/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2020/02/Corona-LEad.jpg)
অলঙ্করণ: অভিজিৎ বিশ্বাস
গত বছরের শেষাশেষি মধ্য চিনের উহান শহরে আবির্ভাব হয় এমন এক ভাইরাসের, যার ফলে বিস্ফোরণের গতিতে ছড়ায় এক ধরনের নিউমোনিয়া, যা হয়ে উঠতে পারে প্রাণঘাতী। এমনই মারাত্মক এই ভাইরাস যে 'গ্লোবাল হেলথ ইমারজেন্সি', অর্থাৎ বিশ্ব স্বাস্থ্যে জরুরি অবস্থা জারি করতে বাধ্য হয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (World Health Organisation অথবা WHO)।
আতঙ্কের কেন্দ্রে রয়েছে করোনাভাইরাস গোষ্ঠীর এক সদস্য, যার নাম দেওয়া হয়েছে 2019-nCoV। এই ভাইরাস গোষ্ঠীর সদস্যরা সাধারণ সর্দি থেকে শুরু করে ঘটাতে পারে একেবারে severe acute respiratory syndrome (SARS), পর্যন্ত। অনেকেরই মনে থাকবে, ২০০৩-০৩ সালে সারা বিশ্বে সার্স মহামারীতে মৃত্যু হয় প্রায় ৮০০ জনের।
কেন এই ভাইরাস এত মারাত্মক?
তার কারণ এর "ছলনাময়" চরিত্র। সংক্রামিত রোগীদের অধিকাংশই দিব্যি হেঁটে-চলে কাজকর্ম করে বেড়াতে পারেন, যার ফলে এটি ছড়ানোর সম্ভাবনা প্রবল। স্রেফ গত দুই মাসের মধ্যে সংক্রমণ এবং মৃত্যুর সংখ্যা ছাপিয়ে গিয়েছে গোটা SARS মহামারীর পরিসংখ্যান।
ফেব্রুয়ারির শুরু পর্যন্ত যা হিসেব, তাতে করোনাভাইরাসে মৃত্যুর হার মোট আক্রান্তের প্রায় ২ শতাংশ, যা কিনা SARS-এর তুলনায় কম, তবে মহামারীর গোড়ার দিকের কোনও পরিসংখ্যানই খুব নির্ভরযোগ্য হয় না। বিশেষজ্ঞদের মতে, সংক্রমণের আসল সংখ্যা ৭৫ হাজার থেকে লক্ষাধিক পর্যন্তও হতে পারে, কিন্তু যেহেতু ভাইরাস-অধ্যুষিত এলাকা যেমন উহান শহর এবং তার চারপাশের হুবেই প্রদেশে যথেষ্ট পরিমাণ পরীক্ষা করানো যাচ্ছে না, সেহেতু সঠিক তথ্য পাওয়া একপ্রকার অসম্ভব।
করোনাভাইরাস ঠিক কী?
করোনাভাইরাস কোনও একটি ভাইরাস নয়, বরং একটি ভাইরাস গোষ্ঠী, যার থেকে মানুষের মধ্যে ছড়ায় একাধিক অসুখ, সাধারণ সর্দি থেকে শুরু করে অতি জটিল এবং প্রায়শই প্রাণঘাতী SARS বা MERS পর্যন্ত। এই ভাইরাসের নাম এসেছে তার আকার থেকে, যা কিনা একটি মুকুটের (corona) মতো, যেটিকে কেন্দ্র করে প্রসারিত হয় অসংখ্য বাহু।
এই ভাইরাস গোষ্ঠীর কিছু সদস্য সহজেই ছড়িয়ে পড়ে মানুষ থেকে মানুষের মধ্যে, আবার কিছু ভাইরাস এমনও আছে যেগুলি ছড়ায় না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, সারা পৃথিবীতেই সময় সময় আবির্ভাব ঘটে নতুন ভাইরাসের, এবং এমন অনেক ভাইরাস আছে যেগুলি পশুপাখিদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে, মানুষের মধ্যে ছড়ায় নি। তবে এই ভাইরাসগুলির পরিবর্তন ঘটতে পারে, সুতরাং এগুলি কতটা মারাত্মক, তা নির্ভর করতে পারে তারা কতদিন ধরে মানুষের শরীর থেকে শরীরে ছড়াচ্ছে, তার ওপর।
এবারের করোনাভাইরাস কি আলাদা?
জিনগত ভাবে এটি SARS ভাইরাসের সমকক্ষ, তবে এখন পর্যন্ত সংক্রমণের তীব্রতা এবং মৃত্যুর হারের নিরিখে অপেক্ষাকৃত মৃদু বলেই মনে হচ্ছে। SARS-এর ক্ষেত্রে মৃত্যুর হার ছিল প্রায় ৯ শতাংশ। এই গোষ্ঠীরই আরেকটি মারাত্মক ভাইরাস, যার নাম দেওয়া হয় MERS-CoV এবং যা ২০১২ থেকে সক্রিয় রয়েছে, তাতে মৃত্যু হয় সংক্রামিত ২,৪৯৯ রোগীর মধ্যে শতকরা ৩৪ জনের। এর বিপরীতে রয়েছে ১৯১৮ সালের ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারী, যাতে মৃত্যু হয় আন্দাজ ৫ কোটি মানুষের। যদিও সেক্ষেত্রে মৃত্যুর হার ছিল ৫ শতাংশের কম, আক্রান্ত হয়েছিলেন পৃথিবীর এক-তৃতীয়াংশ মানুষ।
কীভাবে ছড়াচ্ছে এই ভাইরাস?
প্রধানত কোনও সংক্রামিত ব্যক্তির হাঁচি, কাশি, শ্বাসপ্রশ্বাস, বা কথাবার্তার মাধ্যমে। সেরকম রোগীর কাছাকাছি থাকলে হাওয়াতেই ছড়াবে ভাইরাস, নতুবা তাঁর ছোঁয়া লাগা কোনোকিছুতে আপনার ছোঁয়া লাগলে সেভাবেও ছড়াতে পারে। মলমূত্রের মাধ্যমে ছড়াতে পারে কিনা, তা নিয়ে এখনও সঠিক তথ্য প্রকাশ পায় নি। যাঁদের শরীরে ভাইরাস প্রবেশ করেছে, অথচ রোগের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না, তাঁরাও রোগ ছড়াতে পারেন।
উদাহরণস্বরূপ, চিনে একটি আপাত সুস্থ ১০ বছরের শিশুর শরীর থেকে ভাইরাস ছড়ায় তার গোটা পরিবারের মধ্যে। তবে এই ধরনের সংক্রমণের সম্ভাবনা খুব প্রবল নয়, গত ২৮ জানুয়ারি এই কথা জানান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ অ্যালার্জি অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজেস- এর কর্তা অ্যান্টনি ফাউচি।
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2020/02/corona-3.jpg)
কতটা ছোঁয়াচে এই করোনাভাইরাস?
সাধারণভাবে একটি রোগ কতটা ছোঁয়াচে, তা নির্ধারণ করা হয় একজন রোগী আরও কতজনকে সংক্রামিত করতে পারেন, সেই সংখ্যার ওপর। এই সংখ্যাকে বলা হয় বেসিক রিপ্রোডাকশন নাম্বার, এবং তা থেকে এও বোঝা যায় যে এই মহামারীকে নিয়ন্ত্রণ করা কতটা কঠিন হতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) প্রাথমিক অনুমান, 2019-nCoV'র বেসিক রিপ্রোডাকশন নাম্বারের ব্যাপ্তি হলো ১.৪ থেকে ২.৫, যার মানে এটি SARS-এর মতোই, এবং ইনফ্লুয়েঞ্জার চেয়ে বেশি, ছোঁয়াচে। তবে বেইজিংয়ের চাইনিজ অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সেস-এর একটি দল বলছে, এই সংখ্যা হওয়া উচিত ৪.০৮।
এই ভাইরাস কী করে?
শিশু, কিশোর, বা অপেক্ষাকৃত কম বয়সীদের ক্ষেত্রে অল্পস্বল্প অসুস্থতা, বেশি বয়সীদের ক্ষেত্রে আরেকটু বেশি অসুস্থতা। এখন পর্যন্ত যা দেখা গেছে, প্রাথমিক উপসর্গ হলো জ্বর, শুকনো কাশি, এবং ক্লান্তভাব - কিন্তু সর্দি হলে যে হাঁচি বা নাক দিয়ে জল পড়া দেখা যায়, সেরকম কিছু নয়।
গবেষণা বলছে, লোয়ার রেসপিরেটরি ট্র্যাক্টে প্রথমে হানা দেয় এই ভাইরাস, এবং সেখান থেকে যায় ফুসফুসে, যার ফলে দেখা দেয় নিউমোনিয়ার উপসর্গ, যেমন শ্বাসকষ্ট, জ্বালা, এবং কফ জমা। ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের সময় একটি পরীক্ষায় দেখা গিয়েছিল, হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগীদের এক-চতুর্থাংশই অ্যাকিউট রেসপিরেটরি ডিস্ট্রেস সিন্ড্রোম (acute respiratory distress syndrome)-এর শিকার হয়ে পড়ছেন, যা প্রাণঘাতী হয়ে উঠতে পারে। এছাড়াও দেখা যায় সেপ্টিক শক, রেসপিরেটরি ফেইলিওর, এবং অন্যান্য অঙ্গের বিকল হয়ে যাওয়া। মৃতদের মধ্যে এমন অনেকে ছিলেন, যাঁদের ইতিমধ্যেই হৃদরোগ বা অন্য কোনও অসুখ রয়েছে।
নতুন ভাইরাসের ক্ষেত্রে ভয়টা কিসের?
যেহেতু নতুন ধরনের ভাইরাসের বিরুদ্ধে মানুষের শরীরে প্রতিরোধ ক্ষমতা বা 'ইমিউনিটি' গড়ে উঠতে সময় লাগে, সেহেতু নতুন ভাইরাসের আবির্ভাব সবসময়ই ভয়ের। বিশেষ করে এই কারণে, যে কোনও নির্দিষ্ট চিকিৎসা পদ্ধতি বা টীকা আবিষ্কার হতে সময় লাগে। নভেল করোনাভাইরাসের যে কোনও প্রজাতিই শঙ্কাজনক, কারণ সেগুলি আগে মানুষের শরীরে কখনও পাওয়া যায় নি। এর ফলে সৃষ্টি হতে পারে জটিল ধরনের মহামারীর, যেমন হয়েছিল SARS-এর ক্ষেত্রে।
কী পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে?
চিনের সরকার উহান এবং পার্শ্ববর্তী শহরগুলিকে বাইরের জগত থেকে সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে, ফলত ৫ কোটিরও বেশি মানুষ আপাতত শহরবন্দী। প্রায় রাতারাতি গজিয়ে উঠেছে নতুন হাসপাতাল, বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে স্কুলে ছুটির মেয়াদ, এবং শহরবাসীকে বাড়ি থেকে অফিসের কাজ করতে বলা হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই মহামারীর প্রেক্ষিতে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে, যার ফলে আন্তর্জাতিক সাহায্য পেতে কিছুটা সুবিধে হতে পারে।