প্রফেট অফ নিউ ইন্ডিয়া, নব ভারতের অগ্রদূত। রাজা রামমোহন রায়। তাঁর জন্মের সার্ধদ্বিশত বর্ষপূর্তি-বিন্দুতে আমরা। কিন্তু যে নিউ ইন্ডিয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন রাজা, তা কি এখনও সূর্যোদয় দেখেছে? এই প্রশ্নের উদ্যত বর্শাফলকের সামনেই আমাদের তাঁর জীবন-চৈতন্য এনে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে আজও। ১৭৭২ সালে আজকের দিনে রামমোহন রায়ের জন্ম। হুগলি জেলার রাধানগরগ্রামে রায় রায়ান রামকান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের দ্বিতীয় পুত্র তিনি। ফুটফুটে ছেলে তাই নাম রামমোহন। রামকান্ত স্বপ্ন দেখলেন ছেলেকে মানুষের মতো মানুষ করে তুলবেন। পাঠালেন সেই পথের পাথেয় অর্জন করতে-- কাশীতে। রামমোহন সংস্কৃত শিখলেন সেখানে। দস্তুর মতো পণ্ডিত হয়েও উঠলেন। এবার পাটনায় পাঠানো হল তাঁকে। উদ্দেশ্য পার্সি-শিক্ষা। পার্সিতে এমন ব্যুৎপত্তি অর্জন করে ফেললেন যে, নাম হয়ে গেল, মৌলভি রামমোহন।
কিন্তু বিদ্যা কারও কারও ক্ষেত্রে শুধু পুঁথিগত শিক্ষা, বইয়ের পাঠ গলাধঃকরণ করা। আর কারও কারও বিদ্যা মস্তিষ্কে নব-রসায়নের জন্মের কারণ। যা তুলকালাম বাঁধিয়ে দেয় চার দিকে। নতুন চিন্তা, নতুন পথ মানেই সমাজের পুরনো বাড়িটার স্তম্ভগুলির পক্ষে বড্ড উদ্বেগের ব্যাপার, তাদের হাঁটু কাঁপিয়ে দেওয়ার কাণ্ড। হ্যাঁ, তেমনই রামমোহন ঘটালেন। বললেন, ঈশ্বর এক-- অদ্বিতীয়। মাটির দেবতা, পাথরের মূর্তি এসব পুজো করা মানে মিথ্যার আরাধনা, বিড়ম্বনা। হিন্দু হোক, মুসলমান, কিংবা খ্রিস্টান, যাঁরা ঈশ্বরকে নানা রূপে পুজো করেন, তাঁরা বেঠিক। বাবা রামকান্তের তো এ সব শুনে মাথায় ভেঙে পড়ল মহাকাশ। এ কী বলছে রে ছেলেটা! বোঝালেন তিনি বোঝালেন, বুঝিয়ে গেলেন, কিন্তু বোঝাতে পারলেন না। ছেলে তো তার্কবাগীশ, কে হারায় তাঁকে! রামকান্ত এবার নির্মম হয়ে উঠলেন। বিধর্মী, নাস্তিক, কুলাঙ্গার বলে চিৎকার করে উঠে বললেন, বেরোও...। তখন পনেরো-ষোল বছর বয়স রামমোহনের, কিন্তু তিনি এমনই নির্ভীক যে বাড়ি থেকে নির্দ্বিধায় বেরিয়ে গেলেন। সত্যের সন্ধানে সারা ভারতবর্ষকে দেখার অভিপ্রায় তখন তাঁর। দেখতে পেলেন সতীদাহের ভয়ঙ্কর চেহারাটা। নব্বই বছরের বুড়ো স্বামীর চিতায় ষোল বছরের স্ত্রীকে পুড়িয়ে মারার বর্বরতা।
নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর রামমোহন বইতে লিখেছেন, 'দিল্লির এক শেঠজি স্বর্গে গেছেন। শেঠজি কোটিপতি। ঘরে তাঁর চার-চারটি স্ত্রী। দলে দলে খিদমদগার, হুঁকোবরদার। যমুনার ধারে কয়েকশো মণ চন্দনকাঠ দিয়ে তৈরি করা হল আকাশ-ছোঁয়া চিতা। চিতায় শেঠজির সঙ্গে উঠলেন তাঁর চারটি স্ত্রী। কিন্তু অমন মানী লোকের স্বর্গে গিয়ে চারটি স্ত্রীতেই কেবল কুলোবে কেন? এত এব ঝি-চাকরকেও স্বর্গে যেতে হল তাঁর সঙ্গে। তামাক সাজবে কে-- পা টিপে দেবে কে-- হাওয়া করবে কে? সেইখানেই শেষ নয়। দুটো প্রকাণ্ড আরবি ঘোড়াকেও চিতায় চড়িয়ে দেওয়া হল। আবার ঘোড়া কেন? বা-রে নইলে শেঠজির মতো অমন দিকপাল লোক কিসে চড়ে স্বর্গের দেউড়িতে ঢুকবেন?... এমনই ছিল সে যুগের কুসংস্কার। আজ আমাদের হাসি পায়-- কিন্তু সে দিন রামমোহনের চোখ ফেটে জল এসেছিল। দুঃখে, লজ্জায়, ক্ষোভে।... এই ইতিহাস বদলাতে হবে। এই অজ্ঞানতার পাপকে মুছে দিতে হবে চিরকালের জন্য। হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টানকে এক মন্ত্রে মিলিয়ে দিয়ে সারা ভারতবর্ষে একটি মহাজাতিকে গড়ে তুলতে হবে। আর সেই মিলনমন্ত্র আসবে এই দেশের উপনিষদ থেকেই। সংস্কারের অজ্ঞতায় যা আমরা হারিয়েছি, তার পুনরুদ্ধার করবেন তিনি। সেই সংকল্প বুকে নিয়েই চার বছর পরে রামমোহন রায় দেশে ফিরলেন।' সংকল্পের পথে যাঁরা অগ্রবর্তী, তাঁদের থামায় কে, কার সাধ্য, এ যৌবনতরঙ্গ রুধিবে কে!
হ্যাঁ, এই নবতরঙ্গই রুখল সতীদাহ প্রথা।
ভারত-সংস্কৃতির কলঙ্ক ছিল যা। একটা হিসেব দেওয়া যেতে পারে সতীদাহের এ প্রসঙ্গে। ১৮১৫ সালে সতীদাহের সংখ্যা ২৫৩, ১৮১৬-তে ২৮৯, ১৮১৭ সালে ৪৪২ এবং ১৮১৮-তে সতীদাহের সংখ্যা বেড়ে হল ৫৪৪। তবে এই হিসেব হিমশৈলের চূড়ামাত্র। আসল সংখ্যা অনেক অনেক বেশি। তবে, এই সংখ্যা থেকে উত্তরোত্তর সতীদাহ বাড়ার ছবিটা স্পষ্ট। কয়েক বছরে যা প্রায় দ্বিগুণ। এবং এই বৃদ্ধি ইংরেজেরও বিড়ম্বনার কারণ হয়ে উঠেছিল। বিশেষ করে লাটসাহেব উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের এটা মানতে পারতেন না। তা ছাড়া 'ব্রিটেনের উদ্দেশ্যে সতীর ক্রন্দন' নামে একটি বই লিখেছিলেন জে পেগস নামে এক ইংরেজ। তাতে সতীদাহের ভয়ঙ্কর বর্ণনা পড়ে ইংরেজশাসকও শিহরিত হয়েছিল। সতীদাহের বিরুদ্ধে তো তত দিনে তুমুল সক্রিয় রামমোহন। বেন্টিঙ্কের আগে থেকেই চলছে সেই প্রক্রিয়া। কিন্তু বেন্টিঙ্ক সমর্থনের হাত রামমোহনের কাঁধে রাখতে সতীদাহের বিরুদ্ধে পদক্ষেপের পথ এগিয়ে গেল অনেকটা। লাটসাহেব ঠিক করে ফেললেন সতীদাহ তিনি রদ করবেন এ দেশে। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছেন, 'মৌচাকে যেন ঢিল পড়ল।
রক্ষণশীলদের কাগজ 'সমাচার চন্দ্রিকা' চিৎকার করে উঠল। হিন্দুদের ধর্ম গেল-- জাত গেল-- সর্বনাশ হল! বেন্টিঙ্ক যেন এমন অন্যায় কাজ কিছুই না করেন। ও দিকে দেশের লোকেরও একটু একটু করে ঘুম ভাঙছে। রামমোহনের দলেও লোকের অভাব হল না। 'সম্বাদ ভাস্করে'র সম্পাদক বিখ্যাত পণ্ডিত গৌরীশংকর তর্কবাগীশ রামমোহনকে পুরোপুরি সমর্থন জানালেন।
দেশে যেন ঝড উঠল। দু'দিকে ভাগ হয়ে গেল হিন্দু সমাজ। আর শেষ পর্যন্ত--
রামমোহনেরই জয় হল। ১৮২৯ সালের ৪ ডিসেম্বর সতীদাহ-প্রথা নিষিদ্ধ করে আইন পাস হয়ে গেল।'
রামমোহন রায়ের মৃত্যুর পর একশো বছর পেরলে 'ভারতপথিক রামমোহন রায়' নামে একটি প্রবন্ধ লেখেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, তার কথাগুলি যেন আজও ভীষণ সত্যি। আসুন, রবীন্দ্রনাথকে উদ্ধৃত করে লেখাটা শেষ করি: 'তাঁর মৃত্যুর পর আজ এক শত বৎসর অতীত হল। সেদিনকার অনেক কিছুই আজ পুরাতন হয়ে গেছে, কিন্তু রামমোহন রায় পুরাতত্ত্বের অস্পষ্টতায় আবৃত হয়ে যান নি।... বায়ুপোতে অত্যূর্ধ্ব আকাশে যখন ওঠা যায় তখন দৃষ্টিচক্র যত দূর প্রসারিত হয়, তার এক দিকে থাকে যে দেশকে বহু দূরে অতিক্রম করে এসেছি, আর-একদিকে থাকে সম্মুখে যা এখনও আছে বহু যোজন দূরে। রামমোহন যে কালে বিরাজ করেন সে কাল তেমনি অতীতে অনাগতে পরিব্যপ্ত, আমরা তাঁর সেই কালকে আজও উত্তীর্ণ হতে পারি নি।'
Read full story in English