Advertisment

লকডাউন পরবর্তী পর্যায়ে গ্রামীণ ক্ষেত্রে  সরকারের ১৫ হাজার কোটি- ইন্ডিয়ার বদলে ভারতে জোর? 

 শহরাঞ্চলে কোভিড পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে সামান্যই, স্পষ্ট যে আর্থিক সচলতার জন্য ইন্ডিয়া নয়, ভারতের দিকেই তাকাতে হবে এবার।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Lockdown, Indian Rural Economy

ভারতীয় কৃষির মূল্য ও সম্ভাবনা বোঝার জন্য কোভিড-১৯ জনিত ভয়াবহ সর্বব্যাপী আর্থিক সংকটের প্রয়োজন হল

করোনা মোকাবিলায় লকডাউন (ঘরবন্দি) ও নোটবন্দির সঙ্গে অনেকেই তুলনা করছেন। তুলনাটা আসছে ভারতের কৃষি অর্থনীতিতে এ দুয়ের প্রভাব সম্পর্কে আলোচনায়। দুইয়েরই ফল এক- চাহিদার বিনষ্টি, তা ভিনপথে হলেও।

Advertisment

নোটবন্দির ফলে মূলত নগদ নির্ভর কৃষি উৎপাদনের বাজার ব্যাপক মার খেয়েছিল। নোটবন্দি পূর্ববর্তী সময়ে একজন ব্যক্তি ব্যবসায়ী ভরা মরশুমে ৫০ লক্ষ থেকে ১ কোটি টাকার পণ্য কিনছেন এবং কৃষকদের তার দাম নগদে মেটাচ্ছেন, এরকমটা অস্বাভাবিক কিছু ছিল না। নোট বন্দি ও ২০১৭-১৮ সালের কেন্দ্রীয় বাজেটে নগদ লেনদেনে বিধিনিষেধের ফলে পাইকারি বাজারে নগদের অভাব দেখা গেল, ফলে অভাব দেখা দিল চাহিদাতেও।

ঘরবন্দি পর্যায়ে চাহিদার বিনষ্টি নগদের অভাবে ঘটল, ঘটল ক্রেতার অনুপস্থিতিতে। এই ক্রেতারা গৃহস্থ ক্রেতা নয়, প্রাতিষ্ঠানিক ক্রেতা। হোটেল, রেস্তোরাঁ, চায়ের দোকান, রাস্তার খাবার দোকান, মিষ্টির দোকান, হোস্টেল, ক্যান্টিনের সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হয়ে গেল বিয়ের ও অন্যান্য যে কোনও অনুষ্ঠান। এমনকি রোজগার কমার সঙ্গে সঙ্গে গৃহস্থের খাওয়ার বিষয়টিও প্রভাবিত হল। গরিব ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার হঠাৎ দেখল তারা কর্মহীন, ধনীদের কাজ না থাকায় খাবারের প্রয়োজনীয়তা কমল।

যে কারণেই হোক, ফলাফল একই থেকে গেল। নোটবন্দি ও ঘরবন্দি দুইই কৃষিপণ্যের দাম কমিয়ে দিল, চাহিদার কার্ভে বদল ঘটিয়ে। এখানে দাম বাড়ার জন্য চাহিদা কমেনি।

আরও পড়ুন, কত পরিযায়ী শ্রমিক বাস্তুচ্যুত হলেন এই লকডাউনে?

বরং গৃহস্থের ভোগ কমার সঙ্গে সঙ্গে - অনেক খাদ্য সংস্থা কারখানায় উখপাদন কমাল এবং তার ফলে তাদের কাঁচামাল কেনার পরিমাণও কমল, দুধ, আলু ও টোম্যাটোর মত জিনিসের দাম এক থাকলেও চাহিদা কমল।

নোটবন্দি ও লকডাউনের মধ্যে আরেকটি মিল হল, দুটি ঘটনাই ঘটেছিল রবিশস্যের ব্যাপক উৎপাদনের পর, প্রথমটা ২০১৭-র এপ্রিল-জুনে, এবং দ্বিতীয়টা তিন বছর পর।

***

এই মিল এবং অন্য মিলের কথা না ভুললেও, আরেকটা কথা মনে রাখার, দুই সিদ্ধান্তই লাগু হয়েছিল রাতারাতি, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর রাত ৮টার ভাষণের পর। তবে ঘরবন্দি  ও নোটবন্দির মধ্যে তফাৎও রয়েছে।

যেমন, নোটবন্দি যখন ঘটেছিল তখন কৃষিক্ষেত্র কঠিন পরিস্থিতির মুখে ছিল, ২০১৪ ও ২০১৫ সালের পরপর খরার জন্য এবং সারা পৃথিবীর কৃষি পণ্যে ২০১৫-১৬ ও ২০১৬-১৭য় দাম পড়ার জন্য।

নোটবন্দির ফলে প্রাথমিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল কৃষি ও অসংগঠিত উদ্যোগ, অন্যদিকে উৎপাদন ও পরিষেবা ক্ষেত্র বাস্তবত নোটবন্দি ও জিএসটি জমানায় লাভই করেছে। অন্যদিকে লকডাউনের ফলে এরাই কৃষিক্ষেত্র থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত।

২০১৯-২০-র শেষ দুই ত্রৈমাসিকে আর্থিক বৃদ্ধিকে ছাড়িয়ে গিয়েছে কৃষিতে বৃ্দ্ধি। এমনকি লকডাউন ২৫ মার্চ কার্যকর হওয়ার পর কৃষির সঙ্গে যুক্ত কাজকর্ম, সে ফসল কাটাই হোক বা মান্ডিকে ফসল বিক্রি, রাজ্যের মধ্যে ও আন্তঃরাজ্য কৃষিপণ্য চলাচল ঘরবন্দির বিধিনিষেধ থেকে ছাড় পেয়েছে।

দ্বিতীয় বড় তফাৎ ছিল সরকারের প্রতিক্রিয়ায়। ভারতে ২০১৫-১৬ থেকে ১৭-১৮ পর্যায়ে খাদ্যবীজ ও ভোজ্য তেল আমদানি সর্বোচ্চ ছিল। নোটবন্দির আগের ও পরের এই পর্যায়ে সরকার মুদ্রাস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রাকে সরকারিভাবেই মেনে নিয়েছে এবং একই সঙ্গে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইনে নতুন জীবন দান করেছে।

পেঁয়াজ, আলু, খাদ্যশস্য ও চিনির মজুত সীমা আবদ্ধ করা হয়েছে বিভিন্ন সময়ে এবং একইসঙ্গে শুল্কবিহীন আমদানি অনুমোদিত হয়েছে, রফতানি নিষিদ্ধ হয়েছে। আমদানিতে নিয়ন্ত্রণ জারি হয়েছে ২০১৭ সালের শেষদিকে, কৃষিক্ষেত্রে অসন্তোষের জেরে।

আরও পড়ুন, লকডাউনজনিত কর্মহানিতে লিঙ্গগত তারতম্য

বরং লকডাউনের সময়ে সরকারের ভূমিকা বেশি কার্যকর ছিল। তার একটা কারণ হতে পারে কৃষিপণ্য কাজে লাগানো। এর কারণ কেবল স্বাস্থ্যগত জরুরির পরিস্থিতিতে খাদ্যসরবরাহ অক্ষুণ্ণ রাখাই নয়, এর ফলে ওই পরিস্থিতিতে একমাত্র কার্যকরা আর্থিক কাজকর্ম ছিল কৃষিক্ষেত্র।

ফলে কৃষিশ্রমিকদের ও মেশিনের চলাচলের ব্যাপারে কোনও বিধিনিষেধ রাখা হয়নি।

এটা ঘটনা যে কৃষকরা এই সময়ে দুধ, টোম্যাটো, গাজর, ক্যাপসিকাম, লাউ, থেকে শুরু করে কলা, আঙুর, তরমুজ ও তোতাপুরী আমের মত পচনযোগ্য সামগ্রীর বিক্রিতে ক্ষতির মুখে পড়েছেন। প্রাতিষ্ঠানিক চাহিদা ভেঙে পড়ায় এবং বাড়ির বাইরে খাওয়া বন্ধ হওয়ায় পোলট্রি থেকে আখচাষিরা ক্ষতির মুখে পড়েছেন।

তবে একই সঙ্গে মনে রাখতে হবে সরকারি সংস্থা এই সময়ে রেকর্ড পরিমাণ ধান ও গম সংগ্রহ করেছে। গম সংগ্রহের পরিমাণ ২০১৯-১০-র পণ্য থেকে ৩৮.৬ মিলিয়ন টন,ধান ৭৪.৩ মিলিয়ন টন। এ ছাড়া ১.৮ মিলিয়ন টন চানা, ০.৮ মিলিয়ন টন রেপসিড সর্ষে, ও ০.৩ মিলিয়ন টন অড়হর সংগ্রহ করা হয়েছে। এর সঙ্গে যোগ করতে হবে ৮.৩৭ কোটি কৃষককে ১৬৭৫০ কোটি টাকা সরাসরি ট্রানসফার, যা প্রধানমন্ত্রী কিসান নিধি যোজনার প্রথম কিস্তির ২০০০ টাকা। কৃষিক্ষেত্রে লকডাউনের পর সরকার ১৩৩০০০ কোটি টাকারও বেশি খরচ করছে।

এই টাকার অঙ্ক কম নয়, বিশেষ করে মাত্র তিন মাস সময়ের মধ্যে। এর মধ্যে নগদ ঢালার কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে এবং এর সঙ্গে সোশাল ডিসট্যান্সিং বিধি মেনে কৃষকদের কাছ থেকে শস্য কেনার কাজও চলছে।

***

কৃষিতে নতুন করে এই গুরুত্ব দেওয়ার ফলে দুটি বড়সড় সংস্কারকে সামনে নিয়ে আসছে যা সাধারণ অবস্থায় ঘটত না। প্রথমত কৃষি পণ্য বিক্রি ও ক্রয়ের বিষয় রাজ্য নির্ধারিত সীমার মান্ডির আওতায় আবদ্ধ থাকছে না। এর ফলে তত্ত্বগতভাবে কৃষকরা সরাসরি রাজ্যসীমার বাইরের  প্রক্রিয়াকরণকারী, রফতানিকারক, পাইকার, ও খুচরো বিক্রেতার কাছে পণ্য বিক্রির স্বাধীনতা পেয়েছেন। দ্বিতীয় সংস্কার হল খাদ্যপণ্যের মজুতের ঊর্ধ্বসীমা প্রত্যাহার। এই অধিকার এতদিন সরকারের ছিল, তবে তা তারা লাগু করল এখন।

ভারতীয় কৃষির মূল্য ও সম্ভাবনা বোঝার জন্য কোভিড-১৯ জনিত ভয়াবহ সর্বব্যাপী আর্থিক সংকটের প্রয়োজন হল। ১ এপ্রিল থেকে বকেয়া ১৭৬২২ কোটি টাকার মনরেগা মজুরি যদি দিয়ে দেওয়া হয় তাহলে গত তিন মাসে কৃষি ও গ্রামীণ ক্ষেত্রে খরচের পরিমাণ ১৫০০০০ কোটি ছাড়াবে। শহরাঞ্চলে কোভিড পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে সামান্যই, স্পষ্ট যে আর্থিক সচলতার জন্য ইন্ডিয়া নয়, ভারতের দিকেই তাকাতে হবে এবার।

(এই নিবন্ধটির এক ভিন্ন সংস্করণ এই সপ্তাহে পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর দ্য অ্যাডভান্সড স্টাডি অফ ইন্ডিয়া প্রকাশিত ইন্ডিয়া ইন ট্র্যানজিশন-এ প্রকাশিত হয়েছে।)

Lockdown indian economy
Advertisment