আফগানদের রক্তই আলাদা। মরতে-দম-তক লড়ে যাবে। পালানো তাঁদের অভিধানে ছিল না, নেই, থাকবেও না বোধ করি। তাই সোভিয়েতকে বিফল মনোরথে ফিরতে হয়েছিল ১৯৮৯-এ, আমেরিকাকেও খিড়কি দরজা ধরতে হয়েছে সে দিন। আশরফ গনি যে ভাবে দেশ ছেড়ে, জাত্যাভিমান জলাঞ্জলি দিয়ে পালালেন, তাতেই অনেকে বিস্ময়াভিভূত, আফগান মুলুকে তাই গনি মৃত, ভূতের মর্যাদা পাচ্ছেন এখন। সোভিয়েতরা আফগান মুলুক ছেড়ে যাওয়ার পরও সেখানে তাদের সমর্থনপুষ্ট সরকার ছিল, নাজিবুল্লা ছিলেন প্রেসিডেন্ট, কাবুল ঘিরে ফেলেছিল মুজাহিদিনের দল, কিন্তু নাজিবুল্লা চোখে মিসাইল ছুড়ে দেখিয়েছিলেন আফগান রক্তের কী মহিমা! যেমন এখন দেখাচ্ছেন আহমেদ মাসুদ। পঞ্জশির পতনের খবর বিশ্বে ছড়ানোর পর, অনেকেই মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েছিলেন, আবার তালিবপক্ষ খুশিতে ভেসে গিয়েছিল, কিন্তু দুই অভিব্যক্তিই আপাতত ঠান্ডা ঘরে। ন্যাশনাল রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্টের বিদেশ সম্পর্ক বিভাগের প্রধান আলি নাজারি জানিয়ে দিয়েছেন, সব ঝুট হ্যায়। 'পঞ্জশিরের ষাট শতাংশই রয়েছে তাঁদের নিয়ন্ত্রণে। তাদের গুরু মানে কম্যান্ডার আহমেদ মাসুদ এবং প্রাক্তন ভাইস প্রেসিডেন্ট আমরুল্লা সালেহ অক্ষত শরীরে আছেন।'
পঞ্জশিরের যুদ্ধে যে ভাবে পাকিস্তান তালিবানকে প্রাণ ঢেলে সাহায্য করে যাচ্ছে, তাতে পাক বিরোধী ছিছিক্কারও উঠেছে সারা পৃথিবীতে। তাতে অবশ্য পাকিস্তানের কাঁচা কলা। এখানে মনে করা যেতে পারে, তালিবান কাবুল দখল নেওয়ার পরপর মাসুদ সাহেবদের নর্দান অ্যালায়েন্সের প্রতিনিধিরা পাকিস্তানে গিয়ে পাক-হর্তাকর্তাদের সঙ্গে দেখা করেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী ইমরান, সেনা প্রধান জাভেদ বাজওয়া ছিলেন সেই তালিকায়। তালিবানের বিরুদ্ধে তাঁরা সওয়াল করেছিলেন এই সব হর্তাকর্তার সামনের গদি-আঁটা চেয়ার আলো করে, কিন্তু অল্প সময়ের পরই বুঝে গিয়েছিলেন, এখন আরও ভয়ঙ্কর ভাবে বুঝছেন, শবদেহকে প্রেম নিবেদন করে লাভ নেই। জীবিতের প্রদীপে মৃতের প্রাণ ফেরে না। আফগানিস্তানে এখন অন্তর্বর্তী সরকার, তাদের শরিয়তি শাসনের চালুর সর্বেনেশে ঝঙ্কার। ২০টা বছর সেখানে, বিশেষ করে কাবুলে, খোলা হাওয়ায় আফগান রমণীর হাসি উড়েছে, মেয়েরা মিনি স্কার্ট পরেও রাস্তায় গটগটিয়ে হেঁটেছে, সেখানে শরিয়তি শাসনের ডাক প্রতি মিনিটে শিহরণ-সংখ্যা বাড়িয়ে তুলেছে অসংখ্য মেরুদণ্ডে। মেয়েরা তাই ফুঁসে উঠেছেন। আমরা যেমন দেখছি, তেমন দেখব, যেমন থাকছি, তেমন থাকব, তোমরা দূর হটো… গর্জন শোনা যাচ্ছে প্রমীলা-কণ্ঠে। তার উপর পঞ্জশিরে যে ভাবে পাকিস্তানি মদতে মাসুদ-পতনের টার্গেট তালিবানের, তাতেও মেয়েরা বিলকুল চটেছে। কাবুলের রাস্তায় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মিছিল বার করেছেন তাঁরা। পাকিস্তান মুর্দাবাদ, আইএসআই মুর্দাবাদ-- এই সব স্লোগান। আজাদির ডাক যেন হড়পা বান হয়ে উঠেছে, ফলে তালিবানের আগ্নেয়াস্ত্র ফাটানো চলেছে খানিক, এখন ভয় দেখাতে আকাশে তাক বন্দুকের, এর পর অর্ধেক আকাশ, যাকে তালিবান অন্ধকার করে দিতে চাইছে, তাদের উপর গুলিও নিশ্চয়ই বর্ষিবে। সোশ্যাল মিডিয়ায় ভ্যালির পাশে গুলির ছবিও ভাইরাল। মেয়েদের এই প্রতিবাদ, মিছিল, তালিবানের বুকের উপর বসে রোম উত্তোলন, এই সাহস-- হ্যাটস অফ!
পঞ্জশির কি ধরে রাখতে পারবেন মাসুদরা, এই প্রশ্নটা এখন বজ্রগর্ভ। পৃথিবীর রিংটোন।
কার দোষ?
যেমন পাকিস্তান, তেমনই আমেরিকা কাঠগড়ায়। প্রথমত, আফগানিস্তান থেকে মস্তক মুণ্ডন করে তারা কেটে পড়েছে। এখন তাদেরই ফেলে রাখা বিপুল অস্ত্রশস্ত্র তালিবানের আরাম। কিছু অস্ত্র তারা নষ্ট করে দিয়ে গেলেও, তা হিমশৈলের চূড়া। 'পঞ্জশিরের সিংহ' আহমেদ শাহ মাসুদের ছেলে এই আহমেদ মাসুদ। আন্তর্জাতিক সাহায্য চেয়ে চেয়ে গলা থেকে রক্ত তুলে ফেলেছেন। মাসুদ, নর্দান অ্যালায়েন্সের কম্যান্ডার, কারওরই সাড়া পাননি। আমেরিকা টুঁ শব্দটি করেনি, তোমার ডাকে সাড়া দিতে বয়েই গেছে, এমনই তাদের বডি-ল্যাঙ্গুয়েজ, সাড়া দেয়নি ব্রিটেন বা ফ্রান্সের মতো মহাশক্তিধর। ৩২ বছরের যুবার ডাকে চরম তাচ্ছিল্যের তড়িৎ। অনেকেই বলছেন, এদের বুকের পাটা নেই, সকলেই তালিবানকে ভয় পায় ভাই। আল-কায়দা, তালিবাদের বেরাদর, তাদের ভয় পায় যম-তুল্য, ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারেই তারা দেখিয়ে দিয়েছিল সন্ত্রাস কারে কয়। জীবনযন্ত্রণার মন্ত্র এদের হাতে মুঠোয়। কখন কী ঘটিয়ে দেয়, কিচ্ছু তো বলা যায় না। ভয় না পেয়ে তাই উপায় নেই ছটাকও, নিজ-নাগরিক সির আঁখো পর, তার আলোকবর্ষ পর পঞ্জশির, আপনি বাঁচলে বাপের নাম, তাই না।
কিন্তু 'পঞ্জশিরের সিংহ' মানে সিনিয়র মাসুদ সহযোগিতা পেয়েছিলেন, সেনা-শস্ত্রে আন্তর্জাতিক সেই সাহায্য। ভাগ্য এ ব্যাপারে তাঁর তুলনায় ভাল ছিল। ৯/১১-র পর, তালিবানের হাতে সিনিয়র মাসুদ নিহত হলেও, পঞ্জশিরকে পোক্ত ভিতের উপর দাঁড় করিয়ে রেখে যান, সেই ভিতই এখন পরীক্ষা দিচ্ছে। হ্যাঁ, ছেলেকে তৈরি করেছিলেন শাহ, গুছিয়ে। ব্রিটেনের রয়্যাল মিলিটারি আর্মি অ্যাকাডেমি স্যান্ডহার্স্ট এবং লন্ডনের কিঙ্গস কলেজে পড়াশুনো করেছেন যুবা মাসুদ। যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শিতা, ডিগ্রি অর্জন করে ২০১৬-তে আফগানিস্তানে ফেরেন। এখন, তালিবান রটিয়ে বেড়াচ্ছে-- পঞ্জশির পতনের পর মাসুদ ও সালেহ লেজ গুটিয়ে পালিয়ে গিয়েছেন তাজিকিস্তান।
তালিবান মরিয়া, তাই এ সব বলে বেড়াচ্ছে। বলছেন অনেকেই। কারণ হিন্দুকুশ পর্বতমালার কোলে পঞ্জশিরের যে-অবস্থান, তাতে এই ভূখণ্ডটি পুরোপুরি দখল করা অতি শক্ত কাজ। যা দখল করতে গিয়ে সোভিয়েতের সেনার মৃত্যুমিছিল দীর্ঘতর হয়, তালিবানেরও বডি পড়েছিল বহু, এখনও পড়ছে।
ভারতের ভূমিকা কি আছে কিছু?
নয়া দিল্লি, আগে, মানে সিনিয়র মাসুদের সময়, নর্দান অ্যালায়েন্সকে সাহায্য করে ছিল বলেই জানা যায়। জীবনের শেষ বেলায় শাহ মাসুদ একটি সাক্ষাৎকারকে বলেনও এ ব্যাপারে।'ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক রয়েছে। বিভিন্ন সময় আফগান উদ্বাস্তুদের সঙ্গে মানবিক ব্যবহার করেছে ভারত। আমাদের মধ্যে যে রাজনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে, তা সদর্থক। আমরা দুই দেশই শান্তি চাই, হিংসা চাই না মোটেই। ভারত বড় দেশ, আফগানিস্তানে শান্তি ফেরানোর লক্ষ্যে ভারতের ভূমিকা তাৎপর্যপূর্ণ।' বলেছিলেন তিনি।
আরও পড়ুন- তালিবান ইস্যুতে চুপ চিন, আফগানিস্তানে শান্তিপূর্ণ সমাধান চায় ভারত
কী বলছেন প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত?
মাসুদ-সালেহ তাজিকিস্তানে পালিয়েছেন কি? তাজিকিস্তানে প্রাক্তন আফগান রাষ্ট্রদূত এই দাবি উড়িয়ে দিয়েছেন। জাহির আকবর ওই সেই দূতের নাম, যিনি গনি সরকার পতনের পর চাকরি খুইয়েছেন, সাংবাদিক বৈঠক করে এ কথা বলেছেন। তালিবান ও পাকিস্তানের সাফল্য-দাবিতে যা কার্যত ঠান্ডা জল ঢেলে দেওয়া। তাঁর স্পষ্ট কথা, 'পঞ্জশির ছেড়েছেন মাসুদ-সালেহ-- এটা ডাহা মিথ্যা।' দাবি করছেন, তাঁর সঙ্গে সালেহ-র যোগাযোগ রয়েছে, পঞ্জশির ছাড়লে তিনি জানতেই পেতেন, সালেহ পঞ্জশির থেকেই চালাচ্ছেন আফগান সরকার।
আর আমেরিকা?
কাবুল থেকে আমেরিকার শেষ পল্টন ফেরার পর একটি কাগজে হেডলাইন হয়েছিল, মুখ পুড়িয়ে ফিরল আমেরিকা-- এটাই আদত কথা, ইহাই সার সত্য-- যা জনে জনে এখন জেনে-বুঝে গিয়েছেন। অতঃ কিম? আফগান মুলুকে অন্তর্বর্তী সরকার তৈরি হলেও, তা নিয়ে আমেরিকা নিজের টলোমলো নারাজগি ব্যক্ত করেছে। আমেরিকার বিদেশ সচিব অ্যান্টনি ব্লিনকেন বলেছেন, 'অন্তর্বর্তী সরকার নয়, তালিবান স্থায়ী সরকার গঠনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, স্থায়ী সরকার না গড়লে আন্তর্জাতিক বৈধতা কী করে পাবে?' আফগানিস্তানে এখনও যে সব আমেরিকান রয়েছেন, তাঁদের ফেরত-পর্বে কোনও বাধা সৃষ্টি না করে তালিবান, সেই আবেদনও জানিয়েছেন বিদেশ সচিব। প্রাক্তন শাসকের এই আবেদন 'মুক্তি চিত্তে' মেনেও নিয়েছে তালিবান। আমেরিকা এখন তাদের লোকজন ফেরাতেই শশব্যস্ত, পঞ্জশিরের শির থাকল না কাটা পড়ল, সে নিয়ে ভাবনাচিন্তার সময় নেই বাইডেনদের।
দুর্জয় ঘাঁটি। গেরিলা ফাইটাররা তুখোড়। পঞ্জশিরের শিরস্ত্রাণ ভেদ সহজ নয়। তালিবান এগচ্ছে, কদম কদম… মরছে- পাকিস্তানের সেনাও ঢলে পড়ছে। পঞ্জশিরের পর্বতের আশীর্বাদ মাসুদের মাথায়। দেখা যাক না তিনি কত দিন ঠেকিয়ে রাখতে পারেন তালিব দস্যুদের।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন