লাদাখ নিয়ে চিনের সঙ্গে অচলাবস্থার মধ্যে ভারত সরকার দমনমূলত নীতি হিসেবে বেছে নিয়েছ মোবাইল অ্যাপ, যার প্রভাব ভারতীয় ব্যবসায়ে খুব বেশি নয়, তবে কনজিউমারের হিসেবে এগুলির উপস্থিতি ব্যাপক।
চিনের সঙ্গে যুক্ত ৫৯টি অ্যাপ নিষিদ্ধ করার মাধ্যমে যে বার্তা দেওয়া হয়েছে তা একই সঙ্গে পরিকল্পিত ও প্রবল। অ্যাপের যেহেতু বিকল্প রয়েছে, ফলে ভারতের পক্ষে তা অসুবিধাজনক না হলেও চিনের ক্ষেত্রে ভারতের অ্যাপ বাজার ক্রমবর্ধমান ও মূল্যবান।
তার আরও একটা বড় কারণ হল ভারতে ইন্টারনেট পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে শস্তা এবং এর গ্রাহক সংখ্যা ৮০০ মিলিয়নের বেশি। স্মার্টফোন ব্যবহারকারীর প্রায় অর্ধেকের বয়স ২৫-এর নিচে এবং তাঁরা ডিভাইসে অনেক বেশি কনটেন্টের জন্য মুখিয়ে থাকেন।
আরও পড়ুন, টিকটক ও অন্যান্য চিনা অ্যাপ নিষিদ্ধ, এর প্রভাব কী?
ভারতে চিনা ব্যবসায়িক স্বার্থের উপর এটিই সম্ভবত প্রথম বড়সড় পদক্ষেপ। দু মাস আগে এপ্রিল মাসে ডিপার্টমেন্ট ফর প্রমোশন অফ ইন্ডাস্ট্রি অ্যান্ড ইন্টারনাল ট্রেড প্রতিবেশী দেশথেকে আশা সরাসরি বিদেশি লগ্নির জন্য সরকারের পূর্বানুমতি প্রয়োজন বলে জানিয়েছিল।
এ পদক্ষেপেরও লক্ষ্য ছিল কোভিড-১৯ অতিমারীর সময়ে, যখন সংস্থাগুলির দাম পড়ে গিয়েছে, সেই পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে সেগুলিকে টেকওভার করা বা অধিগ্রহণ করা যেন আটকানো যায়।
পণ্যসামগ্রী আটকানো হলে চিন সে নিয়ে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় চ্যালেঞ্জ করত, প্রযুক্তি ক্ষেত্রের উপর এই নজর নয়া দিল্লির প্রেক্ষিত থেকে অনেকটাই বেশি কার্যকর হবে।
পণ্যসামগ্রীর উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে চিনের থেকে ভারতের বাণিজ্য ও অর্থনীতির ক্ষতি অনেক বেশি হত।
মাত্র দিন দশেক আগে টুইটারে প্রেস ইনফর্মেশন ব্যুরোর ফ্যাক্ট চেক হ্যান্ডেস অ্যাপ স্টোরে কিছু অ্যাপের হদিশ না মেলার কথা অস্বীকার করেছে।
আরও পড়ুন, চিনা আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা কি ভারতের রফতানিকে চাপে ফেলবে?
ক্যাম স্ক্যানার, টিকটক, ক্ল্যাশ অফ কিংস সহ বেশ কিছু চিনা অ্যাপ নিষিদ্ধ করা নিয়ে ভুয়ো এক নির্দেশনামার প্রেক্ষিতে এই প্রতিক্রিয়া দেওয়া হয়েছিল।
সরাসরি বিদেশি লগ্নির অনুমোদনের নিয়ম পরিবর্তনের ফলে প্রতিকূল অধিগ্রহণ নিয়ে উদ্বেগজনক পরিস্থিতির বদল ঘটিয়েছে। চিনের লগ্নির উপর নজর রাখেন যেসব বিশেষজ্ঞরা, তাঁরা বলছেন এর ফলে টেনসেন্ট ও আলিবাবার মত সংস্থার ভারতীয় তথ্যপ্রযুক্তির স্টার্ট আপে লগ্নি করা অসুবিধাজনক হয়ে পড়বে।
২০১৫-১৯-এর মধ্যে আলিবাবা, টেনসেন্ট, টিআর ক্যাপিটলা এবং হিলহাউস ক্যাপিটাল ভারতীয় স্টার্টআপে ৫.৫ বিলিয়ন অর্থ বিনিয়োগ করেছে বলে জানিয়েছে ভেঞ্চার ইন্টেলিজেন্স।
ভেঞ্চার ইন্টেলিজেন্সে পরিসংখ্যান থেকে দেখা যাচ্ছে ২৯টির মধ্যে ১৬টি ইউনিকর্নে (যেসব স্টার্ট আপের মূল্য এখন এক বিলিয়নের বেশি) অন্তত একজন চিনা বিনিয়োগকারী রয়েছে।
আরও পড়ুন, চিনের পণ্য কেন বন্দরে আটকে, তার ফলে কী হচ্ছে?
ভারত বিশ্ব বাণিজ্যের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় চিন কেন্দ্রিক কোনও নীতি এতদিন তৈরি করা হয়নি বলে জানিয়েছেন এক প্রাক্তন বাণিজ্যসচিব। তিনি বলেছেন তবে এখন সরকার মোবাইল তৈরি, সক্রিয় ফার্মাসিউটিক্যাল কাঁচামাল ও মেডিক্যাল ডিভাইসের মত অন্তত বেশ কিছু ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট নীতি আনতে চলেছে।
ভারতে এখন সবচেয়ে বেশি ডাউনলোড করা অ্যাপ হল টিকটক, এর ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১২০ মিলিয়নের বেশি এবং তা বর্তমানে যুব সংস্কৃতিকে, বিশেষ করে ভারতের পশ্চাৎভূমিতে নতুন রূপদান করছে।
বৃহৎ টেক সংস্থা বাইটড্যান্সের তৈরি করা এই অ্যাপের মাধ্যমে ব্যবহারকারীরা ছোট ভিডিও তৈরি করে তাতে কণ্ঠস্বর বা মিউজিক দিতে পারেন। গোটা বিশ্বে এর ডাউনলোডের সংখ্যা এপ্রিল মাসে ২ বিলিয়ন ছাড়িয়েছে বলে জানিয়েছে সান ফ্রানসিস্কোর সংস্থা সেনসর টাওয়ার আইএনসি।
এই ডাউনলোডের ৩০ শতাংশ ভারতে হয়েছে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি, যদিও অ্যাপ থেকে আসা লাভ বা আয় চিন বা আমেরিকার চেয়ে কম।
তবে টিকটক যে ভারতে ব্যবসা বৃদ্ধি করতে চায় তা স্পষ্ট, তারা সম্প্রতি কর্মীসংখ্যা বাড়িয়েছে এবং আঞ্চলিকতায় জোর দিয়েছে।
টিকটকের সঙ্গেই নিষিদ্ধ করা হয়েছে মেসেজিং অ্যাপ উইচ্যাট এবং টুইটারের সমগোত্রীয় চিনা সোশাল নেটওয়ার্ক উইবো-কেও।
আরও পড়ুন, গালওয়ান উপত্যকা নিজের বলে কেন দাবি করছে ভারত?
মিডিয়া এজেন্সি জেনিথের দেওয়া হিসেব অনুসারে ২০১২ থেকে ১৮ সালের মধ্যে ভারতীয়দের অনলাইন ভিডিও দেখার গড় সময়ে দিনে ২ মিনিট থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫০ মিনিটে।
গুগল সংস্থার ইউটিউবের ব্যবহারকারীর সংখ্যা ভারতে টিকটকের তুলনায় বেশি। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন কনটেন্টের পার্সোনালইজেশনে বা সামগ্রিক প্রভাবের ক্ষেত্রে টিকটকের সম্ভাবনা অনেক বেশি।
চিনা অ্যাপ টিকটক ১৫ টি ভারতীয় ভাষাকে সাপোর্ট করে, এর থেকেই বোঝা যায় ভারতের পশ্চাৎভূমিতে কার্যকরী হয়ে ওঠার জন্য তারা কতটা মরিয়া। এর ফলে স্থানীয় প্রতিভার উদগীরণও যে হচ্ছে, তাতে সন্দেহ নেই।
সেন্সর টাওয়ার ডেটা অনুসারে, টিকটক ইনস্টলের ব্যাপারে ভারত সর্বাগ্রে, আজ পর্যন্ত ৬১১ মিলিয়ন ডাউনলোড হয়েছে, মোট ডাউনলোডের ৩০.৩ শতাংশ।
এর পরেই রয়েছে চিন, সেখানে আজ পর্যন্ত ডাউনলোড ১৯৯.৬ মিলিয়ন, মোট ডাউনলোডের ৯.৭ শতাংশ।
তৃতীয় স্থানে রয়েছে আমেরিকা, এখানে মোট ১৬৫ মিলিয়ন ইনস্টল ঘটেছে, যা মোট ইনস্টলের ৮.২ শতাংষ।
এর আগে ২০১৯ সালের মে মাসে সাধারণ নির্বাচনের সময়ে সরকার দু সপ্তাহের জন্য এই অ্যাপ ডাউনলোড নিষিদ্ধ করেছিল। মাদ্রাজ হাইকোর্ট রায় দিয়েছিল এর ফলে শিশুরা এই অ্যাপের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ও সম্ভাব্য বিপদের মুখে পড়ছে। সেই রায়ের প্রেক্ষিতেই সরকারের এই সিদ্ধান্ত।
টিকটক আদালতে আবেদন করে ছাড় পেয়ে যায়। এবারে সম্ভবত এই নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকবে।