আসামের লোকসভা ভোটে ২০১৪ সালে ১৪ টি আসনের মধ্যে সাতটি পেয়েছিল বিজেপি। ২০১৯ সালে তারা পেয়েছে ৯টি আসন। এর ফলে দুটি প্রশ্ন সামনে আসছে। এক) নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল নিয়ে বিজেপি এ রাজ্যে যে ব্যাপক বিরোধিতার মুখে পড়েছিল, তা সত্ত্বেও কীভাবে তারা ভাল ফল করল? এবং বিজেপির ভোট শেয়ার ২০১৪ সালে ছিল ৩৬.৮৬ শতাংশ। এবার তা কমে দাঁড়িয়েছে ৩৬.০৫ শতাংশে। তাহলে তাদের দুটি আসন বাড়ল কীভাবে?
প্রথম প্রশ্নের উত্তর নিহিত আছে জনবিন্যাসে। আসামের মন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা বলেছিলেন, "নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল বিজেপিকে ভোটারদের মধ্যে মেরুকরণ ঘটাতে সাহায্য করবে। যেসব এলাকায় বিলের পক্ষে সমর্থন ছিল, সেখানে বিজেপির তরফে ভোট পড়েছে, এটা স্পষ্ট। যেখানে বিল বিরুদ্ধতার মুখে পড়েছে, সেখানেও বিজেপি ব্যাপক লাভ করেছে। কিন্তু তার সঙ্গে আরও কিছু বিষয় কাজ করেছে।"
দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর আছে অঙ্কে। বিজেপির ৩৬.৮৬ শতাংশ ভোটশেয়ার ২০১৪ সালে এসেছে ১৪টির মধ্যে ১৩টি আসনে। এদিকে বিজেপি এবার যে ১০টি আসনে প্রার্থী দিয়েছে, তাতে তারা পেয়েছে ৩৬.০৫ শতাংশ ভোট। যদি রাজ্যভিত্তিত ভোটশেয়ার বিজেপি যে আসনগুলিতে লড়েছে, তার ভিত্তিতে হিসেব করা হয়, তাহলে দেথা যাবে ২০১৪ সালে ১৩টি আসনে প্রার্থী দিয়ে তারা পেয়েছিল ৪০.১৫ শতাংশ ভোট, এবার ১০টি আসনে প্রার্থী দিয়ে তারা পেয়েছে ৫৪.৩১ শতাংশ ভোট।
যে চারটি আসনে বিজেপি প্রার্থী দেয়নি, সেগুলি ছিল দুর্বল আসন। তাদের সহযোগী অগপ এবং বোড়োল্যান্ড পিপলস ফ্রন্ট চারটি আসনেই হেরেছে। যদি তাদের ভোটশেয়ারও হিসেব করা হয়, তাহলে এনডিএ ১৪ আসনে পেয়েছে ৪৬.৭৬ শতাংশ ভোট।
আসামের দুটি ভৌগোলিক এলাকার মধ্যে বরাক উপত্যকার দুটি আসনে মূলত বাঙালির বাস, যার মধ্যে হিন্দু ও মুসলিম দুই-ই রয়েছে। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় ১১টি আসন রয়েছে, যা উজান আসাম ও নমনি আসামে বিভক্ত। এর মধ্যে মিশ্র জনবিন্যাস রয়েছে যা ভৌগোলিক অবস্থানের সঙ্গে পরিবর্তিত হয়ে থাকে। সবচেয়ে নিচের দুটি আসন, ধুবড়ি ও বরপেটায় মূলত মুসলিমদের বাস, যাঁদের অধিকাংশই বাঙালি বংশোদ্ভূত। এই দুই এলাকার মধ্য়ে রয়েছে চতুর্দশ আসন, যা সরকারি ভাবে স্বশাসিত জেলা বলে পরিচিত হলেও মানুষ তাকে চেনেন দিফু নামে।
বিজেপি ২০১৪ সালে যে সাতটি আসন জিতেছিল, তার সবকটিই ছিল ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার। এবার তার মধ্যে ৬টি আসন ধরে রাখতে পেরেছে তারা, একটি আসন (নগাঁও) হারিয়েছে কংগ্রেসের কাছে। আবার উল্টোদিকে দিফু আসনটি কংগ্রেসের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে তারা। এবার তাদের অতিরিক্ত আসন দুটি এসেছে বরাক উপত্যকার থেকে, যার একটি ছিল এআইডিইউএফের দখলে, অন্যটি কংগ্রেসের দখলে।
বরাক উপত্যকা
নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলের বিরোধিতা এসেছে মূলত ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাসিন্দা অসমিয়া ভাষী সব ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে থেকেই। বরাক উপত্যকায় এই বিল সমর্থন পেয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। বাঙালি হিন্দুরা এই বিলের ব্যাপক সমর্থক, কারণ এ বিল বাংলাদেশ থেকে আগত হিন্দু উদ্বাস্তুদের (অন্য় দেশ এবং অন্য ধর্মের উদ্বাস্তু সহ) এদেশের নাগরিকত্ব পাওয়া সহজতর করবে। অন্যদিকে বরাক উপত্যকার বাঙালি মুসলমানরা এ বিলের বিরোধিতা করেছেন।
বরাক উপত্যকার শিলচরে বাঙালি হিন্দুদের সংখ্যাধিক্য। এখান থেকে হেরে গেছেন কংগ্রেস সাংসদ সুস্মিতা দেব। ২০১৪ সালে সুস্মিতার কাছে পরাজিত বিজেপি নেতা কবীন্দ্র পুরকায়স্থর কথায়, রাজ্য়সভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলে বিজেপি এ বিল আনার ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। বাংলাদেশ থেকে উদ্বাস্তুরা আসামে এসে বসবাস করছেন এবং তাঁরা এ দেশের নাগরিকত্ব চান। তাঁদের সাহায্য করবে এ বিল।
সুস্মিতা এবং তাঁর এবারের বিজেপি প্রতিদ্বন্দ্বী, দুপক্ষেরই ভোট বেড়েছে, তবে সংখ্যা দেখে মনে হচ্ছে বাঙালি হিন্দু ভোটের একটা বড় অংশ হারিয়েছেন তিনি। ২০১৪ সালে এআইডিইউএফ বাঙালি মুসলিমদের ভোট চেয়েছিল, পেয়েছিল ১০ শতাংশ ভোট। এবার তাদের অনুপস্থিতিতে কংগ্রেসের ভোট ৪২ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ৪৪ শতাংশ, অন্যদিকে বিজেপি ৩৮ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ৫২ শতাংশ।
বরাক উপত্যকার অন্য আসন, করিমগঞ্জে বাঙালি মুসলিমরা সংখ্যায় বেশি, এবং এ আসন তফশিলি জাতিদের জন্য সংরক্ষিত। এখানে বিজেপি পেয়েছে ৪৫ শতাংশ ভোট, এআইইউডিএফ পেয়েছে ৪১ শতাংশ ভোট, কংগ্রেস পেয়েছে ১১ শতাংশ ভোট। বেশ কিছু মুসলিম ভোট এখানে এআইডিইউএফ থেকে কংগ্রেসে এসেছে।
ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা
বিজেপি ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় একটি আসন হারালেও গোটা এলাকায় তাদের লাভ হয়েছে ব্যাপক। হিমন্ত তেজপুর ও লখিমপুরের উদাহরণ দিচ্ছিলেন। তেজপুরে ২০১৪ সালে বিজেপি জিতেছিল ৮৬ হাজার ভোটে, এবার তারা জিতেছে ২.৪ লাখ ভোটে। লখিমপুরে তাদের মার্জিন বেড়েছে সাড়ে তিন লাখ।
এই জয়ের পিছনে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলের অবদান রয়েছে কিনা সে ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হলে হিমন্ত বলেন, "কংগ্রেস এটাকে হিন্দু জনগণের বিরুদ্ধে ইস্যু করলে মেরুকরণ হবেই।"
সহায়তা করেছে অন্য কতকগুলি বিষয়ও। ভোটের আগে ইন্ডিয়ান এক্সেপ্রেসে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল যে উজান আসামে দেশের দুটি দীর্ঘতম নদীসেতু, চা আদিবাসীদের জন্য বিভিন্ন প্রকল্প বড় সংখ্যক মানুষের চোখ টেনেছে। এ ছাড়া অগপ-র সঙ্গে জোটের একটা লক্ষ্য ছিল এ কথা প্রমাণ করা যে অসমিয়া জাতীয়তাবাদী ভোটারদের ভোট টানা, অন্যথায় যারা নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলের বিরুদ্ধে ভোট দিতেন।
তাহলে একটা আসন হারাল কীভাবে! হিমন্ত বলছেন নগাঁও আসন তাঁরা হেরেছেন জনসংখ্য়ার জন্য. তবে জনবিন্যাস নিয়ে আলোচনা করতে অস্বীকার করেছেন তিনি ("কারা আমাদের পক্ষে ভোট দিয়েছে, কারা দেয়নি তা বিশ্লেষণ করা উচিত নয়... সবকা সাথ, সবকা বিকাশ, সবকা বিশ্বাস")। ২০১১ সালের খতিয়ানে নগাঁও জেলায় মুসলিম জনসংখ্যা ৫৫.৩৬ শতাংশ। এ লোকসভা কেন্দ্রে অন্তর্গত ৯টি বিধানসভা আসনের মধ্যে ৬টিতে বিজেপি এগিয়ে থাকলেও অন্য ক্ষেত্রগুলিই ফলাফল স্থির করে দিয়েছে। হিমন্তের কথায়, যমুনামুখ এবং লাহারিয়াঘাটে ফারাক খুব বড় ছিল। শুধু যমুনামুখেই কংগ্রেস এক লক্ষের বেশি ভোটে এগিয়ে থেকেছে। নগাঁওয়ের ভোটের ফল নির্ধারিত হয়েছে ১৭ হাজারেরও কম ভোটে।