ মুখোপাধ্যায়, শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়, শঙ্কর চক্রবর্তীদের মতো দক্ষ অভিনেতাদের ভীড়ে বাজিমাত করেছেন কিঞ্জন নন্দা, অর্ণ মুখোপাধ্যায়রা। বিশেষ করে হীরালাল সেনের ভূমিকায় কিঞ্জল দুর্ধর্ষ। চেহারার গড়ন যেভাবে ভেঙেছেন চরিত্রের প্রয়োজনে, তার জন্য মার্কসিটে একশোয় একশো বসাতেই হয়।
বিনিসুতোয় - কাল-পরিস্থিতি বদলানোর সঙ্গে বদলায় সম্পর্কের সমীকরণ। পরিচালক অতনু ঘোষের বিনিসুতোয় সেই কথাই বলে। মুখ্য চরিত্রে দম্পতির ভূমিকায় ঋত্বিক চক্রবর্তী, জয়া আহসানের মতো দক্ষ অভিনেতারা। দুই চরিত্রের জীবনের সমান্তরাল সমস্যা কোথাও গিয়ে যেন এক হয়ে যায়। আপাত সুখী জীবনের বাইরে হৃদয়ের শান্তি খোঁজার গল্প বলে বিনিসুতোয়।
ডিকশনারি - অসম বয়সি দাম্পত্য সম্পর্ক, বিবাহ বহির্ভূত প্রেম-ভালবাসা, সম্পর্কের জটিল ধাধা নিয়ে ব্রাত্য বসুর (Bratya Basu) ‘ডিকশনারি’। ‘অসুর’ ছবির পর আরও একবার স্বামী-স্ত্রীর চরিত্রে নুসরত জাহান (Nusrat Jahan) এবং আবীর চট্টোপাধ্যায় (Abir Chatterjee)। সাদামাটা ঘরোয়া, অসুখী গৃহবধূ স্মিতা সান্যালের ভূমিকায় নুসরত। যে কিনা মুখ ফুটে স্বামী অশোক সান্যালকে কিছুই বলতে পারে না। তবে সমবয়সী দেওর তাঁর মনের অনেক কাছের। এক ছাদের তলায় স্বামীর সঙ্গে সহাবস্থান তাঁর কাছে যেন শরশয্যার মতোই ঠেকে। অন্যদিকে শ্বশুরবাড়ির ‘ডাইনি’ অপবাদ। বৈবাহিক সম্পর্কের জটিল ধাঁধায় হারিয়ে যাওয়া স্মিতার কাছে যেন তাঁর ‘আরণ্যক সিন্ড্রোম’-এ ভোগা দেওর-ই একমাত্র আশ্রয়। ছাপোষা মধ্যবিত্ত সরকারি চাকুরে স্বামী সব জানতে পেরেও ভালবাসে স্মিতাকে। অন্তর্মুখী অশোকের পক্ষে তার অনুভূতির ব্যাখ্যা দেওয়া অসম্ভবপর। সম্পর্কের অজানা এক ‘অভিধান’ নিয়ে ‘ডিকশনারি’র গল্প। সিনেম্যাটিক উপস্থাপন মসৃণ হলেও সেভাবে স্পটলাইটে আলোচিত নয় এই ছবি।
একান্নবর্তী- মৌনাক ভৌমিকের ‘একান্নবর্তী’ (Ekannoborti), যে ছবি একান্নবর্তী পরিবারে দুই বোনের সম্পর্কের গল্প বলে। মূল চরিত্রে অপরাজিতা আঢ্য এবং সৌরসেনী মৈত্র।
অনুসন্ধান- কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের পরিচালনায় কোর্টরুম ড্রামা। ফ্রেডরিক ডিউরেনম্যাটের লেখা 'আ ডেঞ্জারাস গেম' গল্প অবলম্বনে তৈরি হয়েছে। একঝাঁক দক্ষ অভিনেতাদের ভীড়। ঋদ্ধি সেন, শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়, চুর্ণী গঙ্গোপাধ্যায়, প্রিয়াঙ্কা সরকম ও পায়েল সরকার। এই ছবি ন্যায়-অন্যায়, অপরাধ-নিরপরাধের বেড়াজালে বিবেক দংশনের কথা বলে। এই 'অনুসন্ধান' ব্যক্তি বিশেষে নিজেকে খোঁজার গল্প।
প্রেম-টেম - কলেজ মানেই প্রেম। বই-খাতার ফাঁক দিয়ে সকলের আড়ালে পছন্দের মানুষটিকে চুপিচুপি দেখা। চোখে চোখ পড়লেই আলতো হাসি, আর লজ্জা। চায়ের ভাঁড়ের সঙ্গে কথায়-ভালবাসায় ভেজা বিকেল। হাসিঠাট্টা। অলি-গলির চোরা বাঁকে হারিয়ে যাওয়া… বয়ঃসন্ধির সেই চোরাগলি দিয়ে কোন পথে যে প্রেম চলে আসে, তা বোঝা দায়। সেরকমই এক কলেজপ্রেমের গল্প ‘প্রেম-টেম’ (Prem Tem) নিয়ে হাজির হয়েছিলেন পরিচালক অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায় (Anindya Chatterjee)। পাবলো, আরশি আর রাজিকে নিয়ে ফ্রেশ একটা গল্প। কন্টেন্ট ভাল হলেও বক্স অফিসে সেরকম ব্যবসা করতে পারেনি।
ষড়রিপু ২ - সাইকোলজিক্যাল ক্রাইম থ্রিলার ‘ষড়রিপু ২ জতুগৃহ’তে (SHORORIPU 2 Jotugriho) উঠে এসেছে কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ (অহংকার) ও মাৎসর্য্যর (হিংসা) কথা। এক দম্পতির জীবনে কীভাবে ঘনিয়ে আসে অন্ধকার? একটা অনভিপ্রেত ঘটনায় বদলে যায় কয়েকটা মানুষের জীবন। সেই গল্পই ‘ষড়রিপু’র সিক্যুয়েলে তুলে ধরেছেন পরিচালক অয়ন চক্রবর্তী। গোয়েন্দা চন্দ্রকান্তার ভূমিকায় চিরঞ্জিৎ ছাড়াও সিনেমায় গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে শাশ্বত চট্টোপাধ্যায় (Saswata Chatterjee), অরুণিমা ঘোষ (Arunima Ghosh), রণজয় বিষ্ণু ও দর্শনা বণিককে। জটিল মনস্তত্ত্ব ও রহস্য-রোমাঞ্চের মিশেলে গল্প। পুজোয় মুক্তি পেলেও একগুচ্ছ সিনেমার ভীড়ে খুব একটা আলোচিত হয়নি।
বনি - শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের উপন্যাসের আঁধারে তৈরি সায়েন্স ফিকশন। মুক্তি পাচ্ছে ১০ অক্টোবর। অভিনয়ে পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় (Parambrata Chatterjee) এবং কোয়েল মল্লিক (Koel Mallick)। এছাড়াও রয়েছেন অঞ্জন দত্ত, কাঞ্চন মল্লিক। প্রযোজনায় সুরিন্দর ফিল্মস। উল্লেখ্য, এই সিনেমার পরিচালনাও করেছেন পরমব্রত খোদ। ছবির সঙ্গীত পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছেন অনুপম রায়। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সির ব্যবহার হয়েছে। এক সন্তানকে বাঁচানোর লড়াইয়ে প্রেক্ষাপটে মা-বাবার করুণ কাহিনী তুলে ধরা হয়েছে।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন