মঙ্গলবার কেরালা প্রথম রাজ্য হিসেবে সুপ্রিম কোর্টে নাগরিকত্ব (সংশোধনী) আইন বা সিএএ চ্যালেঞ্জ করেছে। এর আগে এই আইনকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে যে ৬০টি আবেদন জমা পড়েছে, সেগুলির থেকে আইনিভাবে এটি আলাদা। কেরালা সরকার সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছে সংবিধানের ১৩১ নং অনুচ্ছেদের আওতায়। এই বিধি অনুসারে কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে বিবাদ মেটাতে পারে একমাত্র সুপ্রিম কোর্ট- তা কেন্দ্র বনাম একটি রাজ্য হোক বা কেন্দ্র ও একটি রাজ্য একদিকে ও অন্য রাজ্য একদিকে হোক বা দুই বা তার বেশি রাজ্য হোক।
আরও পড়ুন: সিএএকে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে প্রথম রাজ্য কেরালা
বুধবার ছত্তিসগড় সরকারও ১৩১ নং অনুচ্ছেদের আওতায় এনআইএ অ্যাক্টকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে। তাদের দাবি এই আইন আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় রাজ্যের ক্ষমতায় ভাগ বসাচ্ছে।
১৩১ নং অনুচ্ছেদ কী?
সুপ্রিম কোর্টের তিন ধরনের অধিক্ষেত্র রয়েছে। অরিজিনাল, অ্যাপেলেট ও অ্যাডভাইজরি।
অ্যাডভাইজরি অধিক্ষেত্রের আওতায়, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা রয়েছে শীর্ষ আদালতের মত চাওয়া।
অ্যাপেলেট- এক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্ট নিম্ন আদালতের আবেদন শোনে।
অরিজিনাল হল তেমন একটি অধিক্ষেত্র, যেখানে সুপ্রিম কোর্টের হাতে রাষ্ট্রপতি ও উপরাষ্ট্রপতির নির্বাচন, রাজ্য ও কেন্দ্রের মধ্যে বিবাদ ও মৌলিক অধিকার হরণের বিষয়গুলি থাকে।
১৩১ নং অনুচ্ছেদের আওতায় কোনও বিবাদ মীমাংসার বিষয় উত্থাপিত হলে, তা আবশ্যিকভাবে রাজ্য বনাম কেন্দ্র বিবাদ হতে হবে এবং এমন কোনও আইনের প্রশ্ন বা এমন কোনও বিষয় জড়িত থাকতে হবে যার আইনি অধিকারের উপর কেন্দ্র বা রাজ্য নির্ভরশীল। কর্নাটক বনাম ভারত সরকার মামলার ১৯৭৮ সালের এক রায়ে বিচারপতি পিএন ভগবতী বলেছিলেন, ১৩১ নং অনুচ্ছেদের আওতায় কোনও মামলা সুপ্রিম কোর্টে গৃহীত হবার জন্য রাজ্যকে তার আইনি অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে এমনটা প্রদর্শিত না হলেও চলবে, বিবাদের বিষয়টি যে আইনি, তা প্রদর্শিত হওয়াই যথেষ্ট।
ভিন্ন দল দ্বারা পরিচালিত কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের মধ্যে রাজনৈতিক তফাৎ মেটানোর জন্য ১৩১ নং অনুচ্ছেদ ব্যবহার করা যাবে না।
সিএএ নিয়ে অন্য পিটিশনের সঙ্গে ১৩১ নং অনুচ্ছেদের আওতায় করা আবেদনের তফাৎ কী?
সিএএ চ্যালেঞ্জ করা অন্য পিটিশনগুলি দাখিল করা হয়েছে সংবিধানের ৩২ নং অনুচ্ছেদের আওতায়, যেখানে আদালতকে মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে কিনা তা দেখার অধিকার দেওয়া হয়েছে। একটি রাজ্য সরকার এই ধারায় আদালতের দ্বারস্থ হতে পারে না, কারণ মৌলিক অধিকার দাবি করতে পারেন জনগণ ও নাগরিক।
১৩১ নং অনুচ্ছেদের আওতায় চ্যালেঞ্জ করা যাবে কেন্দ্র ও রাজ্যের ক্ষমতার প্রসঙ্গে।
তবে রাজ্যের ক্ষেত্রে এই ছাড় (১৩১ অনুচ্ছেদের আওতায়) এবং ৩২ নং অনুচ্ছদের আওতায় করা আবেদন এসেছে একই প্রেক্ষিত থেকে- দাবি করা হয়েছে এই আইন অসাংবিধানিক বলে ঘোষণা করা হোক।
কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট কি ১৩১ নং অনুচ্ছেদের আওতায় কোনও আইনকে অসাংবিধানিক বলে ঘোষণা করতে পারে?
বিহার ও ঝাড়খণ্ড সরকারের মধ্যে ২০১২ সালের একটি বিবাদ বর্তমানে মুলতুবি রয়েছে আদালতের বৃহত্তর বেঞ্চের কাছে। সে বেঞ্চই এ ব্যাপারে চূড়ান্ত রায় দেবে। সে মামলা ছিল, অবিভক্ত বিহার রাজ্যের যে সব সরকারি কর্মী রাজ্যভাগের পর ঝাড়খণ্ডের অধীনে চাকরি করেছেন, তাঁদের পেনশন ঝাড়খণ্ড সরকার দেবে কিনা সে বিষয়ে।
যদিও এর আগে বিভিন্ন রায়ে বলা হয়েছে ১৩১ নং অনুচ্ছেদের আওতায় আইনের সাংবিধানিকতা পরীক্ষা করা যেতে পারে, ২০১১ সালে মধ্য প্রদেশ বনাম ভারত সরকারের এক মামলায় এ ব্যাপারে অন্য রকম রায় দেওয়া হয়েছে।
২০১১ সালের মামলাটিও দুই বিচারপতির বেঞ্চের হওয়ায় এবং সময়ের দিক থেকে পরে হওয়ায়, আদালত সে মামলার রায়কে অস্বীকার করতে পারেনি। তবে সে রায়ের সঙ্গে দুই বিচারপতি সহমত ছিলেন না।
"মধ্যপ্রদেশ সরকার বনাম ভারত সরকার মামলারা রায়ের সঙ্গে আমরা দুঃখজনকভাবে সহমত হতে পারছি না। ওই মামলার রায়ে বলা হয়েছিল ১৩১ নং অনুচ্ছেদের আওতায় করা মামলায় কোনও আইনের সাংবিধানিকতা চ্যালেঞ্জ করা যায় না। উপরোক্ত সিদ্ধান্তে দুই বিতারপতির বেঞ্চের ছিল, বিচারবিভাগীয় শৃঙ্খলা মেনে এ বিষয়টি আমরা শুধু এই আদালতের বৃহত্তর বেঞ্চেই পাঠাচ্ছি না, একই সঙ্গে ওই সিদ্ধান্তের সঙ্গে আমাদের অসহমতের কারণগুলিও নথিবদ্ধ করতে বাধ্য হচ্ছি।" ২০১৫ সালে এই রায় দিয়ে বিষয়টি বৃহত্তর বেঞ্চে পাঠান হয়।
ঘটনাচক্রে, ২০১৫ সালে যে দুই বিচারপতি এই রায় দিয়েছিসেন তাঁরা হলেন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি জে চেলমেশ্বর এবং বর্তমান প্রধান বিচারপতি এস এ বোবদে। আগামী দু সপ্তাহের মধ্যে বিচারপতি এন ভি রামানা, সঞ্জীব খান্না ও কৃষ্ণ মুরারিকে নিয়ে গঠিত বেঞ্চে এই মামলার শুনানি।
বিহাার বনাম ঝাড়খণ্ডের বৃহত্তর বেঞ্চের রায়ের উপর অনেকটাই নির্ভর করবে কেরালার সিএএ চ্যালেঞ্জ জানিয়ে করা মামলা।
কেন্দ্র কি ১৩১ নং অনুচ্ছেদের আওতায় কোনও রাজ্যের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারে?
রাজ্য যাতে আইন বলবৎ করে তা নিশ্চিত করার অন্য ক্ষমতা রয়েছে কেন্দ্রের হাতে। কেন্দ্র রাজ্যকে নির্দেশ দিতে পারে সংসদে পাশ হওয়া আইন বলবৎ করতে। রাজ্য সে নির্দেশ না মানলে, কেন্দ্র আদালতে গিয়ে রাজ্যকে আইন লাগু করার জন্য স্থায়ী ইনজাংশন জারি করতে বলতে পারে। আদালতের নির্দেশ না মানলে তা আদালত অবমাননা বলে গণ্য এবং সে ক্ষেত্রে রাজ্য আইন লাগু না করায় মুখ্য সচিবকে কাঠগড়ায় তুলতে পারে আদালত।
সংসদে পাশ হওয়া আইনের বিরুদ্ধে রাজ্যের চ্যালেঞ্জ জানানোর ঘটনা কি অস্বাভাবিক?
সংবিধান অনুসারে, সংসদে পাশ হওয়া সমস্ত আইনই সাংবিধানিক, যদি না আদালত অন্যরকম মত ব্যক্ত করে। তবে ভারতের আধা ফেডারেল সাংবিধানিক কাঠামোয়, সংরকারের মধ্যেকার দ্বন্দ্বের ঘটনা খুব অস্বাভাবিক নয়।
সংবিধান রচয়িতারা এরকম মত পার্থক্যের কথা ভেবেই সুপ্রিম কোর্টের অরিজিনাল অধিক্ষেত্রের বিষয়টি যুক্ত করেছিলেন।
সংসদে স্পষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা সহ কেন্দ্রে শক্তিশালী সরকার থাকলে ভারতের ফেডারেল কাঠামোর ফাঁক ফোকরগুলি ধরা পড়ে যায়। ২০১৪ সাল থেকে, যখন নরেন্দ্র মোদী সরকার ক্ষমতায় এল, তখন থেকেই পঞ্চদশ পে কমিশন, জিএসটি, জাতীয় শিক্ষানীতিতে ভাষাগত বিভাজন, জমি অধিগ্রহণ এবং প্রস্তাবিত সারা ভারত জুডিশিয়াল সার্ভিস নিয়ে বিতর্ক শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকার বনাম বিরোধীদের দ্বারা শাসিত রাজ্যের মধ্যে ব্যবধান স্পষ্ট করেছে।