২০১৯ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া হয়েছে ইথিওপিয়ার প্রধানমন্ত্রী আবি আহমেদ আলিকে। শান্তি ও আন্তর্জাতিক সংহতির জন্য তাঁর প্রয়াস এবং প্রতিবেশী এরিট্রিয়া দেশের সঙ্গে সীমান্ত সংঘর্ষ সমাধানে তাঁর উদ্যোগের জন্য এই পুরস্কার দেওয়া হয়েছে তাঁকে। এরিট্রিয়ার সঙ্গে ইথিওপিয়ার সংঘর্ষ কী নিয়ে এবং সে ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী আবি আহমেদ কী করেছিলেন?
২০ বছরের যুদ্ধ শেষ করেছিল যে আলিঙ্গন
২০১৮ সালের জুলাই মাসে ইথিওপিয়ার প্রেসিডেন্ট আবি আহমেদ জনসংখ্যার দিক থেকে আফ্রিকার দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশের প্রধানমন্ত্রী হন। তিন মাস আগে তিনি সীমান্ত পেরিয়ে প্রতিবেশী দেশ এরিট্রিয়ায় যান।
এরিট্রিয়ার রাজধানী আসমারায় গিয়ে তিনি সে দেশের প্রেসিডেন্ট ইসায়াস আফওয়েরকিকে দৃঢ় ও উষ্ণ আলিঙ্গন করেন এবং বিশ্বের কাছে ঘোষণা করেন আফ্রিকার দরিদ্রতম দুই দেশ যারা ২০ বছর ধরে যুদ্ধ চালিয়ে এসেছে, যার ফলে অন্তত ৮০ হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটেছে, সে যুদ্ধ পরিসমাপ্ত হল।
আরও পড়ুন, বিশ্লেষণ: সাহিত্যে নোবেল, গত বছরের কেলেংকারি এবং এ বছরের বিজয়ীরা
প্রধানমন্ত্রী আবি আহমেদ এবং প্রেসিডেন্ট আফওয়েরকি ঘোষণা করেন, দু দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক, কূটনৈতিক এবং পর্যটন সম্পর্ক ফের চালু হবে। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সৌদি আরবের জেড্ডায় দু দেশের মধ্যে দ্বিতীয় চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
শুক্রবার নোবেল কর্তৃপক্ষ দু দেশের মধ্যেকার দীর্ঘদিনে শান্তি নয় - যুদ্ধ নয় সূচক অচলাবস্থার পরিসমাপ্তি ঘটানোর জন্য প্রেসিডেন্ট আফওয়ের্কির ভূমিকাকেও স্বীকৃতি দিয়েছে। একই সঙ্গে নোবেল কমিটি বলেছে, এই পুরস্কার ইথিওপিয়া এবং উত্তর ও উত্তরপূর্ব আফ্রিকায় শান্তি ও সুস্থিতি ফেরানোর জন্য যাঁরা কাজ করছেন তাঁদেরও স্বীকৃতি দিচ্ছে।
ইথিওপিয়া-এরিট্রিয়া সংঘর্ষের ইতিহাস
১৯৯৩ সালে এরিট্রিয়া ইথিওপিয়ার ফেডারেশন থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হয়। এরিট্রিয়া হর্ন অফ আফ্রিকায় লোহিত সাগরের মুখে, বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জাহাজ চলাচলের পথের নিকটে অবস্থিত। এ দেশের স্বাধীনতা ছিল ইথিওপিয়ার বিরুদ্ধে এরিট্রিয়ার মুক্তিযোদ্ধাদের ৩০ বছরের সংগ্রামের ফলাফল।
এরিট্রিয়ার স্বাধীনতার পাঁচ বছর পর থেকে দু দেশ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে সীমান্তবর্তী গুরুত্বহীন শহর বাডমের দখল নিয়ে, যে শহর আদ্দিস আবাবা এবং আসমারা দু পক্ষের কাছেই ছিল ঈপ্সিত।
এ যুদ্ধে বহু মানুষ বাস্তুচ্যুত হন, পরিবার ভেঙে যায়, স্থানীয় বাণিজ্য অর্থনীতি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে পড়ে। এই সংঘর্ষে ব্যাপক শরণার্থী সংকট তৈরি হওয়ায় হাজার হাজার এরিট্রিয়াবাসী ইউরোপে পালিয়ে যান।
আরও পড়ুন, সানাউল হক: উত্তর প্রদেশের ছেলের আল কায়েদার উপমহাদেশীয় প্রধান হয়ে ওঠার কাহিনি
যুদ্ধ শেষ, অচলাবস্থা শুরু
২০০০ সালের জুন মাসে দু দেশ শত্রুতা নিবৃত্তির চুক্তি স্বাক্ষর করে। সে বছরের ডিসেম্বর মাসে আলজেরিয়ায় শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এর ফলে সরকারি ভাবে যুদ্ধের সমাপ্তি হয় এবং সমস্যা মেটানোর জন্য সীমান্ত কমিশন গঠিত হয়।
২০০২ সালের এপ্রিল মাসে কমিশন বাডমে-কে এরিট্রিয়ার অংশ বলে ঘোষণা করে।
কিন্তু ইথিওপিয়া অতিরিক্ত শর্ত ব্যাতিরেকে এ সিদ্ধান্ত মানতে অস্বীকার করে এবং শুরু হয় অচলাবস্থা। ইথিওপিয়া বাডমের নিয়ন্ত্রণ ছাড়তে অস্বীকার করলে সীমান্তে সংঘর্ষ শুরু হয়।
শান্তির পথে আবি আহমেদের প্রবেশ
২০১৭ সালে ইথিওপিয়ার ক্ষমতাসীন ইথিওপিয়ান পিপলস রেভলিউশনারি ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট (ইপিআরডিএফ) এরিট্রিয়ার সঙ্গে সম্পর্কে বদল ঘটানোর ইঙ্গিত দেয়।
২০১৮ সালের এপ্রিল মাসে আবি আহমেদ প্রধানমন্ত্রী হন। তিনি তখন ছিলেন ৪১ বছরের এক প্রাক্তন সেনা অফিসার, যিনি যুদ্ধে লড়েছিলেন। এরপর দ্রুততার সঙ্গে পরিস্থিতির বদল ঘটতে থাকে।
জুন মাসে প্রধানমন্ত্রী আবি আহমেদ প্রায় দু দশকের অচলাবস্থার অবসান ঘটিয়ে ঘোষণা করেন ২০০০ সালের চুক্তির সব শর্ত মেনে নিতে রাজি আদ্দিস আবাবা। ২০১৮ সালের ৮ জুলাই আসমারায় গিয়ে প্রেসিডেন্ট আফওয়ের্কির সঙ্গে সাক্ষাতের একদিন আগে তিনি ঘোষণা করেন, "এরিট্রিয়া এবং ইথিওপিয়ার মধ্যে আর কোনও সীমান্ত নেই, ভালবাসার সেতু সীমান্ত ধ্বংস করে দিয়েছে।"
আরও পড়ুন, জম্মু কাশ্মীরের যে অংশগুলি পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণে
শান্তির প্রেক্ষিত
এরিট্রিয়ার সঙ্গে বছরের পর বছর যুদ্ধের কারণে এডেন উপসাগর এবং আরব সাগরের দিকে যাবার জন্য ইথিওপিয়াকে ব্যাপকভাবে নির্ভর করতে হচ্ছিল বাব আল-মানদাব প্রণালীর উপর অবস্থিত জিবৌতির উপর।
এরিট্রিয়ার সঙ্গে শান্তি চুক্তির ফলে এরিট্রিয়ার বন্দর ইথিওপিয়ার জন্য উন্মুক্ত হয়ে যায়।
শান্তি চাইছিল এরিট্রিয়াও
১৯৯৩ সালে দেশের স্বাধীনতার সময় থেকেই ইথিওপিয়ার সঙ্গে যুদ্ধকে কাজে লাগিয়ে ক্ষমতা ধরে রাখছিলেন প্রেসিডেন্ট আফওয়ের্কি। গত দু দশকের বেশি সময় ধরে এরিট্রিয়া ব্যাপক আর্থিক অচলাবস্থার মধ্যে ডুবে থাকা সত্ত্বেও এবং সামাজিক ও কূটনৈতিকভাবে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়লেও তিনি বিশাল সেনাবাহিনী নির্মাণ ও রক্ষণ করে চলেছিলেন, সংবিধান লাগু করেননি এবং সংবাদমাধ্যমের মুখ বন্ধ করে রেখেছিলেন। এসবই তিনি চালাচ্ছিলেন "এরিট্রিয় ভূখণ্ডে ইথিওপিয়ার ক্রমাগত দখলদারির বিরুদ্ধে" যুদ্ধে।
রাষ্ট্রসংঘের মানবাধিকার কমিশন বারবার এরিট্রিয়ার বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ এনেছে। ২০১৫-১৬ নাগাদ এরিট্রিয়ার অধিবাসীরা যুদ্ধ থেকে পালানোয় শরণার্থী সংকট চরমে ওঠে। সে সময় থেকেই সরকারের উপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়তে থাকে।
Read the Full Story in English