Leena Ganguly on Me Too: সাম্প্রতিক কালে এরাজ্যে বেশ কিছু মিটু-র ঘটনা সামনে এসেছে, বিশেষ করে বিনোদন জগতে। প্রতিষ্ঠিত নাট্যব্যক্তিত্ব, সঙ্গীতজ্ঞ, পরিচালকদের বিরুদ্ধে যৌন হেনস্থার অভিযোগ এনেছেন অনেকেই। কিন্তু মিটু কি শুধুমাত্র পুরুষতান্ত্রিক শোষণ বা ঔদ্ধত্যের ফসল নাকি মেয়েদের সামগ্রিকভাবে নিজেকে দেখার বা নিজের আত্মসম্মান সম্পর্কে সচেতন হওয়ার ক্ষেত্রে কিছু ফাঁক থেকে যাচ্ছে? কীভাবে এই ধরনের পরিস্থিতি থেকে নিজেদের রক্ষা করবেন মেয়েরা বা আগাম কোন কোন বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে, কীভাবে কমিশনের কাছে পৌঁছনো যায়, সেই সবই জানালেন বিশিষ্ট প্রযোজক-চিত্রনাট্যকার এবং পরিচালক লীনা গঙ্গোপাধ্যায়। বাংলা বিনোদন জগতের অন্যতম পুরোধা হওয়ার পাশাপাশি তিনি পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সনও। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা-কে দেওয়া তাঁর বিশেষ সাক্ষাৎকার--
কমিশনের প্রধান হিসেবে আপনি যদি একটু বলেন যে মেয়েরা নিজেদের কীভাবে এই ধরনের পরিস্থিতি থেকে দূরে রাখবে?
একটি মেয়ে অনেক সময়েই নিজেকে মেয়ে বলেই আটকে রাখতে চায়। নিজের চারপাশে একটা গণ্ডি টেনে নেয় যে আমি মেয়ে। সেটা অনেক দিক থেকে হয়। তার নির্ভরতা। বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে বেড়াতে গেলেও একটি মেয়ে এক্সপেক্ট করে বয়ফ্রেন্ডই সমস্ত খরচ বহন করবে। বিয়ে হয়ে স্বামীর কাছে গেলে, সে যদি চাকরিও করে... আমি একটা সময়ে কলেজে পড়াতাম, আমার অনেক কলিগকে আমি বলতে শুনেছি, আমারটা তো হাতখরচা, সংসারটা তো ও চালায়। এটাও আমি চাইব, আবার আমি স্বাধীনভাবে মাথা উঁচু করে বাঁচার স্বপ্ন দেখব, দুটো একসঙ্গে হয় না। তাহলে প্রথমে মেয়েদের নিজেদের আত্মসম্মানের বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে। কীসে আমার আত্মসম্মান যায় আর কীসে যায় না। ছোট থেকে তো কতগুলো ভাবনা তোমার মনে বুনে দেওয়া হয়। যে স্বামী তোমার দেখভাল করবে, স্বামী তোমার ভাতকাপড়ের দায়িত্ব নেবে। এই রিচুয়ালগুলো আমরা এখনও করে থাকি। আজকের দিনে দাঁড়িয়েও এই রিচুয়ালটা হয় যে একটা ছেলে ভাত-কাপড় তুলে দিচ্ছে, মেয়েটা কিন্তু আনন্দের সঙ্গে অ্যাকসেপ্ট করছে, ছবি তুলছে, পোস্ট করছে। এইখান থেকে তো শুরু যে আমার আত্মসম্মান কোথায় যাচ্ছে, আমি সেটা বুঝতেই পারি না অনেক সময়। পুরুষ বন্ধুটির উপর নির্ভর করি অনেক বেশি। এক্সকারশনে গেলেও দেখেছি যে ছেলেরা সঙ্গে থাকলে মেয়েদের এমন একটা ভাব যে প্রোটেকশনটা হল আর কী। নিজেকে নিজে রক্ষা করার মানসিক শক্তিটা না থাকে... আমি বলছি যে ফিজিকালি অনেক সময় সম্ভব নয়, কিন্তু মানসিকভাবে তো সম্ভব। তো সেই মনের জায়গাটা তো স্ট্রং করতে হবে। আমার মনে হয়, এটা বেসিক। একটা মেয়েকে প্রথমে ভাবতে হবে যে আমি মানুষ, তার পর আমার জেন্ডার। তা না হলে যে বৈষম্যের মধ্যে সে বড় হয়েছে, ভবিষ্যতে সে সেটাই করবে। তার ছেলেমেয়ের ক্ষেত্রেও সেটাই করবে।
সামগ্রিকভাবে মেয়েদের এই যে অ্যাপ্রোচ, এর কারণেই কি খানিকটা মিটু-র মতো ঘটনাগুলি ঘটছে?
সেটা একটা তো পার্ট বটেই। আজকে কেন, যখন হয়েছিল, তখন প্রতিবাদ হয়নি কেন? অনেকের ক্ষেত্রেই তো সম্ভব ছিল প্রতিবাদ করা। সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ হয়নি কেন? আবার আমি অনেককেই জানি... বলতে খারাপ লাগে, তারা সুযোগ নিয়েছে! এটাও জানা, এটাও সত্যি। ওটাও যেমন সত্যি... মিটু, আবার উল্টোদিকে এটাও সত্যি যে কেউ কেউ সুযোগটা নিতে চেয়েছিল।
আরও পড়ুন: প্রসঙ্গ মিটু: বাংলা নাটকে কোড অফ কনডাক্ট চাই
এমন কোনও নিয়ম বা রেগুলেশন কি আনা যায় ইন্ডাস্ট্রিতে, যাতে এই ধরনের ঘটনাগুলি না ঘটে?
দেখো, আইন তো আইনের মতো আছেই। প্রথম কথা হচ্ছে যে আমি কাউকে কতটা অ্যালাউ করব, কতটা স্পেস দেব সেটা আমাকে ভাবতে হবে। আমি এক ধরনের সমাজে বাস করি। একদিনে হঠাৎ সবকিছু বদলে দিতে পারব না। আমার হাতে যতটা আছে, সেই শক্তিটা আমি ব্যবহার করি। এছাড়া যখনই কোনও মেয়ে সমস্যায় পড়ে-- দেখো এটা আমি বার বার বলি যেহেতু আমি কমিশনে আছি-- কমিশন কিন্তু সব সময় সঙ্গে থাকে, এমন অনেক কেস আমরা সলভ করেছি। অনেক সময় আমরা শুনি যে থানা ঠিকমতো অভিযোগ নেয় না, কিন্তু কমিশন সেটা কখনও করে না। আবার অনেক থানায় অনেক অফিসার রয়েছেন খুব সহৃদয়। জেনারেলাইজ তো কিছুই করা যায় না। তো সেই সুযোগগুলোকে নিক না। একটা ট্যাবু থাকে, সোশাল স্টিগমা থাকে যে আমি যাব না, কোথায় যাব? অনেকের সচেতনতার অভাব থাকে। অনেকে জানেই না যে কমিশন কী, তার ভূমিকা কী। তার যে একটা আমব্রেলা রয়েছে, সেটা সে জানে না। সেগুলো জানতে হবে এবং ছোটবেলা থেকেই ওই বিভাজনটাকে অস্বীকার করে বাঁচার কথা ভাবতে হবে।
কমিশনের কাছে সহজে পৌঁছনোর কী কী উপায় রয়েছে?
সবথেকে সহজ হচ্ছে কমিশনের কাছে পৌঁছনো... একটা ফোন। একটা ফোনের দূরত্ব। আমাদের নম্বর দেওয়া থাকে সব মেম্বারদের। চেয়ারপার্সনের নম্বর দেওয়া থাকে। যে কেউ যে কোনও সময় ফোন করতে পারে। আমি সারারাত ফোন অ্যাটেন্ড করি। এছাড়া কমিশনের অফিসিয়াল নম্বর আছে, ফোন করতে পারে, মেল করতে পারে। হোয়াটসঅ্যাপ করে কমপ্লেন করতে পারে, তাকে সরাসরি আসতেও পারে না। এই সব নম্বরই ওয়েবসাইটে আছে। এবং এভাবেই ফোন আসছে... অজস্র ফোন আসে।
এই ইন্ডাস্ট্রি থেকে কারও ফোন গেছে কি?
হ্যাঁ, ইন্ডাস্ট্রি থেকেও ফোন গেছে... অনেকের অনেক রকম সমস্যায়। সব রকম মিলেমিশে রয়েছে। তবে ইন্ডাস্ট্রিতে আমি বলব, এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে এক্সপ্লয়টেশনটা কম, আগে বেশি ছিল। দেখো, আমি আমার টেনিওরে তেমন খুব বেশি পাইনি। আমি আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলছি না, আমার কাছেও তো খবর আসত। কিন্তু তেমন কোনও খবর আসেনি। বরং যদি কেউ এক্সপ্লয়টেড হতে চেয়েছে, সে হয়েছে। ইন্ডাস্ট্রি সম্পর্কে তো একটা বদনাম ছিল! যারা সুস্থভাবে কাজ করে, তাদের ক্ষেত্রে তো... কত মেয়েরা তো কত রাত পর্যন্ত কাজ করে। তেমন কিছু হলে কি কমপ্লেন হতো না? এখন কিন্তু পরিস্থিতিটা অনেক বদলে গেছে, অনেক পরিষ্কার।
আরও পড়ুন: #MeToo: দেশের সব মহিলাদের জন্যই মি টু, বললেন নন্দিতা দাস
যারা এখন এরকম পরিস্থিতিতে পড়ছে, তাদের কি কোথাও জাজমেন্টাল এরর হচ্ছে?
ঠিক সেটা নয়, দেখো অনেক ক্ষেত্রে হচ্ছেও হয়তো। আমি বলছি না যে সব ধুয়েমুছে সাফ হয়ে গেছে... মানুষ তো সবাই। সেটা হলে, মেয়েরা চুপ করে থাকলে তো সমস্যার সমাধান হবে না। তাকে তো ওপেন আপ করতে হবে, কথা বলতে হবে। জানাতে হবে। আর এটা বলছি না যে শুধু সেক্সুয়ালি হ্যারাসড হচ্ছে মেয়েরা, কাজের দিক থেকেও যদি কেউ এক্সপ্লয়টেড হয়, যদি মেয়ে বলে তাকে ডিসক্রিমিনেট করা হয়, সেটাও তো তাকে বলতে হবে।
বাংলা টেলিভিশন বা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে কি মহিলা-পুরুষের পারিশ্রমিকের বৈষম্য একেবারেই নেই?
একদমই নেই। দেখো যে যেরকম কোট করে। এখন হয়তো মেয়েরা মনে করছে এর চেয়ে বেশি আমি পাব না... এইটা আমি বলতে পারব না এই কারণে যে এটা একটা ক্রিয়েটিভ ফিল্ড তো, তুমি তোমাকে কত কোট করবে এবং যিনি নিচ্ছেন তিনি তোমাকে কত টাকা দেবেন, সেটা পারস্পরিক চুক্তি। এটাকে আমি ঠিক ওয়েজেসের মতো করে ধরব না। এটা তো ডেইলি ওয়েজেস নয়। সেখানে আমি বলতে পারি একটা ছেলের সঙ্গে মেয়ের পারিশ্রমিকে ভেরিয়েশন হচ্ছে কেন? কিন্তু এক্ষেত্রে সেটা বলা যাবে না।