বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার সম্প্রতি সীতামারির পুনৌরা ধামে দেবী সীতার জন্মস্থানের জন্য ৭২ কোটি টাকার একটি উন্নয়ন পরিকল্পনা করেছেন। তাঁর দল জেডি(ইউ), 'অযোধ্যা মন্দির এবং ভগবান রামকে নিয়ে বেশি মনোযোগ দেওয়া এবং সীতার দিকে ফিরেও না-তাকানো'র অভিযোগে কেন্দ্রের তীব্র নিন্দা করেছে। নীতীশ কেন সীতার জন্মস্থান উন্নয়নে জোর দিলেন, তা জানতে গেলে সীতার বিহার সংযোগ এবং বিহারি ধর্মীয় কল্পনায় সীতার গুরুত্ব বোঝা দরকার। অবসরপ্রাপ্ত আইপিএস অফিসার এবং বিহার স্টেট বোর্ড অফ রিলিজিয়াস ট্রাস্টের প্রাক্তন চেয়ারম্যান আচার্য কিশোর কুণালের রিপোর্টে পুনৌরা ধাম কেন্দ্রের রামায়ণ সার্কিটের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। আচার্য কুণাল কিশোর বিহারের মিথিলার ইতিহাস এবং পুরাণ নিয়ে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের সঙ্গে কথা বলেছেন এবং সীতার সঙ্গে মিথিলার অমোঘ সম্পর্কের কথা তুলে ধরেছেন।
এক্সপ্রেস- রামায়ণে বর্তমান বিহারের উল্লেখ আছে কি?
আচার্য কুণাল কিশোর- একজন গবেষক হিসেবে, আমি প্রথমে এই ভাবনার উৎস হিসেবে বাল্মীকি রামায়ণের কথা বলব। এই বাল্মীকি রামায়ণকে আমরা তুলসীদাসের রামচরিতমানস-সহ রামায়ণের পরবর্তী সংস্করণগুলোর ওপর ভিত্তি করে আমরা জানতে পাই। বাল্মীকি রামায়ণে সীতাকে বোঝাতে চারটি শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে—বৈদেহী, জানকী, সীতা এবং মিথিলাপুরী। মিথিলাপুরী মিথিলার একটি সুস্পষ্ট উল্লেখ। অন্যদিকে বৈদেহী এবং জানকী তার পিতা রাজা জনক থেকে প্রাপ্ত নাম। যাকে বিদেহও বলা হয়। চিত্রকূটে রামের নির্বাসনের সময় সীতা নিজেই তাঁর জন্মের গল্প অত্রি ঋষির স্ত্রী অনুসূয়াকে বলেছেন। জানিয়েছেন, তাঁকে জনক রাজার চাষ করা একটি খেতে পাওয়া গিয়েছিল।
মহর্ষি বিশ্বামিত্রের সঙ্গে ভ্রমণের সময় রাম এবং লক্ষ্মণ বিহারের বেশ কয়েকটি স্থান পরিদর্শন করেছিলেন বলেও মনে করা হয়। বাল্মীকির বিবরণ অনুসারে, অযোধ্যা ত্যাগ করার পরে, চিত্রকূটে তাঁরা প্রথমে বিশ্রাম নিয়েছিলেন। তারপর থেমেছিলেন বর্তমান সারান জেলার গঙ্গা ও সরুর সঙ্গমের কাছে। তাঁরা যে তৃতীয় স্থানে গিয়েছিলেন, তা হল বর্তমান বক্সারের গঙ্গার কাছে সিদ্ধাশ্রম। পরে তাঁরা গরুর গাড়িতে করে পাটালির (পাটনা) কাছে গঙ্গা ও সোনের সঙ্গমস্থলে যাত্রা করেন। সোন-গঙ্গা সঙ্গম পথটি পাটনা থেকে কয়েক বছর ধরে দূরে সরে গেছে।
রাম, লক্ষ্মণ এবং বিশ্বামিত্র গঙ্গা পার হয়েছিলেন এবং বৈশালীর রাজা সুমতি তাঁদের স্বাগত জানান। তিনজন পরে অহল্যার আশ্রমে চলে যান। যা এখন মিথিলাপুরিতে (বর্তমান দারভাঙ্গা) আহিরৌরি নামে পরিচিত। মিথিলার কথা রাম এবং সীতার বিবাহের সময়ও উল্লেখ আছে। যেখানে রাম শিবের ধনুকে (ধনুক) ছিলা পরিয়েছিলেন। রামের বিবাহের মিছিল অযোধ্যা থেকে চার দিনে মিথিলাপুরী পৌঁছেছিল এবং তিন দিনে ফিরে এসেছিল বলে, উল্লেখ আছে। বাল্মীকি উল্লেখ করেছিলেন যে, রাম শুধুমাত্র একবার মিথিলাপুরীতে গিয়েছিলেন। যেখানে মহাকাব্যের পরবর্তী কিছু সংস্করণ দাবি করেছে যে তিনি রাজা হওয়ার পরও সেখানে গিয়েছিলেন।
এক্সপ্রেস- মিথিলার ভৌগোলিক ব্যাপ্তি কত?
আচার্য কুণাল কিশোর- বিষ্ণু পুরাণে, মিথিলাকে গঙ্গার উত্তরে এবং হিমালয়ের দক্ষিণে একটি স্থান হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। আইন-ই-আকবরিতে আবুল ফজল স্পষ্টভাবে মিথিলাকে একটি পরগনা (প্রশাসনিক বিভাগ) হিসেবে উল্লেখ করেছেন। যার অবস্থান এবং বিস্তারকে চিহ্নিত করা হয়েছে এইভাবে- এর মধ্যে বর্তমান দারভাঙ্গা, মধুবনি, সীতামারি, সুপল, সহর্ষা, মাধেপুরা-সহ বিহারের বিভিন্ন এলাকা এবং নেপাল সংলগ্ন এলাকাও রয়েছে। মিথিলাকে মহলাও বলা হয়। বিহার, বাংলা, উড়িষ্যার পূর্ববর্তী যুক্তপ্রদেশের (যুক্তপ্রদেশ) রাজস্বের রেকর্ডেও এর উল্লেখ পাওয়া যায়।
এটি বিশ্বাস করা হয় যে সীতামারিই হল জানকির জন্মস্থান। এই সীতামারিতে একটি পুকুর এবং অন্যান্য ধর্মীয় কেন্দ্র রয়েছে রয়েছে, এটিই সীতার জন্মস্থান। কিন্তু প্রায় ১০ বছর ধরে আমাদের গবেষণায় দেখা গেছে যে জানকী মন্দিরটি প্রায় ২০০ বছর আগে একজন সন্ন্যাসী দ্বারা নির্মিত হয়েছিল। তিনি দাবি করেছিলেন যে তিনি তাঁর স্বপ্নে জায়গাটিকে সীতার জন্মস্থান হিসেবে দেখেছিলেন। আমাদের গবেষণা, বাল্মীকি রামায়ণ এবং কিছু ভ্রমণকারীর বিবরণের ওপর ভিত্তি করে, পুনৌরা ধামের পক্ষে রায় দিয়েছে। সেখানে সীতাকুণ্ড, সীতা বাটিকা এবং লব-কুশ বাটিকার সঙ্গে একটি ১০০ বছরের পুরোনো মন্দিরও আছে।
যখন কেন্দ্র বিহার সরকারের কাছে রামায়ণ সার্কিটের জন্য সীতার জন্মস্থান সম্পর্কে একটি রিপোর্ট চেয়েছিল, তখন আমি অন্যান্য গবেষকদের সহায়তায় পুনৌরা ধামের নামই জানিয়েছিলাম। এটি এখন রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় সরকার উভয়ই মেনে নিয়েছে। পুনাউরা ধাম বিকাশে রাজ্যের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত গবেষণার পরেই নেওয়া হয়েছে। পরিসংখ্যানবিদ এবং ইতিহাসবিদ স্যার উইলিয়াম উইলসন হান্টার (1877), A Statistical Account of Bengal, ভলিউম 13-এ বলেছেন যে, 'পুনাউরা, সীতামারির তিন মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে, এই অঞ্চল সীতার জন্মস্থান হওয়ায়, সম্মানের দাবিদার।'
এক্সপ্রেস- নেপালের জনকপুরীর ইতিহাস কি?
আচার্য কুণাল কিশোর- জনকপুরী মিথিলাপুরীর একটি অপেক্ষাকৃত আধুনিক নাম। মিথিলাপুরীর নাম উল্লেখ আছে বাল্মীকি রামায়ণে। আমাদের সরকার, নেপাল সরকারের সঙ্গে সমন্বয় করে, জনকপুরীকে রামায়ণ সার্কিটের একটি অংশ করেছে। ১৮১৬ সালে ভারত-নেপাল চুক্তির পর জনকপুর নেপালের অংশ হয়ে যায়। এমনকী, নেপালের শীর্ষস্থানীয় ইতিহাসবিদ ফ্যান্সিস বুকানন হ্যামিল্টনও 'জনকপুরী' সম্পর্কে কিছু লেখেননি। আমাদের কাছে থাকা নথিতে মিথিলাপুরীর উল্লেখই আছে।
এক্সপ্রেস- বর্তমান সীতামারির কিছু ঐতিহাসিক উল্লেখ আছে কি?
আচার্য কুণাল কিশোর- শীর্ষস্থানীয় প্রত্নতাত্ত্বিক আলেকজান্ডার কানিংহামের বিবরণ অনুসারে, 'সীতামারি, দারভাঙ্গা থেকে ৪০ মাইল উত্তর-পশ্চিমে এবং নেপাল সীমান্ত থেকে ১৪ মাইল দূরে অবস্থিত। এর পূর্ব সীমান্তে রয়েছে সোরুন নালা। সেখানে গ্রামের বিভিন্ন অংশ দিয়ে অসংখ্য ছোট স্রোত বয়ে যায়। যা বর্ষার সময় মিশে গিয়ে গোটা অঞ্চলকে প্লাবিত করে। সীতামারির পুরাকীর্তিগুলোর মধ্যে খুব কমই বর্তমানে টিকে আছে। সীতাকে উত্সর্গীকৃত কিছু মন্দির বাদ দিলে, স্থানটি প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা থেকে একেবারেই বঞ্চিত।'
আরও পড়ুন- জ্ঞানবাপী মসজিদ: ৯১-এর মামলা হঠাৎ নতুন করে জেগে উঠল কেন?
এক্সপ্রেস- পুনাউড়া নিয়ে বিহার সরকারের পরিকল্পনা কী?
আচার্য কুণাল কিশোর- ধর্মীয় ট্রাস্টের বোর্ডের কাছে উপলব্ধ তথ্য অনুসারে, পুনাউড়া উন্নয়ন পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে মন্দিরের সংস্কার। এর চারপাশে একটি ছাদযুক্ত প্রদক্ষিণা পথ (প্রদক্ষিণের পথ) তৈরি করা হবে। লবকুশ বাটিকা, সীতা বাটিকা এবং সীতাকুণ্ডের উন্নয়ন করতে হবে। একটি ধ্যান মণ্ডপেরও উন্নয়ন করা হবে। সীতার জীবনযাত্রা দেখানোর জন্য একটি থ্রি-ডি ফিল্ম প্রদর্শিত হবে। এছাড়া মহাবীর মন্দির ট্রাস্ট সীতাকুণ্ডের ভিতরে ১০০ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি সীতা মন্দির নির্মাণ করবে। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে অযোধ্যায় রাম মন্দির উদ্বোধনের পরে আমরা এই মন্দির প্রকল্পটি শুরু করব।