Advertisment

Explained: কুষ্টিয়ায় ভারতীয় গোলন্দাজ বাহিনীর অসামান্য বীরত্ব, 'পিপ্পা'-য় গরিবপুরের লড়াইয়েরও স্মৃতিতর্পণ

সব ফ্রন্টে একযোগে উপস্থিতি। নামই হয়ে গিয়েছিল, 'ঘোস্ট রেজিমেন্ট'।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
1971 war cover

শহিদদের অন্যতম ছিলেন সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট শ্যাম চন্দভারকর। (ছবি- এক্সপ্রেস আর্কাইভ)

শীঘ্রই মুক্তি পেতে চলেছে সিনেমা- পিপ্পা। 'দ্য বার্নিং চ্যাফিস' বইয়ের ওপর ভিত্তি করে এই সিনেমা তৈরি হয়েছে। এই বইয়ে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের গরিবপুরের যুদ্ধের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ আছে। যেখানে যুদ্ধে ট্যাংকের ভূমিকাকে তুলে ধরা হয়েছে। বোঝানোর চেষ্টা হয়েছে যে এই ট্যাংক সেই সময় যুদ্ধে ঠিক কতটা কার্যকর ভূমিকা পালন করেছিল। বইটি লিখেছেন ব্রিগেডিয়ার বলরাম সিং মেহতা (অবসরপ্রাপ্ত)। তিনি ভারতীয় সেনার ৪৫, গোলন্দাজ বাহিনীর একজন অফিসার। যিনি তরুণ বয়সে গরিবপুরের যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। 'দ্য বার্নিং চ্যাফিস' হল পাকিস্তান সেনার এম-২৪ চ্যাফি ট্যাংকের ব্যাপারে লেখা। এই ট্যাংককে ভারতীয় সেনার পিটি-৭৬ ট্যাংকের থেকে নিকৃষ্ট বলে তুলে ধরা হয়েছে বইয়ে। স্বাভাবিকভাবেই 'পিপ্পা' সিনেমাতেও তা উঠে এসেছে। এই 'পিপ্পা'র অর্থ হল টিনের ক্যান। ভারতীয় সেনার গোলন্দাজ বাহিনীর মাত্র তিনটি রেজিমেন্টকে বাংলাদেশের যুদ্ধে কাজে লাগানো হয়েছিল। বেশিরভাগই মোতায়েন করা হয়েছিল দেশের পশ্চিম সীমান্তে। কারণ, পাকিস্তানও দেশের পশ্চিম সীমান্তে প্রচুর ট্যাংক মোতায়েন করেছিল।

Advertisment

গরিবপুরের যুদ্ধ

ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে প্রকৃত যুদ্ধ শুরু হওয়ার অনেক আগে ২১ নভেম্বর গরিবপুরের যুদ্ধ হয়েছিল। যেখানে ৪৫, গোলন্দাজ বাহিনীর ট্যাংকগুলির একটি স্কোয়াড্রন ভারতীয় ১৪-পাঞ্জাব গ্রুপ নিয়ে গঠিত বাহিনীর সাহায্যে পাকিস্তানের এম-২৪ চাফি ট্যাংকের স্কোয়াড্রন নিয়ে তৈরি পাকিস্তান সেনার দুটি পদাতিক ব্যাটালিয়নের সঙ্গে লড়েছিল। ১৪ পাঞ্জাব গ্রুপের একটি প্লাটুনে ১০২ ইঞ্জিনিয়ার রেজিমেন্ট, ৮৭ ব্যাটারি রেজিমেন্ট, ৬ ফিল্ড রেজিমেন্ট এবং আর্টিলারি সাপোর্ট হিসেবে ৭৮টি মাঝারি রেজিমেন্ট ছিল। এই যুদ্ধে মেজর ডিএস নারাং ছিলেন ৪৫, গোলন্দাজ স্কোয়াড্রনের কমান্ডার। তিনি পাকিস্তানি ট্যাংকের মুখোমুখি হন এবং শহিদ হওয়ার আগে দুটি শত্রু ট্যাংকের ধ্বংস নিশ্চিত করেছিলেন। তাঁর স্কোয়াড্রনের সেকেন্ড ইন কমান্ড, ক্যাপ্টেন বলরাম মেহতা তাঁর কাছ থেকে দায়িত্ব নেন এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ট্যাংক ধ্বংস নিশ্চিত করেন। মেজর নারাং মরণোত্তর মহাবীর চক্র পেয়েছিলেন।

কুষ্টিয়ার যুদ্ধ ও শহিদ সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট স্যাম চন্দভারকর

প্রতিটি যুদ্ধেই এমন কিছু ঘটনা থাকে, যা রীতিমতো দাগ কেটে যায়। ট্যাংকের লড়াইয়ে গরিবপুর সুপরিচিত হলেও, ১৯৭১ সালের ৯ ডিসেম্বর বাংলাদেশের কুষ্টিয়াতেও ট্যাংকের লড়াই হয়েছিল। এখানে ৪৫, গোলন্দাজ এবং রাজপুত রেজিমেন্টের পদাতিক বাহিনীর একটি দল ট্যাংকের লড়াইয়ের মুখোমুখি হয়েছিল। পাকিস্তানি ট্যাংক এবং পদাতিক বাহিনীর বিরুদ্ধে তাঁরা অদম্য সাহসিকতা ও দৃঢ়তার পরিচয় দিয়েছিলেন। কুষ্টিয়ার লড়াইয়ে ভারত আর পাকিস্তানের সেনার দুই তরুণ সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট, যাঁরা মাত্র কয়েক মাস আগেই চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন, অতর্কিত আক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করেন। আর, শহিদ হয়েছিলেন। এনিয়েও আছে মর্মস্পর্শী কাহিনি। এই দুই হতভাগ্য অফিসার হলেন ভারতীয় সেনার ৪৫, গোলন্দাজ বাহিনীর সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট এসআর চন্দভারকর ও পাকিস্তানের ২৯, গোলন্দাজ বাহিনীর সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট আবদুল মহসিন খালিদ কার্ক। ভারতীয় সেনার ৪৫, গোলন্দাজ বাহিনীর ট্যাংকের গুলিতে খালিদ কার্ক মারা যান। কিন্তু, স্যাম চন্দভারকর পাকিস্তানি পদাতিক বাহিনীর হাতে বন্দি হন। তাঁকে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়। বাংলাদেশের লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত ভারত জিতেছে। তাই প্রাথমিকভাবে কুষ্টিয়ায় ভারতীয় সেনা যে প্রতিরোধের মুখে পড়েছিল, সেকথা অনেকেই ভুলে গিয়েছেন। তারপরও ৪৫, গোলন্দাজ বাহিনীর 'এ' স্কোয়াড্রনের ১ এবং ৩ ট্রুপসের সৈন্যদের সাহসিকতার কথা মনে না-রাখা অপরাধ।

দফাদার চেরিয়ান আব্রাহামের লড়াই

স্যাম চন্দভারকরের দলের প্রধান ট্যাংক এবং তৃতীয় ট্যাংক পাকিস্তানের গোলার আঘাতে পুড়ে গিয়েছিল। সামনের দিকে থাকা দ্বিতীয় ট্যাংক বেড়িবাঁধের বাম দিকে নেমে গিয়েছিল। আর, পাকিস্তানিদের সঙ্গে তার প্রধান বন্দুক এবং মেশিনগানের মাধ্যমে অ্যামবুশ ভাঙার চেষ্টা চালায়। ল্যান্স দফাদার শঙ্করনের নেতৃত্বে এই ট্যাংক একটি পাকিস্তানি এম-২৪ চ্যাফি ট্যাংককে গোলা ছুড়ে ধ্বংস করে দেয়। যতক্ষণ না তাঁর ট্যাংকের ইঞ্জিনের ডেকে একটি গোলা এসে আঘাত করে এবং ট্যাংক অচল হয়ে পড়ে, ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি শত্রুর সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যান। ট্যাংক অচল হয়ে পড়ায় সেই ট্যাংকের জওয়ানরা ট্যাংক ছেড়ে হেঁটে পিছু হটে। পিছনে ফেরার চেষ্টা চালায় সামনের লাইনে থাকা চতুর্থ ট্যাংকও। কিন্তু, ট্যাংকের ইঞ্জিনটি চালু করা যায়নি। যার ফলে সেটি দাঁড়িয়ে পড়ে। আর, তাতে গিয়ে পড়ে পাকিস্তানের ট্যাংকের গোলা। এই সময় দফাদার চেরিয়ান আব্রাহামের নেতৃত্বে শেষ ট্যাংকটি পদাতিক সৈন্যদের জীবন বাঁচাতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে এবং পাকিস্তানি পদাতিক বাহিনী এবং ট্যাংকের মোকাবিলা করে। দফাদার চেরিয়ান আব্রাহামের ট্যাংক দ্রুত স্কিড টার্ন করে। পাকিস্তানি সেনা যেখান থেকে সবচেয়ে বেশি গুলি ছুড়ছিল, সেই জায়গাটা ধ্বংস করে দেয়। এককথায় অ্যামবুশ ভেঙে ফেলে। পালটা গুলিতে পাকিস্তানের সেনাকে নাস্তানাবুদ করে দেয়।

দফাদার চেরিয়ান আব্রাহামের ট্যাংক

দফাদার চেরিয়ান আব্রাহামের ট্যাংক কালভার্ট অতিক্রম করার পর, ট্যাংকটি একটি ঢালু জায়গায় নেমে যায়। ভারতীয় সেনার পদাতিক বাহিনীর রাজপুত রেজিমেন্টের ২২ জওয়ানও তখন প্রাণপণে গুলি চালাচ্ছিলেন। তাদের সঙ্গে থেকে সমানভাবে গুলি চালাতে শুরু করে দফাদার চেরিয়ান আব্রাহামের ট্যাংক। শুধু তাই নয়, গোলা ছুড়ে শত্রুপক্ষের একটি ট্যাংকও ধ্বংস করে দেয়। যার ফলে বিপুলসংখ্যক জওয়ানের প্রাণ রক্ষা পায়। প্রায় তিন ঘণ্টা এই লড়াই চলে। বিকেল ৫টার দিকে পরিস্থিতি কিছুটা বদলায়। কারণ, ভারতীয় বিমানবাহিনী খবর পেয়ে পালটা হামলা শুরু করে। ওই অঞ্চলে আরও সৈন্য নিযুক্ত হয়। মেজর (পরে মেজর জেনারেল) প্রমোদ বাত্রার নেতৃত্বে ৪৫, গোলন্দাজ বাহিনীর 'এ' স্কোয়াড্রনের বাকি অংশকেও অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে কুষ্টিয়ায় নিযুক্ত করা হয়। ভারতীয় সেনার প্রায় চারটি মাউন্টেন ডিভিশনের পুরোটাই শীঘ্র সেখানে জড় হয়। এর পরপরই পলায়নরত পাক সেনারা কুষ্টিয়া শহর পরিত্যাগ করে।

মাত্র তিনটি গোলন্দাজ রেজিমেন্টের ব্যবহার

বাংলাদেশে ১৯৭১ সালের যুদ্ধে মাত্র তিনটি গোলন্দাজ রেজিমেন্টকে কাজে লাগিয়েছিল ভারতীয় সেনা। সেগুলো হল ৪৫ গোলন্দাজ রেজিমেন্ট, ৬৩ গোলন্দাজ রেজিমেন্ট, আর ৬৯ সশস্ত্র রেজিমেন্ট। এর মধ্যে ৪৫ গোলন্দাজ রেজিমেন্ট এবং ৬৯ সশস্ত্র রেজিমেন্টের কাছে ছিল পিটি-৭৬ ট্যাংক। আর, ৬৩ গোলন্দাজ রেজিমেন্টের কাছে ছিল সোভিয়েতের তৈরি টি-৫৫ ট্যাংক। পাশাপাশি, ৬৩ গোলন্দাজ রেজিমেন্টের সঙ্গে ছিল দুটি সশস্ত্র স্কোয়াড্রন। ৪৫ গোলন্দাজ রেজিমেন্ট বাংলাদেশে মোতায়েন ৪ মাউন্টেন ডিভিশন এবং ৯ পদাতিক ডিভিশনের ১৭টি ব্যাটালিয়নের সঙ্গে মোট ২৯টি লড়াইয়ে অংশ নিয়েছিল। বাংলাদেশের নদীমাতৃক ভূখণ্ড গোলন্দাজ বাহিনীর চলাচলের জন্য উপযোগী ছিল না। কিন্তু, যেখানে ট্যাংকগুলোকে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা যেত, সেখানেও সেগুলো ব্যবহার করা হয়নি। বদলে, ট্যাংকগুলোকে বিভিন্ন বাহিনীর সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছিল। অর্থাৎ, বিভিন্ন পদাতিক ব্যাটালিয়নের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছিল। যা নানাভাবে ট্যাংকগুলোর দক্ষতা এবং কার্যকারিতা হ্রাস করেছিল বলেই গোলন্দাজ বাহিনীর একাংশের দাবি।

আরও পড়ুন- আরও পাঁচ বছর বিনামূল্যে রেশনের প্রতিশ্রুতি মোদীর, সব গ্রাহকেরই কি লাভ হবে?

মেজর এসএস মেহতার বাহিনী

তারই মধ্যে মেজর এসএস মেহতার নেতৃত্বে ৬৩ গোলন্দাজ রেজিমেন্টের ৫টি স্কোয়াড্রন তিনটি বড় অভিযানে অংশ নিয়েছিল। সেই অভিযানগুলো চলেছিল আখাউড়া, আশুগঞ্জ এবং মেঘনা নদী পারাপারের সময়। গোলন্দাজ বাহিনীর এই স্কোয়াড্রনই যুদ্ধের শেষে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর, পাকিস্তান সেনার আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে ঢাকায় উপস্থিত ছিল। সামরিক ইতিহাসবিদ ক্যাপ্টেন ডিপি রামচন্দ্রনের মতে, ৬৩ গোলন্দাজ রেজিমেন্ট জরুরি ভিত্তিতে একটি স্কোয়াড্রন-সহ মোট পাঁচটি স্কোয়াড্রনকে যুদ্ধে নামিয়েছিল। যা চারটি সেক্টরে একযোগে কাজ করে। একযোগে সব ফ্রন্টে উপস্থিত থাকায় পাকিস্তান সেনা ৬৩ গোলন্দাজ রেজিমেন্টের নাম দিয়েছিল, 'দ্য ঘোস্ট রেজিমেন্ট'।

india pakistan Bangladesh Indian army
Advertisment