মার্চের শেষ সপ্তাহে অনেক সোশাল মিডিয়া পোস্টে দাবি করা হয়েছিল অবিভক্ত বাংলার রসায়নবিদ তথা মানবহিতৈষী আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় হাইড্রক্সিক্লোরোকুইনের পিছনে আসল মানুষ। এই ওষুধ এখন কোভিড ১৯-এর সৌজন্যে পরিচিত নাম।
কিন্তু সত্যিটা হল প্রফুল্লচন্দ্র রায় রসায়ন ও বিজ্ঞানে অনেক অবদান রাখলেও তিনি হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন আবিষ্কার বা নির্মাণ করেননি। গবেষণা বলছে হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন এ ক্লোরোকুইন প্রথম সংশ্লেষিত হয়েছিল ১৯৪০-এর মাঝামাঝি সময়ে। প্রফুল্লচন্দ্র রায় মারা যান ১৯৪৪ সালের জুন মাসে। বিজ্ঞানের ইতিহাসকাররা বলছেন প্রফুল্ল রায়ের পক্ষে সে সময়ে এই আবিষ্কার সম্ভব নয়। এরকমই এক ইতিহাসবিদ, ‘Unseen Enemy: The English, Disease and Medicine in Colonial Bengal, 1617-1847’- বইয়ের রচয়িতা সুদীপ ভট্টাচার্য বলছেন “আমরা অকারণে এর কৃতিত্ব তাঁকে ও তাঁর প্রতিষ্ঠিত বেঙ্গল কেমিক্যাল অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যালসকে দিচ্ছি।”
তিনি বলেন, “হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন ও ক্লোরোকুইনের আবিষ্কারের সঙ্গে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সম্পর্ক রয়েছে, যখন অক্ষশক্তি ও মিত্রশক্তি উভয়েই দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরে যুদ্ধরত।”
উষ্ণ আবহাওয়া ও যথাযথ শৌচব্যবস্থার অভাবে দুই শিবিরেই সেনারা অনেক রকম অসুস্থতার মুখে পড়তেন, যার মধ্যে অন্যতম ছিল ম্যালেরিয়া।
দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় সিঙ্কোনা চাষ হত, যা থেকে কুইনাইন তৈরি হত, যে কুইনাইন ম্যালেরিয়ার ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হত। বিদেশি বাহিনী যখন এই ওষধির ব্যবহার জানতে পারে তখন তারা এই এলাকায় অবস্থিত নিজেদের সৈন্যদের জন্য তা দাবি করে।
১৯ শতকের শেষাশেষি ভারতীয় উপমহাদেশে সিঙ্কোনার চাষ ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমান ইন্দোনেশিয়া দখলে রাখার সময়ে সেখানে ওলন্দাজরা ৯৫ শতাংশ কইনাইন উৎপাদন করে। ১৯৪২ সালে ডাচ ইস্ট ইন্ডিজরা জাপানি নিয়ন্ত্রণে যাবার পর মিত্রশক্তির কুইনাইন সরবরাহ যুদ্ধের মাঝেই অর্ধেক হয়ে যায়।
কুইনিনের এই ঘাটতির সময়ে আমেরিকা নজর দেয় দক্ষিণ আমেরিকায়, যেখানে ঘরোয়া ভাবে সিঙ্কোনা চাষ হত। ১৯৪২ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত সিঙ্কোনা মিশন নামের এক শোষণকারী পর্যায়ে কলম্বিয়া এবং ইকুয়েডরের অগম্য জঙ্গল থেকে স্থানীয় শ্রমিকদের কাজে লাগিয়ে টন টন কুইনাইন বিমান ও নৌপথে আমেরিকায় নিয়ে আসত পরীক্ষা ও গবেষণার জন্য। এর পর আমেরিকা তাদের হাত বাড়ায় গুয়াতেমালা, মেহিকো, পেরু, বলিভিয়া, ইকুয়েডর এবং এল সালভাদোরে, যেখানকার আবহাওয়া সিঙ্কোনা চাষের উপযোগী।
১৯৯৪ সালে মার্কিন কেমিস্টরা সাফল্যের সঙ্গে সিন্থেটিক কুইনিন আবিষ্কার করেন, এবং ঘোষণা করেন দক্ষিণ আমেরিকায় সিঙ্কোনা চাষ অপ্রয়োজনীয়। ১৯৪৫ সালে এই অক্ষ ভেঙে পড়ে এবং আমেরিকা ফের একবার ইন্দোনেশিয়ায় সিঙ্কোনা চাষের উপর দখল কায়েম করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ম্যালেরিয়ার ওষুধ হিসেবে অতিরিক্ত কুইনাইন সরবরাহের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল।
বেঙ্গল কেমিক্যালস অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যালস কলকাতার একটি ১১৯ বছরের পুরনো সরকারি সংস্থা। ১৯০১ সালে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় এর প্রতিষ্ঠা করেন। সম্প্রতি এই সংস্থা হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন বানানোর লাইসেন্স পেয়েছে। গোটা পূর্ব ভারতে এই একটিমাত্র সরকারি সংস্থাই ম্যালেরিয়ার ওষুধ তৈরি করে।
কোভিড ১৯ ছড়ানোর পর পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যসচিব রাজীব সিনহা বলেছেন রাজ্য সরকার দার্জিলিংয়ের পাহাড়ে সিঙ্কোনা চাষের বিষয়টি নিয়ে বিবেচনা করছে। যদিও কোভিড ১৯ চিকিৎসায় ব্যাপকভাবে সিন্থেটিক ওষুধই কাজে লাগানো হচ্ছে।
কোভিড ১৯ চিকিৎসায় এর কার্যকারিতা নিয়ে গবেষণার ঘাটতি থাকলেও সারা পৃথিবী জুড়ে মানুষ এই ওষুধ মজুত করতে শুরু করেছেন। ওয়াশিংটন পোস্টের খবর, কোভিড ১৯ চিকিৎসায় এর কার্যকারিতা নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা করার পর আমেরিকার কিছু চিকিৎসক একে করোনাভাইরাসের প্রতিষেধক হিসেবে প্রেসক্রিপশনেও লিখতে শুরু করেছেন। গত ৪ এপ্রিল হোয়াইট হাউসের সাংবাদিক সম্মেলনে ট্রাম্প এই ওষুধের সম্পর্কে বলেন, “হারানোর কী আছে আপনাদের! আমি আবার বলছি, আপনাদের হারানোর আছেটা কী! নিয়ে নিন। আমার সত্যিই মনে হয়ে ওটা নেওয়া উচিত।”
ট্রাম্পের এই ভিত্তিহীন দাবি উড়িয়ে দিয়েছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলেছেন করোনাভাইরাস রোগীদের চিকিৎসায় এই ওষুধ ব্যবহার করা হচ্ছে ওসুখের কিছু উপসর্গ নির্মূল করতে এবং কোভিড ১৯ রোগীদের এই ওষুধের মাধ্যমে কার্যকর চিকিৎসার কোনও প্রমাণ নেই।
প্রাথমিক ট্রায়াল থেকে দেখা গিয়েছে এই ওষুধ কোভিড ১৯ রোগীদের সংক্রমণের তীব্রতা কমায় এবং সুস্থ হয়ে উঠতে সাহায্য করে। ভারতে মার্চের শেষ দিকে আইসিএমআর এক অ্যাডভাইজরিতে সুপারিশ করে কোভিড ১৯ রোগীদের পরিচর্যায় নিযুক্ত স্বাস্থ্যকর্মীরা এর ব্যবহার করতে পারবেন এবং চিকিৎসকরা নিশ্চিত সংক্রমিত রোগীদের বাড়ির লোকজনকে এ ওষুধ ব্যবহারের জন্য প্রেসক্রাইব করতে পারবেন।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন