২০১৯ সালের আলফ্রেড নোবেল স্মরণে অর্থনৈতিক বিজ্ঞানের পুরস্কার যৌথভাবে পেয়েছেন অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, এস্থার ডাফলো এবং মাইকেল ক্রেমার। দুনিয়া জোড়া দারিদ্র্য দূরীকরণের জন্য তাঁদের পরীক্ষামূলক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে এই পুরস্কার পেয়েছেন তাঁরা। এ পুরস্কারের অর্থমূল্য ৯ মিলিয়ন সুইডিশ ক্রোনা (ভারতীয় মুদ্রায় সাড়ে ৬ কোটি টাকা)। তিনজনের মধ্যে এই পুরস্কার অর্থ বণ্টন করে দেওয়া হবে।
এই যথেষ্ট পরিমাণ অর্থ দিয়ে কী করবেন সে প্রশ্ন করা হলে ডাফলো মেরি কুরির কথা স্মরণ করেন। মেরি কুরি ১৯০৩ সালে পদার্থবিদ্যায় তাঁর প্রথম নোবেল (১৯০৩)এর অর্থ গিয়ে এক গ্রাম রেডিয়াম কিনেছিলেন। ডাফলো বলেন, "আমরা কথা বলে ঠিক করবে আমাদের 'এক গ্রাম রেডিয়াম' কী হতে পারে।"
আরও পড়ুন, বিশ্লেষণ: বাংলাদেশের নোবেল লরিয়েট ইউনূস কেন গ্রেফতারির মুখে
১৯০৩ সালে মেরি কুরি যৌথভাবে নোবেল জিতেছিলেন তাঁর স্বামী পিয়ের কুরির সঙ্গে। তাঁর মতই এস্থার ডাফলোও এবারের সম্মান পেয়েছেন তাঁর স্বামী অভিজিতের সঙ্গে। এস্থার ও অভিজিৎ দীর্ঘদিন ধরে একসঙ্গে কাজ করে চলেছেন। ২০১১ সালে তাঁরা যৌথভাবে লিখেছিলেন Poor Economics: Rethinking Poverty & The Ways to End it। এই দম্পতি ম্যাসাচুসেটস ইন্সটিট্যুট অফ টেকনোলজির সঙ্গে যুক্ত, ক্রেমার রয়েছেন হারভার্ড ইউনিভার্সিটিতে।
এই ত্রয়ী নোবেল জিতলেন কেন?
এবারের লরিয়েটরা দুনিয়া জোড়া দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াইয়ে আমাদের সামর্থ্য অনেকটাই উন্নীত করে দিয়েছেন, বলছে নোবেল কর্তৃপক্ষ। তাদের আরও বক্তব্য, নতুন এই এক্সপেরিমেন্ট ভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি উন্নয়ন অর্থনীতিতে রূপান্তর ঘটিয়েছে।
পুওর ইকনমিক্স গ্রন্থে অভিজিৎ ও এস্থার আক্ষেপ করেছেন দারিদ্র্য নিয়ে বিতর্ক মূলত বৃহৎ প্রশ্নেই ঘোরাফেরা করেছে, যেমন দারিদ্র্যের চূড়ান্ত কারণ কী, মুক্ত বাজারের উপর কতটা আস্থা রাখা উচিত, গণতন্ত্র কী দরিদ্রদের পক্ষে ভাল, বিদেশি সাহায্যের কি ভূমিকা রয়েছে- প্রভৃতি ঘিরে।
অভিজিৎ, এস্থার ও ক্রেমার একসঙ্গে কাজ করছেন ৯-এর দশকের মাঝামাঝি থেকে। তাঁরা এই বড় প্রশ্নের মধ্যে আটকে থাকতে চাননি। তার বদলে তাঁরা সমস্যাগুলিকে ভেঙে নিয়েছেন, সতার বিভিন্ন প্রেক্ষিত বিবেচনা করেছেন, অনেকরকমের এক্সপেরিমেন্ট করেছেন, এবং সেইসব প্রমাণের ভিত্তিতে কী করতে হবে তা স্থির করেছেন।
ফলে, সারা পৃথিবীর ৭০০ মিলিয়ন মানুষ, যাঁরা প্রবল দারিদ্র্যের মধ্যে আজও দিন কাটান, তাঁদের জন্য কোনও রুপোর ওষুধ খোঁজেননি এবারের নোবেলবিজয়ীরা। তাঁরা খুঁজেছেন দারিদ্র্যের বিভিন্ন দিকসমূহ- যথা ভগ্নস্বাস্থ্য, অপর্যাপ্ত শিক্ষা ইত্যাদি। এর পর তাঁরা এগুলির প্রত্যেকটির আরও অন্দরে গিয়েছেন। ভগ্নস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে যেমন, ওঁরা দেখেছন পুষ্টি, ওষুধের ব্যবস্থা, টীকাকরণ। টীকাকরণের ক্ষেত্রে ওঁরা নিশ্চিত করতে চেয়েছেন কোনটা কাজ করে এবং কেন।
নোবেল ঘোষণার পরেই এস্থার ডাফলো বলেছেন, “মানুষ দরিদ্রদের উপহাসের পাত্রে পরিণত করে ফেলেছেন, তাঁদের সমস্যার শিকড় না বুঝেই… (আমরা স্থির করি) সমস্যা বোঝার চেষ্টা করব এবং প্রতিটি বিষয়কে বৈজ্ঞানিকভাবে এবং খুঁটিয়ে বিশ্লেষণ করব।”
আরও পড়ুন, বামপন্থীদের সঙ্গে মিল রয়েছে অভিজিৎদের ভাবনার: অসীম দাশগুপ্ত
প্রয়োগের ক্ষেত্রে এই দৃষ্টিভঙ্গি কীভাবে কাজ করে?
একটি সার্বজনীন বৃহৎ উত্তরের অনুপস্থিতি কিছুটা হতাশাব্যঞ্জক বলে মনে হতে পারে, কিন্তু বাস্তবত নীতিপ্রণয়নকারীরা ঠিক সেটাই জানতে চান - এমন নয় যে দরিদ্ররা লক্ষ লক্ষ উপায়ে ফাঁদে পড়ে রয়েছেন, বরং কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এই ফাঁদগুলি তৈরি করে, সেই নির্দিষ্ট সমস্যাগুলি দূরীভূত করতে পারলেই তাঁরা মুক্ত হয়ে পড়বেন এবং তাঁদের অভিমুখ হয়ে সম্পদ ও বিনিয়োগের চক্রের দিকে। পুওর ইকনমিক্স বইতে এমনটাই লিখেছেন অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় ও এস্থার ডাফলো।
দারিদ্র্যের সমস্যাকে ভেঙে ক্ষুদ্রতর বিষয়ে, যেমন ডায়ারিয়া ও ডেঙ্গি সমস্যার সমাধান করার সেরা উপায়ের দিকে দৃষ্টি দেওয়ার ফলে আশ্চর্য ফল পাওয়া গিয়েছে।
যেমন, প্রায়শই মনে করা হয় ভারতের মত দরিদ্র দেশে শিক্ষা পৌঁছে দেবার মত প্রয়োজনীয় সম্পদ নেই, এবং সম্পদের অভাবের কারণেই স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা আরও বেশি শিখতে পারে না। কিন্তু তাঁদের ফিল্ড এক্সপেরিমেন্ট দেখিয়ে দিয়েছে প্রাথমিক সমস্যা সম্পদের অভাব নয়।
তাঁদের গবেষণা থেকে দেখা গিয়েছে, আরও বেশি পাঠ্যবই দিলে বা স্কুলে খাবার দিলে শেখার পরিমাণ বাড়ে না। মুম্বই ও ভদোদরার স্কুলে দেখা গিয়েছে সবচেয়ে বড় সমস্যা হল শিক্ষণপদ্ধতি ছাত্রছাত্রীদের প্রয়োজনানুযায়ী গৃহীত হয়নি। অন্যভাবে বললে, দুর্বলতম ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষায় সহায়তাপ্রদান স্বল্প থেকে মাঝারি মেয়াদে অনেক বেশি কার্যকর পদ্ধতি হতে পারে।
একইভাবে, শিক্ষকদের অনুপস্থিতির সমস্যা সমাধানে, ছাত্র ও স্থায়ী শিক্ষকের অনুপাত কমানোর পদ্ধতির চাইত স্বল্প মেয়াদে চুক্তি ভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগ (যেখানে ভাল ফল দেখা গেলে মেয়াদ বাড়ানো যেতে পারে) বেশি ভাল ফল দিয়েছে।
তাঁদের নতুন পরীক্ষামূলক পদ্ধতি ঠিক কী?
নতুন শক্তিশালী এই যে উপাদান এই নোবেলজয়ীরা ব্যবহার করেছেন, তা হল র্যান্ডমাইজড কন্ট্রোল ট্রায়াল (আরসিটি)-র প্রয়োগ। অর্থাৎ যদি কেউ বুঝতে চান যে গ্রামবাসীদের তাঁদের সন্তানদের টীকাকরণের জন্য উৎসাহপ্রদান করতে মোবাইল টীকাকরণ ভ্যান এবং/অথবা এক বস্তা শস্য কোনটা দিলে ভাল হবে- সেক্ষেত্রে এই আরসিটি পদ্ধতির মাধ্যমে গ্রামের বাড়িগুলিকে চারভাগে বিভক্ত করা হবে।
প্রথম দলকে মোবাইল টীকারণ ভ্যান দেওয়া হবে, দ্বিতীয় দলকে এক বস্তা শস্য দেওয়া হবে, তৃতীয় দল দুইই পাবে, এবং চতুর্থ দল কিছুই পাবে না। এই বাড়িগুলি বেছে নেওয়া হবে যথেচ্ছ ভাবে, যাতে কোনও পক্ষাবলম্বন না থাকে।
চতুর্থ দলকে বলা হয় কন্ট্রোল গ্রুপ এবং অন্যদের বলা হবে ট্রিটমেন্ট গ্রুপ। এ ধরনের এক্সপেরিমেন্টে কেবলমাত্র একটি পলিসির উদ্যোগ কীভাবে কাজ করে শুধু তাই দেখা যাবে না, একই সঙ্গে পার্থক্যের পরিমাণও স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
এখানে দেখা যাবে যখন একাধিক উদ্যোগ একসঙ্গে নেওয়া হয়েছে সেখানে কী ফল পাওয়া যাচ্ছে। এর ফলে নীতিপ্রণয়নকারীরা নীতি বাছাইয়ের আগেই হাতে নাতে প্রমাণ পেয়ে যাচ্ছেন।
আরসিটির কোনও ফাঁকফোকর রয়েছে কি?
আরসিটি প্রয়োগ নিয়ে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদরা প্রশ্ন তুলেছেন। এঁদের মধ্যে রয়েছেন ২০১৫ সালের অর্থনীতির নোবেলজয়ী অ্যাঙ্গাস ডিটন। তিনি বলেছেন "যথেচ্ছভাবে দুটি দল স্থির করার মাধ্যমে উভয় পক্ষ সমকক্ষ হয় না।" নীতি প্রণয়ন করার ক্ষেত্রে আরসিটি-র উপর বেশি আস্থা রাখা সম্পর্কে সাবধান করেছেন তিনি।
যথেচ্ছভাবে বাড়ি বা লোক বাছলে মনে হতে পারে সব গ্রুপই সমকক্ষ হল, কিন্তু তার কোনও নিশ্চয়তা থাকে না। তার কারণ একটি গ্রুপ অন্য গ্রুপের থেকে ভিন্নভাবে কাজ করতে পারে, তার কারণ তাদের যে ট্রিটমেন্ট দেওয়া হচ্ছে তা নয়, এমন হতে পারে যে কোনও একটি দলে মহিলার সংখ্যা পুরুষের থেকে বেশি বা কোনও একটি গ্রুপে শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা বেশি।
আরও সুনির্দিষ্টভাবে বললে, আরসিটি এই নিশ্চয়তা দেয় না যে কেরালায় যা কাজ করেছে তা বিহারেও কাজ করবে, অথবা ছোট গ্রুপের ক্ষেত্রে যে পদ্ধতি কাজ করেছে, বৃহত্তর ক্ষেত্রেও তা কাজ করবে।
এই নোবেলের পর আরসিটি নিয়ে বিতর্ক ফের একবার চাঙ্গা হয়ে উঠবে তাতে সন্দেহ নেই।