ভারতের প্রাক্তন সেনাপ্রধান জেনারেল স্যাম মানেকশ। দেশের এই প্রথম ফিল্ড মার্শাল পরিচিত ছিলেন স্যাম বাহাদুর নামেও। তাঁর জীবনের ওপর একটি বায়োপিক তৈরি হয়েছে। যা, ১ ডিসেম্বর মুক্তি পাবে। মানেকশ ছিলেন একজন সত্যিকারের কিংবদন্তি।
স্যাম মানেকশ পঞ্জাবি ভাষায় সাবলীল ছিলেন
মানেকশ জাতে ছিলেন পার্সি। জন্মেছিলেন অমৃতসরে। নৈনিতালের শেরউড কলেজে লেখাপড়া। সেখানে বেড়ে ওঠা। পঞ্জাবিতে ছিলেন সাবলীল। শিখ সৈন্যদের সঙ্গে পঞ্জাবিতে কথা বলতেন। চাকরির প্রাথমিক বছরগুলোয় তিনি শিখ ব্যাটালিয়নে যুক্ত ছিলেন। সেনাবাহিনীতে কান পাতলে শোনা যায়, তাঁর পুরনো ফ্রন্টিয়ার ফোর্স ব্যাটালিয়নের অনেক সহযোদ্ধা হামেশাই স্যামের কাছে সাহায্য চাইতেন। স্যামও অনায়াসে তাঁদের সাহায্য করতেন।
স্যামের নামে জুড়েছিল 'বাহাদুর'
স্যামের নামের সঙ্গে 'বাহাদুর' শব্দটা জুড়ে গিয়েছিল। যদিও তাঁর নামের সঙ্গে বাহাদুর শব্দটা ছিল না। কিন্তু, তিনি পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন স্যাম বাহাদুর নামে। তাঁকে এই 'বাহাদুর' উপাধি দিয়েছিলেন 8 গোর্খা রাইফেলসের জওয়ানরা। সাম মানেকশ ছিলেন গোর্খা রেজিমেন্টের কর্নেল। স্যামকে ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্টের একটি ব্যাটালিয়নে অফিসার হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। সেই ব্যাটেলিয়নে প্রধানত শিখ সেনারাই ছিলেন। সাম বাহাদুর এই রেজিমেন্টে কোম্পানি কমান্ডার পর্যন্ত হয়েছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তিনি বার্মায় আহত হন।
দেশভাগের পর রেজিমেন্ট পাকিস্তানে
দেশভাগের পর, তাঁর রেজিমেন্ট চলে যায় পাকিস্তানে। এরপর কিছু সময়ের জন্য, স্যামকে ১৬তম পঞ্জাব রেজিমেন্টে দায়িত্ব দেওয়া হয়। পরে, লেফটেন্যান্ট কর্নেল হিসেবে তাঁকে ৫ম গোর্খা রাইফেলসের তৃতীয় ব্যাটালিয়নের কমান্ডের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনি ১৯৪৮-৪৯ সালের কাশ্মীর যুদ্ধে সেনা সদর দফতরে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছিলেন। ১৯৫৩ সালে স্যাম মানেকশ চতুর্থ গোর্খা রাইফেলসের কর্নেল পদে দায়িত্ব পান।
চিন যুদ্ধের আগে তদন্ত
চিনের সঙ্গে ১৯৬২ সালের যুদ্ধের আগে স্যাম বাহাদুরের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়। তাঁর বিরুদ্ধে মিথ্যে অভিযোগ আনা হয়েছিল। সেই সময় স্যাম, মেজর জেনারেল পদে ওয়েলিংটনের ডিফেন্স সার্ভিসেস স্টাফ কলেজের কমান্ড্যান্ট পদে কর্মরত ছিলেন। অনেকেরই ধারণা, এইসব অভিযোগগুলো তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী ভিকে কৃষ্ণ মেনন এবং তৎকালীন রাজনৈতিক নেতাদের ঘনিষ্ঠ কয়েকজন জেনারেলের নির্দেশেই উসকে তোলা হয়েছিল। তৎকালীন জিওসি-ইন-সি ওয়েস্টার্ন কমান্ড লেফটেন্যান্ট জেনারেল দৌলত সিং তদন্তে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। বিভিন্ন সেনা অফিসার সেই তদন্তে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন। তাঁদের বেশিরভাগই স্যামের পক্ষে কথা বলেছিলেন। কেউ কেউ আবার বিপক্ষেও সাক্ষ্য দেন। শেষ অবধি লেফটেন্যান্ট জেনারেল দৌলত সিং সমস্ত অভিযোগ থেকে স্যামকে মুক্তি দেন। তাঁর কৃতিত্বের জন্য, স্যাম যখন সেনাবাহিনীতে উচ্চপদে আসীন হন, তখন কিন্তু তিনি তাঁর বিরুদ্ধে কথা বলা অফিসারদের বিরুদ্ধে কোন প্রতিহিংসা চরিতার্থ করেননি। ঘটনাচক্রে স্যাম বাহাদুর, ১৯৬৩-র ডিসেম্বরে জিওসি-ইন-সি ওয়েস্টার্ন কমান্ড পদে লেফটেন্যান্ট জেনারেল দৌলত সিংয়ের স্থলাভিষিক্ত হন। কারণ, ১৯৬৩-র নভেম্বরে, লেফটেন্যান্ট জেনারেল দৌলত সিং পুঞ্চে একটি বিমান দুর্ঘটনায় মারা যান।
নেহরুর মৃত্যুর পর দিল্লিতে সৈন্য
প্রধানমন্ত্রী নেহরুর মৃত্যুর পর দিল্লিতে সৈন্য পাঠানো হয়েছিল। সেজন্য স্যাম বাহাদুরকে দায়ী করেন অনেকে। স্যাম মানেকশ ১৯৬৩ সালের ডিসেম্বরে জিওসি-ইন-সি ওয়েস্টার্ন কমান্ডের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। নেহেরুর মৃত্যুর কিছুক্ষণ আগে, তাঁর মৃত্যুর ঘটনায় দেশের রাজধানীতে অস্থিরতার পূর্বাভাস পেয়ে তৎকালীন সেনাপ্রধান রাজধানীতে কিছু সৈন্য মোতায়েনের পরিকল্পনা করেছিলেন। সে অনুযায়ী স্যামকে ৪ পদাতিক ডিভিশন থেকে সৈন্য মোতায়েনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। নেহরুর মৃত্যুর পরপরই অম্বালায় এবং আগ্রায় ৫০ প্যারাসুট ব্রিগেডের জওয়ানদের মোতায়েন করা হয়। স্যাম লিখিতভাবে এই আদেশের প্রতিবাদ করেছিলেন। কিন্তু, সেনাপ্রধানের নির্দেশ ছিল বলে সেই সব নির্দেশ মেনে চলেন। নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর সেনাপ্রধানের কাছে সেনা মোতায়েনের কারণ জানতে চায়। স্যাম সম্পর্কে তাঁর প্রাক্তন এডিসি, মেজর জেনারেল এসডি সুদের লেখা একটি বই অনুযায়ী, যাবতীয় দোষ স্যামের ওপরই চাপানো হয়েছিল। যার জেরে তাঁকে শেষ পর্যন্ত জিওসি-ইন-সি ইস্টার্ন কমান্ড পদে বদলি করা হয়।
আরও পড়ুন- পান্নুকে হত্যার ষড়যন্ত্র! চক্রান্তে যুক্ত ভারতীয়? তোলপাড় ফেলা অভিযোগ আমেরিকার, মামলা শুরু
স্যাম একজন বন্দি পাকসেনাকে কোরান দিয়েছিলেন
১৯৭১ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পরে, স্যাম মানেকশ জেলবন্দি প্রায় ৯০ হাজার পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দির (PoWs) সঙ্গে কেমন আচরণ করা হচ্ছে, সে ব্যাপারে নজর রেখেছিলেন। তিনি হামেশাই পাক সেনাদের পরিস্থিতি সরেজমিনে খতিয়ে দেখতেন। দিল্লি ক্যান্টনমেন্টের সামরিক হাসপাতাল পরিদর্শনের সময় তিনি চিকিৎসাধীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন কর্নেলের সঙ্গেও দেখা করেন। তাঁর কিছু দরকার কি না জানতে চাইলে কর্নেল, স্যামকে একটি কোরানের জন্য অনুরোধ করেছিলেন। স্যাম তাঁর এডিসিকে অবিলম্বে সেই অনুরোধ রাখার নির্দেশ দেন। সেই সন্ধ্যায় রাজপুতানা রাইফেলস ব্যাটালিয়ন থেকে একটি কোরান সংগ্রহ করা হয়। তা সরবরাহ করা হয়েছিল পাকিস্তানের সেনা অফিসারকে।