গত সপ্তাহে ইজরায়েলের ওপর হামলা শুধু হামাসকেই নয়। প্যালেস্তাইনের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ দল যেমন ফাতাহ, প্যালেস্তাইন ইসলামিক জিহাদ (পিআইজে), প্যালেস্তাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও) এবং প্যালেস্তাইন অথরিটি (পিএ)-কেও প্রচারের আলোয় এনেছে। এখানে এই সব দলের প্রতিটির ইতিহাস, উদ্দেশ্য এবং ইজরায়েল-প্যালেস্তাইন সংঘাতে ভূমিকা তুলে ধরা হল।
ফাতাহ
ফাতাহ- শব্দের অর্থ জয় করা। ১৯৪৮ সালের ইজরায়েল-আরব যুদ্ধের সময় ৭০,০০০ এরও বেশি প্যালেস্তিনীয় আরবদের বাস্তুচ্যুত এবং ক্ষমতাচ্যুত করার পরে ১৯৫০-এর দশকের শেষের দিকে কুয়েত গঠিত হয়েছিল। ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদী সংগঠন ফাতাহর মূল প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ইয়াসির আরাফাত। তিনি প্যালেস্তাইন কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। প্যালেস্তাইন কর্তৃপক্ষের বর্তমান প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস তাঁরই সহযোগী।
ফাতাহর উদ্দেশ্য শুরু থেকেই ছিল পরিষ্কার: প্যালেস্তাইনকে মুক্ত করার জন্য ইজরায়েলের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম। এর সামরিক অভিযান ১৯৬৫ সালে শুরু হয়েছিল এবং তাদের বেশিরভাগ জর্ডন এবং লেবানন থেকে পরিচালিত হয়েছিল। তিন বছর পরে, সংগঠনটি প্যালেস্তাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও)-এর অংশ হয়ে ওঠে। অসংখ্য আরব গোষ্ঠীর একটি ছাতা রাজনৈতিক সংগঠন এই পিএলও। যার লক্ষ্য ছিল সশস্ত্র প্রতিরোধের মাধ্যমে প্যালেস্তাইনকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা অর্জনে সহায়তা করা।
১৯৭০-এর দশকে জর্ডন এবং লেবানন উভয়ই তাদের অঞ্চল থেকে ফাতাহর সামরিক শাখাকে সরিয়ে দেওয়ার পরে ফাতাহের সশস্ত্র সংগ্রাম শীঘ্রই শেষ হয়ে যায়। আল জাজিরার একটি প্রতিবেদন অনুসারে সংগঠনটির রূপান্তর ঘটে। তারা ইজরায়েলের সঙ্গে আলোচনা শুরু করে। ১৯৯০-এর দশকে, ফাতাহ-নেতৃত্বাধীন পিএলও আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করে যে তারা তাদের সশস্ত্র প্রতিরোধের রাস্তায় আর ঢুকবে না।
পরে অসলো চুক্তিতে স্বাক্ষরও করে। যা প্যালেস্তাইন ন্যাশনাল অথরিটি (পিএনএ) বা প্যালেস্তাইন অথরিটি (পিএ) প্রতিষ্ঠা করে। একটি অন্তর্বর্তী স্বশাসিত সংস্থা এই পিএ। বর্তমানে, ফাতাহ পিএ-র প্রধান। এটি অধিকৃত পশ্চিম তীরের প্রায় ৪০% শাসন করে। ২০০৬ সালে, প্যালেস্তাইনি আইন পরিষদের (পিএলসি) গণতান্ত্রিক নির্বাচনে প্যালেস্তাইনের জঙ্গিগোষ্ঠী হামাসের রাজনৈতিক শাখার কাছে হেরে যাওয়ার পর ফাতাহ গাজা স্ট্রিপের নিয়ন্ত্রণ হারায়।
হামাস
হামাস প্যালেস্তাইনের আরেকটি প্রধান রাজনৈতিক দল। কিন্তু, এই দল ইজরায়েলের বিরুদ্ধে বর্তমান সশস্ত্র সংগ্রামের জন্যই বেশি পরিচিত। ১৯৮০-এর দশকের শেষের দিকে, পশ্চিম তীর এবং গাজা উপত্যকায় ইজরায়েলের দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে প্রথম প্যালেস্তাইনি 'ইন্তিফাদা' বা বিদ্রোহ শুরু হওয়ার পরে হামাস গোষ্ঠীটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ইহুদি রাষ্ট্র ইজরায়েল ১৯৬৭ সালের ইজরায়েল-আরব যুদ্ধে জয়লাভের পর পশ্চিম তীর এবং গাজা উপত্যকা- এই দুটি প্যালস্তাইনি অঞ্চল দখল করেছিল।
ফাতাহর মতো, হামাসও ১৯৬৭ সালে স্থির হওয়া সীমান্তে একটি প্যালেস্তাইনি রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্য নিয়েছে। ২০১৭ সালের একটি নতুন রাজনৈতিক দলিল প্রকাশ করে হামাস তার লক্ষ্যকে যুগোপযুগী করেছে। তবে, ফাতাহর মত হামাস ইজরায়েলের রাষ্ট্রত্বকে স্বীকৃতি দেয়নি। জঙ্গি সংগঠনটি ২০০৬ সাল থেকে ২০ লক্ষেরও বেশি লোক নিয়ে গঠিত গাজা উপত্যকা শাসন করছে।
প্যালেস্তাইনি ইসলামিক জিহাদ (পিআইজে)
পিআইজে হল প্যালেস্তাইনের দ্বিতীয় বৃহত্তম জঙ্গি গোষ্ঠী। যার লক্ষ্য ইজরায়েলকে ধ্বংস করা এবং তার জায়গায় একটি সম্পূর্ণ ইসলামি প্যালেস্তাইন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। এজন্য তারা শক্তি এবং সামরিক উপায় ব্যবহার করে। এটি ১৯৮১ সালে মিশরের মুসলিম ব্রাদারহুডের সদস্যরা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মিডিয়া রিপোর্ট অনুযায়ী, এই জঙ্গিগোষ্ঠীটি ইরানের দ্বারা আর্থিকভাবে সমর্থিত (শিয়া সম্প্রদায়ের রাষ্ট্র ইরান হামাসকে অর্থ দেয় বলেও অভিযোগ উঠেছে। পিআইজের সঙ্গে ইরানের দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্ক রয়েছে। পিআইজে ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লব থেকে অনুপ্রেরণা নিয়েছিল বলে জানা গিয়েছে।
হামাস এবং পিআইজে মিত্র হলেও উভয় গ্রুপেরই আলাদা পরিচয় ও কিছু পার্থক্য আছে। সংবাদপত্র হারেৎজের রিপোর্ট জানিয়েছে, 'পিআইজে একটি ছোট, উচ্চমানের, সশস্ত্র সংগ্রামে নিবেদিতপ্রাণ গোপন জঙ্গিগোষ্ঠী। আর, হামাস অনেক বড়, সাম্প্রদায়িক সংগঠন যা গাজায় সম্পূর্ণ সরকারি ব্যবস্থাও চালায়।' যদিও পিআইজে রাজনীতি থেকে বরাবর দূরেই থেকেছে। কিন্তু, এটি দীর্ঘকাল ধরে ছাত্র রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেছে। ১৯৮০-এর দশক থেকে প্যালেস্তাইনের বিশ্ববিদ্যালয় নির্বাচনে প্রার্থী দিয়েছে। আবার ১৯৯৬ সালে প্যালেস্তাইনের আইনসভা নির্বাচনেও অংশ নিয়েছিল।
প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও)
১৯৬৪ সালে মিশরের কায়রোতে আরব লিগের শীর্ষ সম্মেলনে পিএলও-র ধারণার জন্ম হয়েছিল। যার একমাত্র লক্ষ্য ছিল, সশস্ত্র সংগ্রামের সাহায্যে প্যালেস্তাইনকে মুক্ত করা। সংগঠনটি মূলত ছোট আরব গোষ্ঠীগুলির একটি জোট (হামাস এবং ইসলামিক জিহাদ ব্যতীত)। যার মধ্যে ফাতাহ বেশ প্রভাবশালী। ফাতাহ এর প্রতিষ্ঠাতা ইয়াসির আরাফাত ১৯৬৯ সালে পিএলওর চেয়ারম্যান হন এবং ২০০৪ সালে তাঁর মৃত্যুর আগে পর্যন্ত ওই পদে বহাল ছিলেন। মাহমুদ আব্বাস, যিনি এখনও সংগঠনের প্রধান, তিনি আরাফাতের সাহায্যেই স্থলাভিষিক্ত হন।
পিএলও ১৯৯০-এর দশকে তার সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার সময়, আনুষ্ঠানিকভাবে আরব লিগ এবং রাষ্ট্রসংঘের সাধারণ পরিষদের মাধ্যমে 'প্যালেস্তিনীয় জনগণের একমাত্র বৈধ প্রতিনিধি' হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিল। শুধু তাই নয়, পর্যবেক্ষকের মর্যাদায় রাষ্ট্র সংঘের সমস্ত কার্যক্রমে অংশগ্রহণের জন্য আমন্ত্রিত হয়েছিল। ১৯৮৮ সালে, পিএলও ইজরায়েলের সঙ্গে বিরোধের জন্য একটি দ্বিপাক্ষিক সমাধানসূত্রকে সমর্থন করেছিল বলেই জানিয়েছে, জার্মানির বার্লিনে অবস্থিত থিংক ট্যাংক ইউরোপীয় কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনস।
১৯৯০-এর দশকের গোড়ার দিক পিএলও-র জন্য একটি বড় টার্নিং পয়েন্ট ছিল। সেই সময় এটি কেবল ইজরায়েলের বিরুদ্ধে তার সশস্ত্র সংগ্রামের পথই ছেড়ে দেয়নি। বরং, ইহুদি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রত্বকেও স্বীকৃতি দিয়েছিল। যা ছিল, প্যালেস্তাইনি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের জন্য একটি বিশাল ধাক্কা এবং এই ধাক্কাই জন্ম দেয় হামাসের। কাতারের নর্থ-ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির মিডল ইস্টার্ন স্টাডিজের অধ্যাপক খালেদ আল হারুব, আল জাজিরাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এমনটাই জানিয়েছে।
আরও পড়ুন- জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধও চেয়েছিলেন অহিংসার পূজারি, ইহুদিদের সম্পর্কে কী ভাবতেন মহাত্মা গান্ধী?
ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ (পিএ)
পিএ ১৯৯৪ সালের জুলাইয়ে ইজরায়েল-প্যালেস্তাইন সংঘাতে সম্মতিসূচক সমাধান না-হওয়া পর্যন্ত অসলো চুক্তির দ্বারা গাজা এবং পশ্চিম তীরের কিছু অংশে (পূর্ব জেরুজালেম ব্যতীত) অন্তর্বর্তী সংস্থা হিসেবে শাসনকার্য চালানোর জন্য গঠিত হয়েছিল। পিএ আসলে 'পিএলও'-এর একটি সংস্থা হিসেবে কাজ করে, যা আন্তর্জাতিক সংস্থায় প্যালেস্তাইনের প্রতিনিধিত্ব করে। এটি সরাসরি নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট দ্বারা পরিচালিত হয়। এই প্রেসিডেন্টের ভূমিকা হয় একজন প্রধানমন্ত্রীর মত। তিনি সরকারকে নিয়োগ করেন। এই সরকারের পিছনে অবশ্যই নির্বাচিত আইন পরিষদের সমর্থন থাকতে হয়। ২০০৬ সালে, হামাস পিএলও নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর গাজা উপত্যকা থেকে পিএ-র গভর্নিং বডিকে বহিষ্কার করে। তারপর থেকে জঙ্গি গোষ্ঠীটি গাজা অঞ্চলে নিয়ন্ত্রণ অব্যাহত রেখেছিল। বর্তমানে, পিএ পশ্চিম তীরের কিছু অংশ নিয়ন্ত্রণ করে। যার নেতৃত্বে আছেন মাহমুদ আব্বাস। তিনি পিএলও এবং ফাতাহ-রও প্রধান।