/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2020/01/SOUMENDU-RAY-01.jpg)
সৌমেন্দু রায়
বিগত এক বছরে বাংলা সিনেমায় তাঁদের অবদানের জন্য ২৪টি বিভাগে বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির কলাকুশলীদের সম্মানিত করে আসছে দ্য ওয়েস্ট বেঙ্গল ফিল্ম জার্নালিস্টস অ্যাসোসিয়েশন (WBFJA)। এবছর নিয়ে চতুর্থবার অনুষ্ঠিত হবে 'সিনেমার সমাবর্তন' শীর্ষক এই পুরস্কার বিতরণী সভা। বিষয়টা হলো, WBFJA যদিও দাবি করে যে এই সম্মান কারা পাবেন, তা সম্পূর্ণ নির্ভর করে তাদের সদস্য সাংবাদিকদের পছন্দের ওপর, চূড়ান্ত বাছাই করেন সেই উদ্যোক্তারাই, এবং WBFJA-র শীর্ষ কর্তারা।
৬ জানুয়ারি নন্দনে আয়োজিত একটি প্রেস কনফারেন্সে WBFJA-র সম্পাদক নির্মল ধর বলেন, এবছর ভালো ছবির সংখ্যা এতই বেশি যে প্রতিটি বিভাগে মনোনীত ছবি/পরিচালক/টেকনিশিয়ানদের সংখ্যা বেঁধে রাখতে হয়েছে চারে। তিনি এও বলেন যে এর অর্থ এই নয় যে যাঁরা মনোনীত হন নি, তাঁরা কোনও অংশে কম। এর অর্থ কী দাঁড়াল তবে? এতই যদি ভালো হবেন, তবে তাঁদের মনোনীত করা গেল না কেন? তার কারণ ২০১৯-এ যে ১৩০টি বাংলা ছবি মুক্তি পেয়েছে, তাদের অনেকগুলিই এতই চমৎকার যে বাকিরা দৌড়ে পিছিয়ে গেছে।
অতঃপর পুরস্কার পাওয়া ছবির তালিকা চূড়ান্ত করতে মনোনয়নের তালিকা ই-মেইল মারফৎ পাঠানো হয় WBFJA-র সদস্য সাংবাদিকদের। কিন্তু অনেক বিভাগেই দেখা যায়, চারটি মনোনয়নের সীমারেখা লঙ্ঘিত হয়ে পাঁচ, এমনকি ছয় পর্যন্ত গেছে। কেন এই অসঙ্গতি?
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2020/01/WBFJA-PRESS-CONFERENCE-PROSENJIT-ONE.jpg)
সোশ্যাল মিডিয়ায় তুমুল সমালোচনার মুখে পড়েছে বেশ কিছু মনোনয়ন। সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের 'শাহজাহান রিজেন্সি' ছবিতে 'বেস্ট সাপোর্টিং অ্যাক্টর ফিমেল' বিভাগে তাঁর মনোনয়নের বিরুদ্ধে কড়া আপত্তি জানিয়ে স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায় ক্রুদ্ধভাবে বলেছেন, চূড়ান্ত তালিকায় তাঁর নাম যদি থাকেও, তবু এই পুরস্কার নেবেন না তিনি, কারণ "এই ছবিতে কাউকে সাপোর্ট করি নি আমি"। অর্থাৎ ছবিতে যে তিনি 'সাপোর্টিং' বা পার্শ্বচরিত্রের ভূমিকায় ছিলেন, সেকথা মানেন না স্বস্তিকা, অতএব এই মনোনয়ন তাঁর চোখে অন্যায্য। সত্যিটা কী? সত্যিটা হলো যে ছবিটিতে চার মহিলা চরিত্রের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা স্বস্তিকারই। তাঁর অভিনীত চরিত্রটি বহুমাত্রিক, এবং পর্দায় ফুটেজও পেয়েছে যথেষ্ট। সেদিক থেকে দেখতে গেলে খারাপ কিছু বলেন নি তিনি।
অন্য একটি বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছেন ইউএনআই-এর সাংবাদিক অতনু রায়। তাঁর বক্তব্য, 'মোস্ট প্রমিজিং ডিরেক্টরস/অ্যাক্টরস/অ্যাক্ট্রেসেস', অর্থাৎ, সবচেয়ে সম্ভাবনাময় পরিচালক/অভিনেতা/অভিনেত্রী বিভাগে একেবারে নতুনদের কাজই আলোচিত হওয়ার কথা, কিন্তু মনোনয়নের তালিকায় এমন অনেককেই দেখা যাচ্ছে, যাঁদের নতুন বলা যায় না। উদাহরণস্বরূপ অতনু উল্লেখ করেছেন সায়ন্তন ঘোষাল ('সাগরদ্বীপে যখের ধন') এবং প্রদীপ্ত ভট্টাচার্য ('রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত')-র নাম।
বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে 'সম্ভাবনাময়' কথাটিও। কথাটার মানে ঠিক কী? প্রথম ছবি? নাকি 'সম্ভাবনাময়' দ্বিতীয় প্রচেষ্টা? এই বিভ্রান্তি যদি না কাটাতে পারে WBFJA, তবে তাঁরাই সবচেয়ে খেপে উঠবেন, যাঁদের প্রতিনিধিত্ব করার দাবি করে এই সংগঠন - অর্থাৎ মিডিয়া। কিন্তু আগামীকাল, ১২ জানুয়ারি, প্রিয়া সিনেমায় হতে যাচ্ছে পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠান। জট কাটবে কি?
সৌমেন্দু রায় - ক্যামেরার পেছনে এক গৌরবময় অধ্যায়
এবছর WBFJA-র 'লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট' সম্মান পাচ্ছেন বর্ষীয়ান চিত্রগ্রাহক (cinematographer) সৌমেন্দু রায়, আগামী ৭ ফেব্রুয়ারি যাঁর বয়স ৮৭ বছর পূর্ণ হবে। অত্যন্ত যোগ্য প্রাপক, সন্দেহ নেই, কিন্তু এই সম্মান আরও আগে আসা উচিত ছিল।
সত্যজিৎ রায়ের নামের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে আরও দুজনের নাম - সৌমেন্দু রায় এবং সুব্রত মিত্র। দুজনেই ভারতের শ্রেষ্ঠতম সিনেমাটোগ্রাফারের তকমা পাওয়ার যোগ্য, দুজনকে নিয়েই নির্মিত হয়েছে দুটি পৃথক তথ্যচিত্র। সৌমেন্দু রায় সম্পর্কিত তথ্যচিত্রটিতে নেপথ্যকন্ঠে শোনা যায় এই বার্তা, "বাস্তব জীবনে যা কিছু দেখে, সেলুলয়েডে তাই তুলে ধরে মুভি ক্যামেরা। এই ছবিগুলো সম্পূর্ণ বাস্তব নয়। ক্যামেরা পরিচালনা করে মানুষ। ত্রিমাত্রিক ছবি হয়ে যায় দ্বিমাত্রিক, যদিও তৃতীয় মাত্রার আভাস রয়ে যায়...দর্শকের চোখ এবং ক্যামেরার চোখ এক এবং অদ্বিতীয় হয়ে ওঠে।"
বাস্তব জীবনে তিনি যেমন, তথ্যচিত্রেও সেই সৌমেন্দু রায়কেই দেখি আমরা। অতীব রকম বিনয়ী, নিজের ভাবনাচিন্তা সম্পর্কে স্পষ্টবক্তা, বাগান বা মাঠের মাঝখানে আয়েশ করে বসা, অথবা নিজের বাড়িতে বসে, বা কফি হাউজে চা খেতে খেতে। পারিবারিক কারণে আপস করতে বাধ্য হয়েছেন যেমন স্বীকার করে নেন, তেমন এও বলেন যে সেরকম পরিস্থিতি কমই এসেছে। অবাক লাগে শুনলে, যে তিনি একটিও হিন্দি ছবিতে ক্যামেরার কাজ করেন নি, বরং কাজ করেছেন কয়েকটি তামিল ছবিতে। যে সুব্রত মিত্রের সহকারী হিসেবে বছরের বছরের পর কাজ করেছেন, সেই সুব্রত মিত্রকে গুরু মানেন সৌমেন্দুবাবু।
সীমিত বাজেট এবং ন্যূনতম যন্ত্রপাতি নিয়ে কাজ করার ব্যাপারে সৌমেন্দুবাবু বলেন, কম টাকা এবং সীমিত পরিকাঠামোর মধ্যে কাজ করা মানে শুধুই চ্যালেঞ্জ নয়, নানারকম বিকল্প পদ্ধতি শেখার সুবর্ণ সুযোগও, যে সুযোগ বড় বাজেটে পাওয়া যায় না। সৌমেন্দুবাবু 'অশনি সঙ্কেত' নিয়ে কথা বলা শুরু করা মাত্রই তথ্যচিত্রটি কিছুক্ষণের জন্য সাদাকালো থেকে রঙিন হয়ে যায়, যেহেতু এটি ছিল তাঁর প্রথম রঙিন ছবি। এছাড়াও তরুণ মজুমদার এবং তপন সিনহার স্মরণীয় ছবিতে কাজ করার অভিজ্ঞতার কথা বলেন তিনি।
এই তথ্যচিত্রটি যতটা সৌমেন্দু রায়ের জীবনী, তার চেয়েও বেশি টেকনিক্যাল প্রশিক্ষণ। সিনেমাটোগ্রাফির জটিল অভ্যন্তর সম্পর্কে অসংখ্য না জানা তথ্য জানতে পারি আমরা - বিভিন্ন রঙের লেন্স, ক্যামেরার নড়াচড়া এবং অ্যাঙ্গেল, রঙিন এবং সাদাকালোর ফারাক।
'পোস্টমাস্টার', 'মণিহারা', এবং 'সমাপ্তি' নিয়ে সৌমেন্দুবাবুর বক্তব্যের দৌলতে খুলে যায় সত্যজিতের জগতের এক গোপন জানালা। প্রবীণ চিত্রগ্রাহক জানান, কীভাবে ছবির মুড অনুযায়ী ক্যামেরার গতবিধি নির্ধারণ করার ওপর জোর দিতেন সত্যজিৎ। "পোস্টমাস্টারের গল্পটা যেহেতু দুঃখের, ওঁর ইচ্ছে ছিল আমি গোটা ছবিটাই মেঘলা আবহে শুট করি। 'মণিহারা'র শুটিং হয় খুব সুন্দর সাজানো একটা বাড়ির মধ্যে, এবং কাহিনির গা ছমছমে পরিবেশের সঙ্গে মানানসই আলো দিতে হয় আমাকে। 'সমাপ্তি'র মুড হালকা, মজার, কাজেই ক্যামেরাও ছিল ঝকঝকে, উজ্জ্বল।"