দুমাসেরও বেশি সময় ধরে শুটিং বন্ধ বাংলায়। দিন কয়েক আগেই গ্রিন জোনে পোস্ট প্রোডাকশনের অনুমতি দিয়েছে রাজ্য সরকার। করোনার প্রকোপমুক্ত নিরাপদ স্থানে আউটডোর শুটিং চালু করা যাবে, এমন একটি নির্দেশিকাও জারি হয়েছে সম্প্রতি। কিন্তু টেলিভিশনের যাবতীয় ধারাবাহিকের শুটিং কোনও না কোনও স্টুডিও-কেন্দ্রিক, যার সবকটিই রয়েছে খাস কলকাতা ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলিতে। এখনও পর্যন্ত স্টুডিওপাড়ায় শুটিং চালু করার অনুমতি পাওয়া যায়নি। তাই এখনও থমকেই রয়েছে বলা যায় টেলিজগতের কাজ এবং চরম আর্থিক সংকটের মুখে পড়েছেন শিল্পী-টেকনিসিয়ানরা। সোশাল মিডিয়ায় সরব হয়েছেন তাঁদের অনেকেই।
চতুর্থ দফার লকডাউনে ১৮ মে থেকে চালু হয়েছে কলকাতা-সহ চারটি জেলার সরকারি গণপরিবহন। কলকাতায় ট্যাক্সি-চলাচলেরও অনুমতি পাওয়া গিয়েছে। এছাড়া ই-পাস সহযোগে চালু হতে চলেছে নির্দিষ্ট সংখ্যক অ্যাপ-ক্যাব পরিষেবা। দোকান-বাজার, সেলুন ও বিউটি পার্লার খোলারও অনুমতি দেওয়া হয়েছে। খুলেছে সরকারি অফিস ও কয়েকটি বেসরকারি সংস্থা। কিন্তু এখনও কেন ধারাবাহিকের শুটিং চালু করার অনুমতি দিচ্ছে না সরকার, সেই নিয়ে ক্রমশ অসন্তোষ বেড়ে চলেছে টেলিজগতের অন্দরে।
আরও পড়ুন: চলতি বাংলা ধারাবাহিক বন্ধ করে ডাবিং করা সিরিয়াল নয়! বিক্ষুব্ধ টেলিজগৎ
অভিনেতা-অভিনেত্রী-পরিচালকেরা সোশাল মিডিয়ায় বার বার তাঁদের অর্থসংকটের কথা তুলে ধরছেন। ১৮ মার্চ থেকে যেহেতু শুটিং বন্ধ রয়েছে তাই বিগত দুমাস বাংলা বিনোদন জগতের ৯০ শতাংশ মানুষ কোনও রকম পারিশ্রমিক পাননি। বাকি ১০ শতাংশ লকডাউনে বসে কিছু ফিকশন ও নন-ফিকশন অনুষ্ঠানের কাজ করেছেন। কিন্তু এই ৯০ শতাংশের মধ্যেই রয়েছেন সেই সব দুঃস্থ শিল্পী ও হাজার হাজার টেকনিসিয়ান যাঁদের জীবনধারণ দুঃসাধ্য হয়ে উঠছে ক্রমশ। আর্টিস্টস ফোরাম সাধ্যমতো চেষ্টা করে চলেছে সীমিত ডোনেশনের মধ্যেই যথাসম্ভব এই শিল্পীদের পাশে থাকার। আর্টিস্টস ফোরামের যুগ্ম সম্পাদক সপ্তর্ষি রায় সম্প্রতি জানিয়েছেন ৪০ দিনে প্রায় ৭০০ দুঃস্থ শিল্পীদের আর্থিক সাহায্য করেছে ফোরাম। সিনে ফেডারেশনের পক্ষ থেকেও দুঃস্থ টেকনিসিয়ানদের ত্রাণ দেওয়া হয়েছে।
কিন্তু এঁরা ছাড়াও টেলিজগতের একটি বড় অংশ জুড়ে রয়েছেন মধ্যবিত্ত শিল্পী-টেকনিসিয়ানরা, যাঁদের সঞ্চয় ক্রমশ ফুরিয়ে আসছে। ঠিক কবে থেকে আবারও কাজ শুরু করতে পারবেন তাঁরা, তা এখনও অনিশ্চিত। এই অনিশ্চয়তা থেকে বাংলা টেলিজগতকে মুক্ত করতে তাঁরা বার বার আবেদন জানাচ্ছেন কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারকে। অভিনেত্রী সৃজনী মিত্র সম্প্রতি একটি ভিডিও বার্তায় মুখ্যমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীকে বিষয়টি বিবেচনা করার অনুরোধ জানিয়েছেন। সৃজনী তাঁর সোশাল মিডিয়া প্রোফাইলে লিখেছেন, ''এই কঠিন পরিস্থিতিতে আমরাও বাঁচতে চাই, আমরাও আবার নতুন করে দর্শকদের আনন্দ দিতে চাই। আমাদেরও পরিবার রয়েছে, তাদের বাঁচাতে চাই...।''
অভিনেতা জিতু কমলও তাঁর টাইমলাইনে লেখেন, ''দয়া করে আমাদের কথাও একটু ভাবুন... আমাদেরও নিরাপত্তা দিন....আমাদের পেশারও সুনির্দিষ্ট পথ দেখান... আমরাও নাগরিক, আমরাও মানুষ।'' টেলি ও টলিপাড়ার বেশিরভাগ শিল্পী-টেকনিসিয়ানরা প্রশ্ন তুলছেন, যেখানে সরকার দোকান-বাজার ও বেশ কিছু অফিস খোলার অনুমতি দিয়েছেন, সেখানে শুটিংয়ে অনুমতি কেন নয়? কিন্তু এই প্রসঙ্গে আর্টিস্টস ফোরামের বক্তব্য কোনও শিল্পীর শুটিংয়ে এসে সংক্রামিত হলে ফোরাম কোনও দায়িত্ব নিতে অক্ষম। আবার প্রযোজকদেরও বক্তব্য, এই মুহূর্তে যদি শুটিং শুরু করা হয় এবং কোনও একটি ইউনিটে সংক্রমণ ধরা পড়ে, তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হবেন তাঁরাই। এরই মধ্যে সরকার সম্প্রতি গ্রিন জোনে অবস্থিত পোস্ট প্রোডাকশন স্টুডিওগুলিকে নির্দেশাবলী মেনে কাজ শুরু করার অনুমতি দিয়েছে। পাশাপাশি চতুর্থ দফার শুরুতেই একটি নির্দেশিকায় বলা হয়েছে যে গ্রিন জোনে আউটডোর শুটিং করা যেতে পারে।
কিন্তু পুরোপুরি শুটিং শুরু করার নির্দেশ এখনও আসেনি। তাই যথেষ্ট আশঙ্কাতেই দিন কাটছে টলি ও টেলিপাড়ার। শুটিং শুরু করা মানেই সঙ্গে সঙ্গে পারিশ্রমিক নয়। অন্তত দুমাস পরে পেমেন্ট পাবেন শিল্পী-টেকনিসিয়ানরা। তাই শুটিং শুরু হতে যত দেরি হচ্ছে, ততই আগামী দু-তিন মাস কীভাবে জীবনধারণ করবেন, সেই দুশ্চিন্তাই জমা হয়েছে বাংলা বিনোদন জগতের অন্দরে।
আরও পড়ুন: কেন নানচাকু নিয়ে ধ্যান করেন, সে কথা জানালেন সুস্মিতা
পরিচালক অয়ন সেনগুপ্ত একটি খোলা চিঠি লিখেছেন সোশাল মিডিয়ায়-- ''...আজ ২মাস হয়ে গেল আমাদের শুটিং বন্ধ, মানে রোজগারও বন্ধ। কিন্তু খরচ হয়ে চলেছে একইভাবে। কোথাও কোথাও বরং খরচ বেড়েছেও হয়তো! ইএমআই, ক্রেডিট কার্ডের বিল, ইলেকট্রিক বিল, সন্তানের স্কুল ফি বন্ধ হয়নি কিছুই.. অন্যদিকে বাজারদর ক্রমশ ঊর্দ্ধমুখী। শুধু রোজগার বন্ধ। ঘরে বসে মোবাইলে শুটিং করে মানসিক ক্ষিদে মিটেছে হয়তো! কিন্তু রোজগার হয়নি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে! আজ অনেক কিছুই স্বাভাবিক হয়েছে... খুলেছে দোকান, চালু হয়েছে বাস, সরকারি-বেসরকারি কর্মসংস্থান, মদের দোকান... আগামীদিনে খুলবে আরও অনেক কিছুই। আমরা জানি না আমাদের ভবিষ্যৎ কি!! জানি না শুটিং কবে শুরু হবে, জানি না রোজগার হবে কবে...''
বাংলা বিনোদন জগতের অভ্যন্তরে একটি অসন্তোষ রয়েছে যে কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার, কোনও পক্ষ থেকেই শিল্পীদের বা টেকনিসিয়ানদের জন্য কোভিড-১৯ পরিস্থিতি মোকাবিলায় কোনও আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়নি। অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন যে এই ইন্ডাস্ট্রি থেকেও যথেষ্ট পরিমাণ রাজস্ব আদায় হয় সরকারের। তাই এই জগতের দুঃস্থ সদস্যদের জন্য কি কোনও বিশেষ ব্যবস্থা করা যায় না? কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা, বাংলা বিনোদন জগতের বেশিরভাগ মানুষই চাইছেন যাতে শুটিং শুরু করা যায় তাড়াতাড়ি।