জলবায়ু পরিবর্তন ভারতের সিন্ধু উপত্যকা এবং পাকিস্তানের ২২০ কোটি মানুষকে তীব্র গরমে পুড়তে বাধ্য করতে পারে। নতুন এক গবেষণায় এমনটাই জানা গিয়েছে। প্রসিডিংস অফ ন্যাশনাল একাডেমি অফ সায়েন্সেস (পিএনএএস) জার্নালে প্রকাশিত এই গবেষণায় দেখা গেছে যে যদি বিশ্বের তাপমাত্রা বর্তমান মাত্রার চেয়ে ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস (সি) বাড়ে বা বৃদ্ধি পায়, তবে প্রতিবছর কোটি কোটি মানুষ তাপ এবং আর্দ্রতার সংস্পর্শে আসবে। চরম তাপমাত্রায় তাঁরা প্রাকৃতিকভাবে নিজেদের ঠান্ডা করতে পারবেন না।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পেন স্টেট কলেজ অফ হেলথ অ্যান্ড হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট, পারডু ইউনিভার্সিটি কলেজ অফ সায়েন্সেস এবং পারডু ইনস্টিটিউট ফর এ সাসটেইনেবল ফিউচারের গবেষকরা দেখেছেন যে পৃথিবীর উষ্ণতা প্রাক-শিল্পায়ন স্তরের চেয়ে ১.৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বেশি। যা পৃথিবীজুড়ে মানব স্বাস্থ্যের ওপর বড় প্রভাব ফেলবে। মানুষের শরীরে তাপ-সম্পর্কিত স্বাস্থ্য সমস্যা যেমন হিট স্ট্রোক বা হার্ট অ্যাটাকের ঘটনা শুরু হওয়ার আগে মানুষ শুধুমাত্র তাপ এবং আর্দ্রতার কিছু সংমিশ্রণ সহ্য করতে পারে। যেহেতু জলবায়ু পরিবর্তন বিশ্বজুড়ে তাপমাত্রাকে উচ্চতর করেছে, ২২০ কোটি মানুষকে এই সীমার বাইরে থাকা তাপ সহ্য করতে হবে। যা, তাঁদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে পারে।
শিল্প বিপ্লব শুরু হওয়ার পর থেকে, যখন মানুষ মেশিন এবং কারখানায় জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়াতে শুরু করে, তখন সারা বিশ্বে তাপমাত্রা প্রায় ১ সেন্টিগ্রেড বেড়েছে। ২০১৫ সালে, ১৯৬টি দেশ প্যারিস চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। যার লক্ষ্য, বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছে গেছে। যা, প্রাক-শিল্পস্তরের ওপরে। গবেষকদের এই দলটি জানিয়েছে, বিশ্বের তাপমাত্রা বিভিন্ন জায়গায় ১.৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড থেকে ৪ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের মত বেড়েছে। এজন্য যেখানে উষ্ণতা বেশি বাড়ছে, গ্রহের এমন এলাকাগুলো শনাক্ত করার ওপর গবেষকরা জোর দিয়েছেন। যাতে উষ্ণতা সীমা অতিক্রম করতে না-পারে।
পেন স্টেটের অধ্যাপক এবং নতুন গবেষণার সহ-লেখক ডব্লিউ ল্যারি কেনি বলেছেন, 'জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বিশ্বের বাস্তব সমস্যাগুলি কীভাবে মানব স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করবে, তা বোঝার জন্য, আপনার গ্রহ এবং মানবদেহ উভয় বিষয়েই দক্ষতার প্রয়োজন।' পেন স্টেটের গবেষকরা গত বছর জানিয়েছেন, তরুণ ও সুস্থ মানুষের জন্য ওয়েট-বাল্ব তাপমাত্রার সীমা প্রায় ৩১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যাইহোক, তাপমাত্রা এবং আর্দ্রতা ছাড়াও, একটি নির্দিষ্ট মুহুর্তে যে কোনও ব্যক্তির পরিশ্রমের স্তর এবং বায়ুর গতি আর সৌর বিকিরণ-সহ অন্যান্য পরিবেশগত কারণ তাপমাত্রা কতটা হবে, তা স্থির করে দেয়।
মানব ইতিহাস গবেষকদের মতে, মধ্যপ্রাচ্য এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় তাপমাত্রা এবং আর্দ্রতা, যা মানুষের সীমা অতিক্রম করে তা শুধুমাত্র সীমিত সংখ্যক বার নথিবদ্ধ করা হয়েছে। গবেষণায় জানা গিয়েছে, শুধুমাত্র কয়েক ঘন্টার জন্য যদি বিশ্বের তাপমাত্রা প্রাক-শিল্পস্তরের চেয়ে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়ে, তবে পাকিস্তান এবং ভারতের সিন্ধু নদী উপত্যকার ২২০ কোটি বাসিন্দা, পূর্ব চিনে বসবাসকারী ১০০ কোটি মানুষ এবং সাব-সাহারান আফ্রিকার ৮ কোটি বাসিন্দা বার্ষিক অনেক ঘণ্টা তাপ অনুভব করবে, যা মানুষের সহনশীলতাকেও ছাড়িয়ে যাবে।
এই অঞ্চলগুলি প্রাথমিকভাবে উচ্চ-আর্দ্রতা তাপপ্রবাহ অনুভব করবে। উচ্চ আর্দ্রতা সহ তাপতরঙ্গগুলি আরও বিপজ্জনক হতে পারে, কারণ বায়ু অতিরিক্ত আর্দ্রতা শোষণ করতে পারে না। গবেষকরা বলেছেন যে যারা এই তাপমাত্রা বৃদ্ধির সমস্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তারা হল নিম্ন থেকে মধ্যম আয়ের দেশগুলো। যাদের অনেকেরই শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ বা তাপের নেতিবাচক স্বাস্থ্যের প্রভাব প্রশমিত করার কোনও কার্যকর উপায় না-ও থাকতে পারে। যদি গ্রহের উষ্ণতা প্রাক-শিল্প স্তরের ওপরে ৩ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বেড়ে যায়, তবে তাপ এবং আর্দ্রতার মাত্রা মানুষের সহনশীলতাকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে। যা পূর্ব সমুদ্র তীর এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মাঝখানে- ফ্লোরিডা থেকে নিউ ইয়র্ক এবং হিউস্টন অঞ্চলকে পর্যন্ত প্রভাবিত করবে। এমনকী শিকাগো, দক্ষিণ আমেরিকা আর অস্ট্রেলিয়াও উষ্ণতার সেই স্তরে চরম তাপ অনুভব করবে।
গরমের বর্তমান স্তরে, গবেষকরা বলেছেন যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আরও তাপপ্রবাহ বাড়তে পারে। তবে এই তাপপ্রবাহগুলো বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের মত সহ্যের সীমা অতিক্রম করবে বলে পূর্বাভাসে জানানো হয়নি। তবুও, গত গ্রীষ্মে লন্ডনের তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছেছিল। এমনটাই জানিয়েছেন বায়োক্লাইমাটোলজিস্ট আর পেন স্টেটে পোস্ট ডক্টরাল ফেলোশিপের সঙ্গে যুক্ত গবেষণাপত্রের প্রধান লেখক ড্যানিয়েল ভেসেলিও। তিনি বলেন, 'মনে রাখবেন, যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই উষ্ণায়নের সবচেয়ে খারাপ প্রত্যক্ষ প্রভাব থেকে রক্ষা পাবে। কিন্তু, আমরা আরও ঘন ঘন মারাত্মক এবং অসহনীয় তাপ দেখতে পাব। যদি তাপমাত্রা বাড়তে থাকে, তবে আমরা এমন একটি বিশ্বে বাস করব যেখানে ফসল ফলবে না। লক্ষ লক্ষ মানুষ স্থানান্তরিত হবে। কারণ, তাদের স্থানীয় অঞ্চলগুলি বসবাসের অযোগ্য হয়ে যাবে।'