এমনটাই আশঙ্কা ছিল, কিন্তু তা যে এত দ্রুত হবে তা কেউ আশা করেননি। আমেরিকা আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার করার ঘোষণা করার ১০০ দিনের মধ্যে তালিবানরা দখল নিয়ে নিল আফগান ভূমের। রাজধানী কাবুলে তালিবানরা ঝড়ের গতিতে প্রবেশ করতেই গদিচ্যুত হন প্রেসিডেন্ট আসরাফ ঘানি। তারপরই হেলিকপ্টার ভর্তি টাকা, বিদেশি গাড়ি নিয়ে দেশ ছেড়ে পালান ঘানি।
পাকিস্তানি মদতপুষ্ট তালিবানরা আগের থেকেও অনেক ভয়ঙ্কর ও শক্তিশালী। এর আঁচ পেয়েছিলেন মার্কিন-পুতুল রাষ্ট্রপতি আসরাফ ঘানি। নাহলে এতদিনেও তালিবানদের সঙ্গে শান্তি-সমঝোতায় কেন ব্যর্থ হতেন। গদি যাচ্ছেই ধরে নিয়েছিলেন ঘানি। তাই রবিবার কাবুলে তালিবানরা ঢুকে পড়তেই ক্ষমতা হস্তান্তরে দেরি করেননি ঘানি। পরে পালিয়ে গিয়ে ফেসবুকে মহানতা দেখিয়ে লেখেন, রক্তপাত রুখতেই দেশ ছেড়েছেন তিনি। কথা হল, তিনি কি আদৌ তা রুখতে পেরেছেন? গত কয়েকদিনে কত নিরীহ আফগান নাগরিক ও সেনা মারা গিয়েছেন তা কি তিনি জানেন?
আসল কথা হল, মৃত্যুভয় গ্রাস করেছিল ঘানিকে। আরও একজনের চরম পরিণতি মাথায় ঘুরছিল তাঁর। তিনি হলেন প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট মহম্মদ নাজিবুল্লা। ১৯৯২ সালে যখন মুজাহিদিনরা কাবুলে ঘিরে ফেলে তখন নাজিবুল্লাও পালানোর চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু পারেননি। সোভিয়েত সমর্থিত আফগান শাসক নাজিবুল্লার পরিণতি আচ্ছা আচ্ছা কঠোর মানসিকতার রাষ্ট্রনায়কেরও শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত নামিয়ে দেবে।
কে এই মহম্মদ নাজিবুল্লা
কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিক্যাল পড়ুয়া, পাশতুন নেতা নাজিবুল্লা আফগান ইতিহাসে অন্যতম ট্র্যাজিক নায়ক। কলেজ জীবনে বামপন্থী দল পিপলস ডেমোক্র্যাটিক পার্টি অফ আফগানিস্তানের সদস্য হিসাবে রাজনীতিতে পদার্পণ। ১৯৭৮ সালে পিডিপিএ ক্ষমতায় আসে আফগানিস্তানে। তবে নাজিবুল্লার আসল উত্থান হয় ঠিক এক বছর পর সাবেক সোভিয়েত রাশিয়া আফগানিস্তানের দখল নিতেই। আফগান গুপ্তচর সংস্থা খাদ-এর প্রধান করা হয় তাঁকে। যার নিয়ন্ত্রণ ছিল রাশিয়ার কেজিবি-র হাতে। এরপর ১৪ বছর সময়কালে ধীরে ধীরে মার্ক্সীয় ঘরানা থেকে বেরিয়ে এসে আফগান জাতীয়তাবাদী হয়ে ওঠেন নাজিবুল্লা।
১৯৮৭ সালে মস্কো তাঁকে রাষ্ট্রপতি পদে বসায়। এরপর সোভিয়েত ইউনিয়নে গ্লাসনস্তের প্রবাহ বইছে, আফগানিস্তানে রেড আর্মি পাকাপাকি ভাবে ঘাঁটি গেড়ে ফেলেছে, সেইসময় নাজিবুল্লা বুঝতে পারলেন, এই ভাবে সরকার চালানো সম্ভব নয়। যেভাবেই হোক সোভিয়েত ছত্রছায়া থেকে বেরতে হবে। ন্যাশনাল রিকনসিলিয়েশন পলিসির মাধ্যমে দেশে সংস্কারের পথে হাঁটলেন নাজিবুল্লা। প্রাক-কমিউনিস্ট জমানার রিপাবলিক অফ আফগানিস্তান নামে ফিরিয়ে আনলেন দেশকে। ১৯৭৮-৮৭ পর্যন্ত যা ছিল গণপ্রজাতন্ত্রী আফগানিস্তান। ইসলামকে দেশের প্রধান ধর্মে হিসাবে ঘোষণা করলেন। পিডিপিএ পরিবর্তিত হল হেজব-এ-ওয়াতন পার্টিতে। যাতে ইসলামিক মুজাহিদিনদের খুশি করা যায়। কিন্তু সেই চেষ্টা বিফলে যায়।
কেন নাজিবুল্লা পালাতে ব্যর্থ হন
১৯৯২ সালে মুজাহিদিনরা যখন কাবুলের দখল নিচ্ছে, নাজিবুল্লা ইস্তফা দেন। এপ্রিলে এক মিশনের মাধ্যমে নাজিবুল্লাকে বের করে আনতে ব্যর্থ হয় ভারত। ভারতীয় রাষ্ট্রদূতের গাড়িতে করে কাবুল এয়ারপোর্টে যাওয়ার চেষ্টা বিফলে যায়। বিমানবন্দরের বাইরে গাড়ি থামায় গার্ডরা। তাও আবার আবদুল রশিদ দোস্তামের নির্দেশে। পশ্চিমি ভাষায়, নাজিবুল্লার হাতে গড়া ওয়ারলর্ড দোস্তাম। কিন্তু পরে টাকার জন্য দল বদল করেন দোস্তাম। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর আফগানিস্তানে টাকার স্রোত বন্ধ হয়ে যায়। নাজিবুল্লার অনেক খাস দোস্ত, পোষা গার্ড বিশ্বাসঘাতকতা করে টাকার জন্য। ততদিনে তাঁর পরিবার আগেই দিল্লিতে পালিয়ে বেঁচেছে।
রানওয়েত নাজিবুল্লার জন্য অপেক্ষারত বিমান। তাতে বসে আছেন রাষ্ট্রসংঘের দূত। কিন্তু বাইরে গার্ডদের সঙ্গে তর্কাতর্কি করছেন নাজিবুল্লা। তাঁরা কিছুতেই প্রাক্তন প্রেসিডেন্টকে ভিতরে ঢুকতে দেবেন না। এমনকী প্যালেসেও ফিরতে দিতে নারাজ। এরপর গাড়ি তাঁকে নিয়ে চলে যায় রাষ্ট্রসংঘের অফিসে যেখানে নাজিবুল্লাকে সাড়ে চার বছর গৃহবন্দি থাকতে হবে।
১৯৯৬ সালে ফের পট পরিবর্তন আফগানিস্তানে। মুজাহিদিনদের সঙ্গে দীর্ঘ চার বছর গৃহযুদ্ধের পর আফগানিস্তানের দখল নেয় তালিবানরা। আহমেদ শাহ মাসুদের পলাতক বাহিনীর কাছ থেকে কাবুলের দখল নেয় তালিবানরা। নাজিবুল্লা এবং তাঁর ভাই আরও দুই সঙ্গী রাষ্ট্রসংঘের অফিসে তখন গৃহবন্দি দশায়।
এরপর কী হল
মাসুদ পালানোর আগে নাজিবুল্লাকে উত্তরে গোপন আস্তানায় নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দেন। কিন্তু তাতে রাজি হননি নাজিবুল্লা। পাশতুন গোষ্ঠী তালিবানদের সঙ্গে সমঝোতা করবে, এই আশায় ছিলেন নাজিবুল্লা। একজন তাজিক নেতার সঙ্গে উত্তরে পালানো সঠিক কাজ বলে মনে হয়নি তাঁর। ততক্ষণে দেরি হয়ে গিয়েছে। রাষ্ট্রসংঘের অফিসে তালিবানদের একটা ছোট দল ঢুকে পড়ে। তাতে ছদ্মবেশে কয়েক জন আইএসআই অফিসারও ছিল। নাজিবুল্লা ও তাঁর ভাইকে ব্যাপক মারধর করে ওরা। তারপর জিপের সঙ্গে বেঁধে ঘোরায়, লিঙ্গচ্ছেদ করে, গুলিতে ঝাঁঝরা করে দিয়ে রাষ্ট্রপতির প্রাসাদের বাইরে একটি ল্যাম্পপোস্টে ঝুলিয়ে দেয় তালিবানরা।
কাবুল তথা আফগানিস্তানের বাসিন্দাদের জন্য একটা ভয়ঙ্কর বার্তা দিতে চেয়েছিল তালিবানরা। নাজিবুল্লাকে মেরে ঝুলিয়ে সেই কাজটাই করে তারা। সেই হিংসাত্মক ঘটনা গোটা বিশ্বকে নাড়িয়ে দেয়। সৌদির মতো দেশও এই হত্যাকে ইসলাম-বিরোধী বলে নিন্দা করে তখন। যারা কিনা তালিবানদের বন্ধু। সেদিনের সেই নারকীয় স্মৃতি থেকেই আর প্রাণের ঝুঁকি নেননি ঘানি। নাজিবুল্লার পরিণতি চাননি বলেই হয়তো টাকা-গাড়ি আর ঐশ্বর্য নিয়ে দেশ থেকে পালান তিনি। কথায় আছে না, আপনি বাঁচলে বাপের নাম…