দেশজোড়া বিতর্ক, চরম অনিশ্চয়তা এবং আশঙ্কার আবহে শেষ পর্যন্ত শনিবার প্রকাশিত হল আসাম নাগরিকপঞ্জির চূড়ান্ত তালিকা। প্রায় ৩.৩০ কোটি আবেদনকারীর মধ্যে থেকে ৩.১১ কোটি স্থান পেয়েছেন তালিকায়, আর নাম বাদ পড়েছে কমবেশি ১৯ লক্ষ মানুষের। কিন্তু, চূড়ান্ত তালিকা তথা 'আপডেটেড' এনআরসি থেকে বাদ পড়া এই ১৯ লক্ষ মানুষের তাহলে পরিচয় কী এবং তাঁরা এবার কোথায় যাবেন?
কেন 'আপডেটেড' এনআরসি বলা হচ্ছে?
আজ নয়, সেই ১৯৫১ সালেই আসামে নাগরিকপঞ্জি বা এনআরসি চালু হয়েছে। ভারতের একমাত্র রাজ্য হিসাবে কেবল আসামেই এই মুহূর্তে এনআরসি আছে। সাবেক পূর্ববঙ্গ এবং পরবর্তীকালে পূর্ব পাকিস্তান তথা আজকের বাংলাদেশ থেকে কয়েক দশক ধরে বহু মানুষ চলে এসেছেন আসামে। সে জন্যই ১৯৫১ সালের জনগণনার উপর ভিত্তি করে সে রাজ্যের নাগরিকদের চিহ্নিত করতেই এই ব্যবস্থা। বর্তমানে যে প্রক্রিয়াটি চলছে তার মাধ্যমে অতীতের সেই নাগরিকপঞ্জিকেই পরিমার্জিত তথা আপডেট করা হচ্ছে।
১৯৮৫ সালের আসাম চুক্তির প্রেক্ষিতেই সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে ও নজরদারিতে নাগরিকপঞ্জির এই সাম্প্রতিক 'আপডেট' হচ্ছে। ১৯৮৫ সালের আসাম চুক্তি অনুযায়ী, ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চকে নির্ণায়ক দিন হিসাবে স্থির করা হয়েছিল। অর্থাৎ, ওই দিনটির আগে যাঁরা আসামে এসেছেন, তাঁদের নাগরিক হিসাবে বৈধতা দেওয়া হবে।
আরও পড়ুন- বিজেপি খুশি নয়, আসাম এনআরসি থেকে কেন এত কম মানুষ বাদ পড়লেন, প্রশ্ন বিশ্বশর্মার
গত বছর কি তাহলে 'আপডেটেড' এনআরসি ছিল না?
২০১৮ সালের জুলাই মাসে যা প্রকাশিত হয়েছিল তা ছিল আসামের জাতীয় নাগরিকপঞ্জির খসড়া। সেই খসড়া তালিকায় ২.৮৯ কোটি আবেদনকারীর নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল, আর বাদ পড়েছিলেন ৪০ লক্ষ মানুষ। এই খসড়ায় যাঁরা বাদ পড়েছিলেন, তাঁরা ফের আবেদন করার সুযোগ পেয়েছিলেন। এমনকী, সেই খসড়ায় অন্তর্ভুক্তি ঘটেছিল এমন নামের ক্ষেত্রে যদি কারও আপত্তি থাকে (অন্যায্যভাবে নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছে এমনটা মনে করলে), সে ক্ষেত্রে তাও জানানোর সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। চলতি বছরের গোড়ার দিকে এনআরসি কর্তৃপক্ষ ১ লক্ষ নামের একটি অতিরিক্ত তালিকা প্রকাশ করে যেগুলি পূর্ববর্তী খসড়ায় স্থান পেয়েছিল কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাদ পড়বে বলে স্থির হয়। শনিবার প্রকাশিত এনআরসি-র চূড়ান্ত তালিকা এই সব অন্তর্ভুক্তি এবং বাদ পড়ার পূর্ণাঙ্গ প্রতিফলন।
আরও পড়ুন- ‘কাউকে দেশ থেকে বের করে দেওয়াটা উদ্দেশ্য নয়’ বললেন নাগরিক পঞ্জীর নেপথ্য নায়ক
এই ১৯ লক্ষ মানুষ কি তবে অবৈধ অভিবাসী?
এক কথায় 'না'। এই ১৯ লক্ষ মানুষ ফের আবেদন করার সুযোগ পাবেন। চূড়ান্ত এনআরসি তালিকা থেকে বাদ পড়ার প্রত্যায়িত কপি এবং যে কারণে তাঁরা ভারতীয় নাগরিক বলে দাবি করছেন, সেই নথি নিয়ে একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তাঁদের ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে যোগাযোগ করতে হবে। এই মুহূর্তে সচল ১০০টি ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালের পাশাপাশি আরও ২০০টি ট্রাইব্যুনাল শীঘ্রই চালু করা হবে বলে জানিয়েছে আসাম সরকারের আধিকারিকরা। সংশ্লিষ্ট আবেদনকারী যদি ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে হেরে যান, সে ক্ষেত্রে তিনি হাইকোর্ট এবং পরে প্রয়োজন হলে সুপ্রিম কোর্টেও আবেদন করতে পারবেন। তবে চূড়ান্ত এনআরসি তালিকায় নাম না থাকা আবেদনকারী যদি ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালেও পরাজিত হন, সে ক্ষেত্রে তাঁকে সম্ভাব্য গ্রেফতারির সম্মুখীন হতে হতে পারে এবং ডিটেনশন ক্যাম্পেও পাঠানো হতে পারে।
তালিকাছুটরা কীভাবে অন্তর্ভুক্তির আবেদন জানাতে পারবেন?
তালিকা থেকে যাঁরা বাদ পড়েছেন, তাঁদের প্রমাণ দিতে হবে যে তাঁরা বা তাঁদের পূর্বপুরুষ ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চ বা এর আগে ভারতের নাগরিক ছিলেন। ১৯৮৫ সালে ভারত সরকার-আসাম রাজ্য এবংঅল আসাম স্টুডেন্টস ইউনিয়নের মধ্যে স্বাক্ষরিত 'আসাম চুক্তি' অনুযায়ী ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চকেই নির্ণায়ক দিন হিসাবে ধার্য করা হয়। বাংলাদেশ থেকে আসামে আসার এই স্রোতের বিরুদ্ধে দীর্ঘ ৬ বছরের আন্দোলনের পর আসাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল।
১৯৫১ সালের এনআরসি-তে নাম থাকা মানুষরা স্বাভাবিকভাবেই আপডেটেড তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হবেন। একইভাবে সেই তালিকায় নাম থাকা নাগরিকদের বংশধররা বা ১৯৫১ সালের এনআরসি-তে নাম ছিল অথচ এখন মৃত, এমন ব্যক্তিদের উত্তরপুরুষরা যদি পূর্বপুরুষদের সঙ্গে সম্পর্কের নথি দেখাতে পারেন, সে ক্ষেত্রে তাঁরাও আপডেটেড তালিকায় স্থান পাবেন। তবে, আপডেটেড তালিকায় অন্তর্ভুক্তির জন্য ১৯৫১ সালের এনআরসি-তে নাম থাকা মোটেই বাধ্যতামূলক নয়। আসাম চুক্তি অনুযায়ী, ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চ পর্যন্ত যাঁরা ভারতে ভোট দিয়েছেন, তাঁরা এবং তাঁদের উত্তরপুরুষরাও আপডেটেড এনআরসি-তে অন্তর্ভুক্ত হতে পারবেন। এছাড়াও জন্মের শংসাপত্র, জমির দলিল ইত্যাদির মতো একাধিক নথিও গ্রাহ্য হবে, তবে এই সব নথিই ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চের দিন বা এর আগে ইস্যু করা কি না তা দেখা হবে।
আরও পড়ুন- আসাম এনআরসি: নাম নেই ‘বিদেশী’ সুবেদার সানাউল্লাহ ও তাঁর তিন সন্তানের
তালিকাছুট ১৯ লক্ষ মানুষ কি ইতিমধ্যে এসব নথি জমা দেননি?
যেহেতু, ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চের সাপেক্ষে যাঁরা নাগরিকত্বের প্রমাণ দিতে পেরেছেন, তাঁদেরকেই এনআরসি-তে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, তাই মনে করা হচ্ছে তালিকাছুট ১৯ লক্ষের জমা করা নথি নির্ণায়ক দিনটির নিরিখে নাগরিকত্ব প্রমাণে যথেষ্ট ছিল না। তবে যেসব নথি জমা দেওয়ার পরও তালিকাছুট হতে হয়েছে, সেই নথিগুলিই যদি দ্বিতীয়বার ফের জমা দেওয়া হয়, সে ক্ষেত্রে সমস্যার সম্মুখীন হবেন এই প্রায় ১৯ লক্ষ মানুষ। যেসব নথি তাঁরা ইতিমধ্যে জমা দিয়েছিলেন (এবং এরপরও তালিকাছুট হয়েছেন), সেগুলির পরিবর্তে এবার অন্যান্য নথি জোগাড় করতে হবে তাঁদের।
যদি তালিকাছুটরা আইনিভাবে দাবি প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হন, তবে কি তাঁদের দেশান্তরিত করা হবে?
দেশান্তরিত করার দাবিকে সামনে রেখে আসাম আন্দোলন সংঘটিত হলেও, বাংলাদেশ কখনও সরকারিভাবে মেনে নেয়নি যে তাঁদের নাগরিকরা বেআইনিভাবে আসামে চলে গিয়েছেন। আসামে এখন অবৈধ অভিবাসীদের রাখার জন্য মোট ৬টি ডিটেনশন ক্যাম্প রয়েছে (এর থেকেও বেশি ক্যাম্প তৈরির জমি রয়েছে সেখানে)। এরপর ৩০০০ জনকে রাখার মতো সপ্তম ডিটেনশন ক্যাম্পটি তৈরি করার প্রস্তাবও গৃহীত হয়েছে। কিন্তু, এরপরও লক্ষাধিক তালিকাছুটকে ডিটেনশন ক্যাম্পে রাখা সম্ভব নয়।
আরও পড়ুন- আসাম এনআরসি: নাম নেই ‘বিদেশী’ সুবেদার সানাউল্লাহ ও তাঁর তিন সন্তানের
ডিটেনশন ক্যম্পে রাখা বা দেশান্তরিত করা না হলেও চূড়ান্ত তালিকাছুটদের শেষ পর্যন্ত কী হবে?
তাঁরা সরকারিভাবে 'অনাগরিক' ('নন-সিটিজেন') হয়ে থাকবেন। তবে তাঁদের ঠিক কী করা হবে তা অনিশ্চিত। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক সূত্রে জানা যায়, 'রাষ্ট্রহীন'দের ক্ষেত্রে ভারতের কোনও সুনির্দিষ্ট নীতি নেই। শুধু একটি বিষয়ই কমবেশি স্পষ্ট যে এই 'রাষ্ট্রহীন'দের ভোটাধিকার থাকবে না। তাঁদের কাজ, বাসস্থান, সরকারি স্বাস্থ্য এবং শিক্ষার অধিকার সম্পর্কে এখনও পর্যন্ত কিছুই স্পষ্ট হয়। আসামের একাংশের পরামর্শ, এঁদের 'ওয়ার্ক পারমিট' দেওয়া হোক। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক সূত্রে খবর, এ বিষয়টি তাদের বিবেচনাধীন, তবে সমাজের একাংশ আবার এমন প্রস্তাবিত ব্যবস্থার বিরোধিতাও করছে প্রবলভাবে।
আরও পড়ুন- ত্রুটিপূর্ণ এনআরসি বানিয়েছেন হাজেলা, সরকারকে এটা বদলাতে হবে: কবীন্দ্র
কিন্তু, উদ্বাস্তুদের জন্য কি ভারতের কোনও নীতি নেই?
'রাষ্ট্রহীন' এবং 'উদ্বাস্তু' এক বিষয় নয়। তিব্বত, শ্রীলঙ্কা (তামিল) এবং পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসা উদ্বাস্তুরা ভারতে আছেন। এঁদের মধ্যে কেবল পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগতরাই লোকসভা নির্বাচনে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন, কিন্তু, বিধানসভা নির্বাচনে ভোট দিতে পারেন না।
Read the full Explained in English