ভ্যাকসিনের দুটি ডোজ নেওয়ার পরেও কোভিড সংক্রমণ হচ্ছে। তাতে চিন্তার বাতাবরণ তৈরি হয়েছে। তা হলে কি ভ্যাকসিন কোভিড আটকাতে পারছে না, সেই গুরুতর প্রশ্ন উঠেছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারকে নিশানা করেছেন। দেখা গিয়েছে, কোভিড আক্রান্তের ২০ শতাংশের শরীরে রয়েছে প্রতিষেধক। কেন্দ্রকে চিঠি লেখার জন্য স্বাস্থ্যসচিবকে বলেও দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। না, আমাদের রাজ্য, কিংবা এই সুজলাং সুফলাংয়েই শুধু নয়, সারা পৃথিবীতে প্রতিষেধক ফোটানো অনেককেই করোনা কামড় দিয়েছে। ফলে মাথা চুলকোতে হচ্ছে বিশেষজ্ঞদের। তা হলে কি ড্রাগন ধরার যে ফাঁদটি তৈরি করা হয়েছে, তা ঠুকনো? তবে, স্বস্তির কথাটা হল, টিকা নেওয়া-দের করোনায় মৃত্যুর হার অনেক কম। এবং অনেকের উপসর্গই দেখা যাচ্ছে না কোনও। মানে, গাল-ভরা সেই কথাটা-- অ্যাসিমটোম্যাটিক বা উপসর্গহীন তাঁরা। এখনেও অবশ্য একটা সমস্যা রয়েছে। কারণ, অ্যাসিমটোম্যাটিকরা তো নিজের ও চারদিকের অজান্তে করোনা ছড়িয়ে দিতে কোনও কার্পণ্য করবে না। তা হলে?
কয়েক দিন আগেই খবর হয়েছে, ১০০ কোটি ভ্যাকসিনের ডোজ দেওয়া হয়েছে এ দেশে। এর আগে একমাত্র রয়েছে চিন। জুন মাসে চিন এই সংখ্যাটা পেরিয়েছে। রাষ্ট্রপুঞ্জের হিসেবে ভ্যাকসিনের ১০০ কোটি-- ৩টি জার্মানি, ১১টি ফ্রান্স, ১০টি ইংল্যান্ড, ৫টি রাশিয়া, ১৮টি কানাডার সমান। যদিও বছরের শেষে এ দেশের যোগ্য জনসংখ্যার মাত্র ৩০ শতাংশকেই পুরোপুরি ভ্যাকসিন দেওয়া সম্ভব হবে। আর টার্গেট রয়েছে ৬০ শতাংশ। এবং প্রাপ্তবয়স্ক জনসমুদ্রের ৭০ শতাংশই একটি ডোজ পেয়েছেন এখনও। এ সব কিছুই এই বিরাট সাফল্যের নীচে অন্ধকার তৈরি করে রেখেছে। তা ছাড়া রয়েছে দুটি ডোজের মধ্যে ফারাক-পরিসংখ্যানের কাঁটাও।
ব্লুমবার্গের ট্র্যাকার বলছে, চিনের ৮২ শতাংশ অন্তত একটি ডোজ নিয়েছেন, ৭৬ শতাংশ নিয়েছেন দুটি। অনুপাত হল-- ১.১। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অন্তত একটি ডোজ নিয়েছেন ৬৬.২ শতাংশ, দুটিই নিয়েছেন ৫৭.৩ শতাংশ। অনুপাত ১.১৫। ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলি মিলিয়ে হিসেবটা হল-- অন্তত একটি ডোজ নিয়েছেন ৬৯ শতাংশ, দুটিই নিয়েছেন ৬৬ শতাংশ। ভারতে এই গ্যাপটি দ্বিগুণের বেশি। এখানে অন্তত একটি ডোজ নিয়েছেন ৫১ শতাংশ, দুটি নিয়েছেন ২১.৯ শতাংশ। এর কারণ আর কিছুই নয়, প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজ দেওয়ার মধ্যেকার সময়সীমা। এখানে ১২ থেকে ১৬ সপ্তাহ, পৃথিবীতে যা সবচেয়ে বেশি। ভ্যাকসিন নেওয়ার পরও কোভিডের কামড়-- তাতে এ দিকেও নজর পড়েছে, কাটাছেঁড়া করা হচ্ছে। বাড়তি গ্যাপের মধ্যে ভূতটা ঢুকে বসে নেই তো?
শত কোটি ভ্যাকসিন বিকশিত হয়েছে, এটা কম কথা নয়। এবং ভ্যাকসিন যে ভাবে ভয়ঙ্কর সংক্রমণ ও মৃত্যু রুখে দিচ্ছে, তা-ও স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। কারওর প্রতিষেধক-দ্বিধা বা ভ্যাকসিন হেজিটেন্সি রয়েছে, ডোজ নেওয়ার পরও কোনও ব্যক্তি কোভিড সংক্রমিত হওয়ায় তাদের হেজিটেন্সি আরও বেড়ে গিয়েছে। তাঁদের এটা জানা দরকার যে, প্রতিষেধক-পুষ্টরা সহজে মৃত্যুমুখে মহাপতিত হচ্ছেন তো না-ই, কোডিড ঢুকলেও তা নির্বিষ হয়ে পড়ছে অনেক সময়ে। এবং আরেকটি তথ্যও চমকানোর মতো। কী সেটা? ভ্যাকসিন নেওয়া থাকলে অন্য রোগে মৃত্যুর সম্ভাবনাও কমে যাচ্ছে। কাইজার পার্মানেন্টে নামে আমেরিকার স্বাস্থ্য পরিষেবা সংক্রান্ত একডাকে চেনা সংস্থা, যাদের সদর দফতর ক্যালিফোর্নিয়ার ওকল্যান্ডে, তারা একটি গবেষণা করে দেখেছে-- কোভিড ছাড়া অন্য কোনও অসুখ হলে, ভ্যাকসিন নেওয়া-রা বেশি মারা যাচ্ছেন কি না?
ইউএস সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন বা সিডিসি-র মর্বিডিটি অ্যান্ড মোর্টালিটি উইকলি রিপোর্টে এই রিসার্চ পেপারটি প্রকাশিত হয়েছে। মার্কিন মুলুকের ৬ কোটি ৪০ লক্ষ প্রতিষেধকপ্রাপ্তদের এবং একই পরিবেশে বসবাস করা ৪ কোটি ৬০ লক্ষ ভ্যাকসিন না-নেওয়া মানুষের তথ্য তুলনা করা হয়েছে। ১৪ ডিসেম্বর ২০২০ থেকে ২০২১-এর ৩১ জুলাই পর্যন্ত ইনফো চর্চা করা হয়েছে এতে। নজর দেওয়া হয়েছে শুধুমাত্র নন-কোভিড মৃত্যুর তথ্যে। দেখা যাচ্ছে, নন-কোভিডে মৃত্যুর হার ভ্যাকসিন দেওয়াদের মধ্যে চোখে পড়ার মতো কম। এখানে বলে নিতে হবে, আমেরিকায় ফাইজার, মর্ডানা এবং জনসন অ্যান্ড জনসনের ভ্যাকসিন দেওয়া হয়। ফাইজার এবং মর্ডানার এমআরএনএ ভ্যাকসিন দুটি ডোজ দিতে হয়। জনসন অ্যান্ড জনসনের অ্যাডেনোভাইরাল ভেক্টর ভ্যাকসিনের ডোজ প্রয়োজন হয় একটি।
আরও পড়ুন কী করে শূকরের কিডনি কাজ করছে মানব শরীরে?
যা হোক, গবেষণা থেকে কী বেরিয়ে এল, সে দিকে নজর দিই
ফাইজারের প্রতিষেধকের প্রথম ডোজ যাঁরা নিয়েছেন, তাঁদের মৃত্যুর হার এক বছরে এক হাজার জনে-- ৪.২। দ্বিতীয় ডোজ নিয়েছেন যাঁরা, তাঁদের মৃত্যুর হার হাজার জনে ৩.২। এই ভ্যাকসিন যাঁরা নেননি, তাঁদের মৃত্যু হয়েছে অনেক বেশি। হাজার জনে সেই হার এক বছরে-- ১১.১।
মর্ডানার প্রতিষেধক প্রথম ডোজ যাঁরা নিয়েছেন, তাঁদের মৃত্যু হাজারে এক বছরে ৩.৭। দ্বিতীয় ডোজ নেওয়াদের ক্ষেত্রে এই মৃত্যু ৩.৪। আর ভ্যাকসিন না নেওয়া দলে হাজার জনে মৃত্যু হয়েছে ১১.১ শতাংশ।
জনসন অ্যান্ড জনসনের প্রতিষেধকপ্রাপ্তদের মৃত্যু সংখ্যাটা একটু বেশি। দেখা যাচ্ছে এক বছরে কোভিড ছাড়া অন্য অসুখে এই ভ্যাকসিন নেওয়াদের মৃত্যু এক হাজার জনে-- ৮.৪। যাঁরা ভ্যাকসিনটি নেননি তাঁদের মৃত্যু হাজারে ১৪. ৭।
ফলে কোভিড শুধু নয়, অন্যান্য অসুখেও এর প্রতিষেধকটি পুজো পাবে। অভ্রভেদী সাফল্যই তার।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন