/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2023/09/accession-of-Hyderabad-1.jpg)
হায়দ্রাবাদের নিজাম মfর উসমান আলির সঙ্গে ১৯৪৭ সালে সর্দার প্যাটেল। (ছবি: উইকিমিডিয়া কমন্স)
চলতি বছর ১৭ সেপ্টেম্বর, স্বাধীন ভারতে হায়দরাবাদের যোগদানের ৭৫তম বার্ষিকী পালিত হল। সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের ভাষায়, দাক্ষিণাত্যের সমৃদ্ধ রাজ্যটি 'ভারতের পেটে ক্যানসার' হয়ে উঠেছিল। ১৯৪৮ সালের এই দিনটি বিভ্রান্তি এবং হিংসার সেই এক বছরের দীর্ঘ গল্পের সমাপ্তি ঘটিয়েছিল। প্রশ্ন হল, হায়দরাবাদের নিজাম ১৯৪৭ সালের আগস্টে অন্যান্য রাজ্যের মতো ভারতে কেন যোগ দেননি? কী এমন বিষয় ছিল, যা হায়দ্রাবাদকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছিল। আর, সর্দার প্যাটেল সতর্কতার সঙ্গে তার মোকাবিলা করেছেন? রাজাকারদের ভূমিকাই বা কী ছিল এবং কেন নিজামের বিরুদ্ধে কৃষক আন্দোলন সক্রিয় হয়ে উঠেছিল? সেসব একবার দেখে নেওয়া যাক।
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2023/09/accession-of-Hyderabad-2.jpg)
আগস্ট ১৯৪৭: স্বাধীনতার মরশুম
প্রায় ২০০ বছর শাসনের পর বৃটিশরা সেই সময় ভারত ছেড়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। সেই সময় ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণে থাকা ৫০০ দেশীয় রাজ্য কোন পক্ষে থাকবে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। প্রদেশগুলোকে ভারত বা পাকিস্তানে যোগদান অথবা স্বাধীন থাকার বিকল্প দেওয়া হয়েছিল। সীমান্তের ভারতের দিকে বেশিরভাগ রাজ্য একত্রিত হলেও, কিছু রাজ্য স্বাধীন থাকতে চেয়েছিল। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল উত্তরে জম্মু-কাশ্মীর এবং দক্ষিণে হায়দরাবাদ।
Without India's Iron Man Sardar Vallabhbhai Patel Ji, the annexation of the vast Telangana, Kalyan Karnataka, and Marathwada region would have remained a mirage for a long time.
On the occasion of Hyderabad Liberation Day, I paid floral tribute to the great son of Mother India. pic.twitter.com/0UwNyPf7Fv— Amit Shah (@AmitShah) September 17, 2023
খলিফার মেয়েকে বিয়ে
১৭১৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হায়দরাবাদ ১৯৪৭ সালেও ছিল একটি বিরাট রাজ্য। বর্তমান তেলেঙ্গানা এবং কর্ণাটক ও মহারাষ্ট্রের কিছু অংশ নিয়ে এই রাজ্য গঠিত ছিল। এর শাসক ছিলেন সপ্তম নিজাম মির উসমান আলি। তাঁকে সেই সময় পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি বলা হত। তিনি একটি হিন্দু-সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রের মুসলিম শাসক ছিলেন। তবে শুধু কোনও মুসলিম শাসক নন। তাঁর ব্যক্তিগত সম্পদ এবং তাঁর প্রদেশের প্রতিপত্তি তাঁকে মুসলিম বিশ্বের এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছিল। নিজামের ছেলেরা অটোম্যানে রাষ্ট্রের ক্ষমতাচ্যুত খলিফা দ্বিতীয় আবদুল মজিদের কন্যা এবং ভাইয়ের মেয়ের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন। দ্বিতীয় আবদুল মজিদ খলিফা হিসেবে তাঁর মেয়েকে উত্তরাধিকারী করতে চেয়েছিলেন।
নিজামের ভাবনা
মির উসমান আলি বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ কোষাগারে ব্যাপক দান করেছিলেন। তিনি বিশ্বাস করেছিলেন যে তিনি ইংরেজরা তাঁর রাজ্যকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেবে এবং সমর্থন করবে। তাঁর মামলা করার জন্য, তিনি একজন বিশিষ্ট ইংরেজ আইনজীবী স্যার ওয়াল্টার মঙ্কটনকে নিয়োগ করেছিলেন। স্যার ওয়াল্টার মঙ্কটন আবার ভারতের শেষ ভাইসরয় লর্ড লুই মাউন্টব্যাটেনের বন্ধু ছিলেন। মাউন্টব্যাটেনকে মঙ্কটন বলেছিলেন যে ভারত হায়দ্রাবাদকে খুব বেশি চাপ দিলে নিজাম পাকিস্তানে যোগ দেবে।
জিন্নার আশ্বাস
ইতিহাসবিদ রামচন্দ্র গুহ তাঁর, 'ইন্ডিয়া আফটার গান্ধী' বইয়ে লিখেছেন যে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে মহম্মদ আলি জিন্নাহ 'লর্ড মাউন্টব্যাটেনকে আশ্বাস দিয়েছিলেন যে, ভুল করেও যদি কংগ্রেস হায়দরাবাদের ওপর কোনও চাপ সৃষ্টি করার চেষ্টা করে, তাহলে সমগ্র মুসলিমবিশ্বের প্রতিটি মুসলমান, কয়েকশো কোটি মুসলমান ভারতের প্রাচীনতম মুসলিম রাজবংশকে রক্ষা করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়বে।' সর্দার প্যাটেল সেই কারণে ধৈর্য নিয়ে হায়দরাবাদের সঙ্গে আলোচনার চেষ্টা চালান। ১৯৪৭ সালের নভেম্বরে, ভারত এবং হায়দরাবাদ একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। এই চুক্তি অনুযায়ী, ভারত এবং হায়দরাবাদের মধ্যে সম্পর্ক ব্রিটিশদের অধীনে যেমন ছিল তেমনই থাকবে। এই চুক্তির পরও আলোচনা চলতেই থাকে।
বিদ্রোহ ও রাজাকার
ভারতের পক্ষ থেকে কে এম মুন্সি ও হায়দরাবাদের দেওয়ান মিল লাইক আলি আলোচনা চালাচ্ছিলেন। সেই সময় হায়দরাবাদে নিজামের বিরুদ্ধে একটি বিদ্রোহ তৈরি হয়েছিল। ইতিহাসবিদ বিপান চন্দ্র এবং অন্যরা লিখেছেন, ১৯৪৭ সালের ৭ আগস্টের প্রথম দিকে, ভারতের স্বাধীনতার পর হায়দরাবাদে কংগ্রেস গণতন্ত্রের জন্য একটি সত্যাগ্রহ শুরু করেছিল। গ্রামীণ এলাকায় কমিউনিস্ট নেতৃত্বাধীন কৃষক আন্দোলন, বৃহৎ জমিজমা এবং জোর করে শ্রম আদায় এবং অত্যধিক কর আদায়ের বিরুদ্ধে প্রবল হয়ে উঠছিল। পালটা নিজামের অবস্থান হয়ে উঠেছিল সহিংস।
পরিস্থিতির অবনতি
ইত্তেহাদ-উল-মুসলিমিন মুসলমানদের হয়ে রাজনৈতিক দল হিসে সোচ্চার হয়ে উঠেছিল। কিন্তু নিজামের ঘনিষ্ঠ সহযোগী কাসিম রাজভি দায়িত্ব নেওয়ার পর এই দল একটি সাম্প্রদায়িক এবং চরমপন্থী রূপ নেয়। রাজভিও রাষ্ট্রীয় সমর্থনে 'রাজাকার' নামে একটি আধা-সামরিক বাহিনী গঠন করেছিলেন। এই বাহিনী নিজামের বিরোধীদের ওপর নির্মম আক্রমণ শুরু করেছিল। পরিস্থিতি দেখে, সর্দার প্যাটেল দ্রুত ধৈর্য হারাচ্ছিলেন। তিনি ১৯৪৮ সালের জুনে, প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুকে লিখেছিলেন: 'আমি খুব দৃঢ়ভাবে অনুভব করছি যে এমন একটি পর্যায় এসেছে যখন আমাদের স্পষ্টভাবে বলা উচিত যে যোগদান (ভারতে) ছাড়া আমরা কিছুই ভাবছি না।' কিন্তু, প্যাটেলের সেই অবস্থান জানার পরও জওহরলাল নেহরুর নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার পরিস্থিতি আলোচনার মাধ্যমে সামলানোর চেষ্টা করেছিল। তার মধ্যেই হায়দরাবাদে আরও বেশি অস্ত্র প্রবেশ করতে শুরু করে।
অপারেশন পোলো
অবশেষে, ১৯৪৮ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর, ভারতীয় সেনাবাহিনী হায়দরাবাদে অভিযান চালায়। যার নাম ছিল, 'অপারেশন পোলো'। তিন দিনের মধ্যে নিজামের বাহিনী আত্মসমর্পণ করে। ১৭ সেপ্টেম্বর রাতে নিজাম রেডিওতে রাজাকারদের নিষিদ্ধ ঘোষণা করে জনসমক্ষে ভাষণ দেন। ছয় দিন পরে, তিনি আরেকটি ভাষণ দেন। সেই ভাষণে নিজামকে উদ্ধৃত করে রামচন্দ্র গুহ বলেছেন যে রাজভি এবং তাঁর লোকেদের সম্পর্কে নিজাম বলেছিলেন, 'হিটলারি পদ্ধতির মাধ্যমে ওরা হায়দরাবাদ দখল করেছিল।' আর, তিনি (নিজাম) 'ভারতের সঙ্গে একটি সম্মানজনক মীমাংসা করার চেষ্টা চালাচ্ছিলেন।'
আরও পড়ুন- পরম্পরাগতভাবে কারুশিল্পে যুক্ত! সাহায্য করবে ‘বিশ্বকর্মা’, কী এই প্রকল্প?
যাইহোক, শেষ পর্যন্ত সব ভালোয় ভালো মিটে যায়। ভারতের জন্য, হায়দরাবাদের যোগদান শুধুমাত্র একটি বিশাল সমস্যার সমাধানই ছিল না। বরং, ভারতীয় রাষ্ট্র যে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলছিল, তার একটি বিজয়ও ছিল। বিপান চন্দ্র এবং অন্য ইতিহাসবিদরা প্যাটেলকে উদ্ধৃত করে লিখেছেন, 'হায়দ্রাবাদের প্রশ্নে, ভারতের মুসলিমরা আমাদের পক্ষে প্রকাশ্যে এসেছেন এবং এটি অবশ্যই দেশে একটি ভাল ছাপ তৈরি করেছে।'