গরম হচ্ছে পৃথিবী। প্রকৃতি নানা ধরনের বোম্বেটে আচরণ করে চলেছে। কোথাও হড়পা বান, মাত্রার চেয়ে অনেক ঝমঝমানো, ফলে বন্যা, কোথাও তাপপ্রবাহ, দাবানলে পুড়ে সব স্টিফেন কোর্ট। পৃথিবীর উষ্ণতা দেড় ডিগ্রির মধ্যে রোখো। সেই চেষ্টায় এখন মাথা ঘামাচ্ছে বিভিন্ন দেশ। ধরিত্রীর গায়ে থার্মোমিটার দিয়ে রাত্রির ঘুম গিয়েছে পরিবেশবিদদের। এ সব কী হচ্ছে, তা হলে সবুজ পৃথিবীর মানুষগুলো খুবই অবুঝ? ভারত অবশ্য এই পথে উল্লম্ফনের লক্ষ্য স্থির করেছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোয় বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে পাঁচটি গগনচুম্বী প্রতিশ্রুতির ঘোষণা করেছেন। যাকে তিনি পঞ্চামৃত বলেছেন। ২০৩০-এর মধ্যে ১০০ কোটি টন কার্বন নিঃসরণের লক্ষ্য রয়েছে তাতে। পুরোদস্তুর কার্বন নিঃসরণ নিয়ে ভারত এই প্রথম কোনও লক্ষ্য স্থির করল। ভারতের এমন সিদ্ধান্তে অনেকেই হতবাক হয়েছেন। কারণ উন্নয়নের যে স্তরে রয়েছে ভারত, তাতে এ জাতীয় ঘোষণা যা গর্জনেরই আর এক রূপ, মোটেই সহজ কিছু নয়। এবং এই লক্ষ্য বাস্তবায়িত করতেও ভারতকে আদাজল খেয়ে নামতে হবে, কাঠখড় পোড়াতে হবে অনেক। যা হোক, মোদ্দা কথাটা ম্যাগনিফাই করা যাক।
ঘোষণার গভীরে
ওয়ার্ল্ড রিসোর্স ইনস্টিটিউটের হিসেবে ভারতের মোট গ্রিনহাউস গ্য়াস নিঃসরণের পরিমাণ ২০১৮ সালে ছিল ৩.৩ বিলিয়ন বা ৩৩০ কোটি টন। ২০৩০ সালের মধ্যে যা ৪০০ কোটি টনে গিয়ে পৌঁছবে। এখন এই সময়ের মধ্যে ১০০ কোটি টন কমানোর মানে চার ভাগের এক ভাগ নিঃসরণ কমাতে হবে ভারতকে। মোদীর পঞ্চামৃত কী, চোখ দেওয়া যেতে পারে একবার, সংক্ষেপে।
পঞ্চামৃত
১. নন-ফসিল বা অ-জীবাশ্ম জ্বালানিতে লক্ষ্যমাত্রা ২০৩০-এর মধ্যে ৫০০ গিগাওয়াট
২. ২০৭০ সালের মধ্যে নেট জিরো-তে পৌঁছানো
৩. ২০৩০-এর মধ্যে মোট ব্যবহৃত শক্তির ৫০ শতাংশই রিনিউয়েবল এনার্জি বা পুনর্ব্যবহারযোগ্য শক্তির টার্গেট
৪. ২০৩০ সালের মধ্যে ১০০ কোটি টন কার্বন নিঃসরণ হ্রাস
৫. ইউনিট পিছু শক্তি খরচে যতটা কার্বন নিঃসরণ হয়, তার পরিমাণ ২০৩০ সালের মধ্যে ৪৫ শতাংশের নীচে নামানো
নেট জিরোর লক্ষ্যে
নেট জিরোর লক্ষ্যে পদক্ষেপ করুক ভারত, সারা পৃথিবীই এই দাবি জানিয়ে আসছিল। ফলে প্রধানমন্ত্রী মোদী ঘোষণা করেছেন। তাতে অনেকেরই মুখ বন্ধ হবে বৈকি! তাই বিশেষজ্ঞদের মত, এটা মোদীকে করতেই হত, উপায় ছিল না এ ভিন্ন। কিন্তু নেট জিরো বস্তুটা কী? যে পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ আমরা ঘটাচ্ছি আমাদের হাজারো কাজে-অকাজে, তা কমিয়ে বা প্রকৃতি থেকে যথেষ্ট পরিমাণ কার্বনকে খিড়কি দরজা দেখিয়ে ভারসাম্য ফেরানোকে নেট জিরো বলা হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে পরিবেশ থেকে কার্বন বিয়োগের আধুনিক প্রযুক্তিরও বিরাট ভূমিকা। সেই সঙ্গে কার্বন নিঃসরণের পথে অ-জীবাশ্ম শক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে হুহু। পৃথিবীর ৭০ শতাংশের বেশি দেশ নেট জিরোর লক্ষ্য বা প্রতিশ্রুতি দরজাটি খুলে ফেলেছে। প্যারিস চুক্তিতে শিল্পায়নের আগের চেয়ে উষ্ণতাবৃদ্ধি ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখার যে লক্ষ্যমাত্রা স্থির হয়েছে, নেট জিরো সেই লক্ষ্যেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গ, তাই বিভিন্ন দেশ এই পথে এগিয়ে চলার কথা বলে ফলেছে আগেই, পোক্ত সিদ্ধান্ত জানিয়েছে।
চিন-- সবচেয়ে বেশি কার্বন নিঃসরণ করে যে দেশ, ২০৫০ সালের মধ্যে নেট জিরোর টার্গেট জানিয়েছে তারা। ২০২০-তে রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ সভায় প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এই লক্ষ্যের ঘোষণাটি করেছেন। পৃথিবীর দ্বিতীয় কার্বন নিঃসরণকারী দেশ হল আমেরিকা। এ বছরের ফেব্রুয়রিতে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো জানান তাঁরা ২০৫০ সালের মধ্যে নেট জিরোয় পৌঁছতে এক সঙ্গে কাজ করবেন। ভারত দেরিতে নেট জিরো টার্গেট ঘোষণা করলেও, প্যারিস চুক্তির ক্লাইমেট অ্যাকশন প্ল্যান মোতাবেক আমরা এগিয়ে যেতে শুরু করে দিয়েছি আগেই। সেই অগ্রগতি বলা চলে পঙ্খিরাজে চেপে। ২০০৫-এর তুলনায় ২০৩০-এর মধ্যে প্রতি ইউনিট জিডিপিতে কার্বন নিঃসরণ ২০৩০-এর মধ্যে ৩৩ থেকে ৩৫ শতাংশ কমানোর পরিকল্পনা ভারতের তরফে জমা পড়েছে। অনেকের মত, ভারত ছোট্ট পায়ে হাঁটতে হাঁটতেই এই লক্ষ্যে সহজেই পৌঁছে যাবে। যা হবে স্থির করা সীমার আট বছর আগে-- ২০২২-এ।
এ ক্ষেত্রে ২০৩০ সালের মধ্যে এই লক্ষ্যমাত্রা ৪৫ শতাংশ করা হয়েছে। এর অর্থ হল এটাও যে, দেখো আমরা জলদি এগচ্ছি, দেখো! বিদ্যুৎ উৎপাদনে এখনও ভারতের কয়লা নির্ভরশীলতা রয়েছে সিংহভাগ। কিন্তু সৌরশক্তি, বায়ুশক্তিতেও এ দেশের অগ্রগতি চোখে আলোর ঝলকানি দেবে। দু'বছর আগে নিউইয়র্কে রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণসভার জলবায়ু সম্পর্কিত পার্শ্ব বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেন, ২০৩০ সালের মধ্যে রিনিউয়েবল এনার্জির উৎপাদনক্ষমতা ৪৫০ গিগাওয়াট ছোঁয়ার টার্গেট। সেই সময়ে ভারতের ঘোষিত লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২০২২-এর মধ্যে ১৭৫ গিগাওয়াট রিনিউয়েবল এনার্জি উৎপাদন। পুনর্ব্যবহারযোগ্য শক্তি উৎপাদন গত কয়েক বছর ধরেই বর্ধিষ্ণু। বিদ্যুৎক্ষেত্রে নতুন বেশির ভাগ উদ্যোগই তাই অ-জীবাশ্ম ক্ষেত্রে নেওয়া হচ্ছে এখানে। ভারত ইতিমধ্যে জানিয়েও দিয়েছে, ২০২২-এর পর আর কোনও তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরির পরিকল্পনা নেই। ২০৩০ সালের মধ্যে ৪০ শতাংশ অ-জীবাশ্ম জ্বালানির লক্ষ্যে আমাদের এগিয়ে চলা তাই সাফল্যে গল্প বলবে কিনা, দেখতে হবে। এখন অবশ্য ৭০ শতাংশের বেশি বিদ্যুৎই কয়লা থেকে তৈরি হচ্ছে। অনেকেই বলছেন, ভারত যে ভাবে এগচ্ছে তাতে শৃঙ্গে পৌঁছানো মোটেই অসম্ভব কিছু নয়।
ইন্টারন্যাশনাল সোলার অ্যালায়েন্সের প্রধান অজয় মাথুর বলছেন, ২০৩০ সালের মধ্যে ১০০ কোটি টন কার্বন নিঃসরণ হ্রাস এবং অ-জীবাশ্ম জ্বালানি ৫০০ গিগাওয়াটে নিয়ে যাওয়া একটি বিরাট এবং সংস্কারধর্মী ঘোষণা। রিনিউয়েবল এনার্জিকে ৫০ শতাংশে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্য প্রকৃতির প্রতি ভারতের অঙ্গীকারের বার্তা। কাউন্সিল অফ এনভায়রনমেন্টের কর্তা অরুণাভ ঘোষ বলছেন, ভারত জলবায়ু নিয়ে বড় ঘোষণাটি করে দিয়েছে, এখন বল উন্নত দেশগুলির কোর্টে। জয়বায়ু অর্থনীতিতে। এখন ভারতের দাবি, আমেরিকা জলবায়ু খাতে ১০০ কোটি ডলার যত তাড়াতাড়ি দিক। ফলে আমাদের জলবায়ু নিয়ে পদক্ষেপের দিকে নজর দিলেই শুধু হবে না, অর্থিক জলবায়ুর দিকেও নজরবন্দি করা চাই।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন