নয়া নাগরিকত্ব আইন এবং প্রস্তাবিত জাতীয় নাগরিকপঞ্জীর জেরে ছোট বড় শহরের রাস্তায় হাজারে হাজারে বিক্ষোভকারীরা জমায়েত হচ্ছেন। এর ফলে ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক মন্দা ও চাকরিহীনতার বিষয়টি ক্রমশ চাপা পড়ে যাচ্ছে শুধু নয়, এই বিক্ষোভ মেরুকরণকেও স্পষ্ট করছে।
২০২০-র রাজনৈতিক দৃশ্যপট সরকারি নীতি নিয়ে মানুষের বিক্ষোভকে প্রতিফলিত করতে চলেছে- তা সে বিজেপির হিন্দুত্ববাদকে সংহত করাই হোক অথবা এই রাজত্বের বিরুদ্ধে নাগরিক সমাজের ক্রমবর্ধমান চাপই হোক, কিংবা আর্থিক ক্ষেত্রে সরকারের ব্যর্থতা ও নিষ্ফলা প্রতিশ্রুতিই হোক।
সরকারের বিরুদ্ধে জাতীয় পতাকা হাতে নিয়ে যেভাবে সমস্ত জাত ও সম্প্রদায়ের মানুষ দিকে দিকে রাস্তায় নেমেছেন, সংবিধান পাঠ করছেন, তাতে সংখ্যালঘু মুসলিমরা আশ্বস্ত হতে পারেন যে তাঁরা সমাজে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন নন। বিজেপি এ বিক্ষোভগুলিকে পাত্তা না দিলেও এবং সবটাই বিরোধীদের কারসাজি বলে উড়িয়ে দিতে চাইলেও, দলীয় নেতৃত্বের একাংশ বিশ্বাস করেন, এনআরসি নিয়ে বেশি চাপাচাপি করলে বিরোধীরা তা কাজে লাগিয়ে নাগরিকদের মধ্যে ক্রোধের সঞ্চার ঘটাতে পারবেন।
নয়া নাগরিকত্ব আইন ও এনআরসি নিয়ে নোবেলজয়ী অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় ও এস্থার ডাফলোর লেখা
লোকসভা ভোটোত্তর ব্যাপক জয়োল্লাসের পর ২০১৯ সালের শেষটায় ঝাড়খণ্ডে হার বিজেপির কাছে কিছুটা নৈরাশ্য নিয়ে এসেছে। ২০২০ সালের শুরুর দিকেই দিল্লির ভোট। নয়া নাগরিকত্ব আইন লাগু করবার পর মেরুকরণের রাজনীতির নতুন পরীক্ষা বিজেপির সামনে। আইন লাগু হবার পর দিল্লির বিজেপি নেতারা আশাবাদী হয়ে উঠেছেন।
দিল্লিতে ফেব্রুয়ারি মাসে ভোট, তার পর অক্টোবরে ভোট বিহারে। কেন্দ্রে ২০১৪ ও ২০১৯ সালে বিজেপি জয়ী হলেও, বিজেপি ২০১৫ সালে বিহারে হেরেছে, ২০১৭ সালে পাঞ্জাবে, ২০১৮ সালে রাজস্থান, মধ্য প্রদেশ ও ছত্তিসগড়ে এবং ২০১৯ সালে ঝাড়খণ্ডে পরাজয় ঘটেছে তাদের। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে নরেন্দ্র মোদীকে প্রধানমন্ত্রী বানানোর ইস্যু না থাকলে রাজ্যগুলিতে বিজেপির হাল তত ভাল নয়। ২০১৭ সালে গুজরাটে ও ২০১৯ সালে হরিয়ানা ও মহারাষ্ট্রে বিজেপির পারফরম্যান্স প্রত্যাশার অনেক নিচে। মোদীর জনপ্রিয়তার সঙ্গে তাল মেলানোর মত রাজ্য নেতৃত্ব গঠন ২০২০ সালে বিজেপির প্রাথমিক কর্তব্য হবে।
এই সন্ধিক্ষণে, দলের মধ্যেকার গতিপ্রকৃতিতে বদল তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। অমিত শাহের জায়গায় বিজেপির জাতীয় সভাপতি হতে পারেন জেপি নাড্ডা। তাঁর কাছে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠবে বিজেপির পরিচিতি রক্ষা ও ভোটজয়ী মেশিন হিসেবে দলেরক্ষমতা ধরে রাখা। এখন দলে মোদী-শাহের ক্ষমতা অবিসংবাদী- নাড্ডা আরেকটি ক্ষমতাকেন্দ্র হয়ে উঠবেন কিনা, রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা সে দিকে খেয়াল রাখবেন।
অন্যদিকে রয়েছে কংগ্রেস, যারা আকারে ছোট হচ্ছে, কিন্তু বিজেপি যাদের উপর নিরবচ্ছিন্ন আক্রমণ চালিয়েই যাচ্ছে। এসব সত্ত্বেও হরিয়ানা দারুণ ফলকরে, মহারাষ্ট্রে বিজেপিকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে রেখে এবং ঝাড়খণ্ডে জেএমএমের সঙ্গে জোট করে জেতার পর তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা বেড়েছে।
দিল্লিতে কংগ্রেসের কাজ কঠিন। তাদের লক্ষ্য হবে আম আদমি পার্টির ভোটব্যাঙ্ক, যে আম আদমি পার্টি সরকারে থাকাকালীন যথেষ্ট কাজ করেছে। বিহারে, কংগ্রেস আদৌ কোনও শক্তিই নয়, তারা চাইবে আরজেডির উপর ভর করে উঠে দাঁড়াতে। এনআরসি নিয়ে নীতীশ কুমারের বিরোধিতা এবং তাঁর রাজনৈতিক নমনীয়তার রেকর্ডের কথা স্মরণে রাখলে রাজনৈতিক শক্তির সম্ভাব্য পুনর্বিন্যাস নিয়েও আলোচনা শুরু হতে পারে।
দলের উচ্চতম পর্যায়ে সংশয় অবশ্য কাটেনি। সোনিয়া গান্ধী যে কঠিন পরিস্থিতিতে দলের দায়িত্ব নিয়েছিলেন, সেটা ছিল একটা অন্তর্বর্তী ব্যবস্থা। কিন্তু নেতৃত্বের বিষয়টির সুরাহা এখনও হয়নি। রাহুল গান্ধীর অনিচ্ছা এখনও বর্তমান, অন্যদিকে গান্ধী পরিবারের বাইরে থেকে কারও দলীয় সভাপতি হবার সম্ভাবনা অত্যন্ত কম।
এরপর আসে ভারতের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলির ভবিষ্যৎ সম্পর্কিত প্রশ্ন। বেশ কিছু সরকারি প্রতিষ্ঠান ও দফতরের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। নতুন বছরেও সেগুলি জনগণ ও নাগরিক সমাজের নজরের আওতাতেই থাকবে।
সুপ্রিম কোর্টে জম্মু কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা হানি ও নয়া নাগরিকত্ব আইন চ্যালেঞ্জ করে আবেদনের শুনানি হবে, শুনানি হবে আরও গুরুত্বপূর্ণ কিছু ইস্যুরও। শীর্ষ আদালতকে সংবিধানের অভিভাবক হিসেবে ভূমিকা স্থির করতে হবে, সে ভূমিকা প্রদর্শন করতে হবে। প্রজাতন্ত্রের ভিত্তি য়ে নীতিসমূহ তার জামিদারের ভূমিকাও পালন করতে হবে সুপ্রিম কোর্টকে। একই সঙ্গে এ পরীক্ষা উচ্চতর বিচারবিভাগের স্বাধীনতার রক্ষাকবচ হবারও।
সহ বিশ্লেষক- মনোজ সিজি এবং অনন্তকৃষ্ণণ জি