অভিনেতা সুশান্ত সিং রাজপুতের মৃত্যুর পর মানসিক স্বাস্থ্য ও সংবেদনশীলতা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। তবে ভারতীয় দণ্ডবিধিতে ৩০৯ ধারায় আত্মহত্যার চেষ্টায় শাস্তিদানের প্রাচীন বিধি এখনও টিকে রয়েছে, তা নিয়ে যতই আপত্তি উঠুক না কেন। এমনকি এ আইনের অপব্যবহার নিয়ে বহু রিপোর্ট আসার পরও আইন লাগু থেকেছে।
৩০৯ ধারা কার বিরুদ্ধে প্রয়োগ করা যায়? এর শাস্তি কী? কেন এ আইন শুরু হয়েছিল?
আত্মহত্যার চেষ্টার পর বেঁচে গেলে তাঁর বিরুদ্ধে ৩০৯ ধারায় মামলা করা যায়।
যদি কেউ আত্মহত্যার চেষ্টা করেন বা তেমন অপরাধের দিকে অগ্রসর হন, তাহলে তাঁর এক বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড (বা জরিমানা, বা উভয়ই) হতে পারে।
উনিশ শতকে ব্রিটিশরা এই আইন লাগু করে, সে সময়ে মনে করা হত, হত্যা বা হত্যার চেষ্টা রাষ্ট্র তথা ধর্মবিরোধী কাজ।
কিন্তু কয়েকবছর আগে এই ধারা বাতিল হয়ে গিয়েছিল না?
না, এই ধারা ভারতীয় দণ্ডবিধিতে বহাল। ২০১৭ সালের মানসিক স্বাস্থ্য আইন, যা ২০১৮ সালের জুলাই মাসে কার্যকর হয়, তাতে ৩০৯ ধারার প্রয়োগ সীমিত করা হয়েছিল এবং আত্মহত্যার চেষ্টাকে কেবলমাত্র ব্যতিক্রমী হিসেবে শাস্তিযোগ্য করা হয়। মানসিক স্বাস্থ্য আইনের ১১৫ (১) ধারায় বলা হয়, কোনও ব্যক্তি যদি আত্মহত্যার চেষ্টা করেন তাহলে অন্য কোনও তথ্য না পাওয়া গেলে ধরে নিতে হবে ওই ব্যক্তি ব্যাপক চাপের মুখে ছিলেন এবং তাঁকে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০৯ ধারায় বিচার করা বা শাস্তি দেওয়া চলবে না।
১১৫ (২) ধারায় বলা হয়েছে, ব্যাপক চাপ ও ওই ব্যক্তির ফের আত্মহত্যার চেষ্টার সম্ভাবনা হ্রাস করতে সংশ্লিষ্ট সরকারের ওই ব্যক্তিকে যত্ন, চিকিৎসা ও পুনর্বাসন দেওয়া কর্তব্য।
কিন্তু এ থেকে তো মনে হচ্ছে ধারা বাতিলই হয়ে গিয়েছে, সে যতই দণ্ডবিধিতে রয়ে যাক না কেন?
ঠিক তা নয়। এই বিধিনিষেধ সবটাই কার্যকর মানসিক স্বাস্থ্য আইনের আওতায়, এবং সারা দেশ জুড়ে পুলিশ এই আইন কার্যকর করে চলেছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে।
সাম্প্রতিক এক ঘটনায় গত ৮ জুন এক পলাতক তরুণতরুণী বেঙ্গালুরুর অশোকনগর থানা এলাকায় চুলের ডাই খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। স্থানীয় সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে এঁদের বিরুদ্ধে ৩০৯ ধারায় অভিযোগ আনা হয়। ২০ মে, গুরগাঁওয়ের ভোন্ডসি জেলের এক বাসিন্দা কাঁচি দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন, তাঁর বিরুদ্ধে ৩০৯ ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে।
পুলিশ আধিকারিকরা বলেছেন বেশ কিছু ক্ষেত্রে থানা পর্যায়ের আধিকারিকদের মধ্যে অপেক্ষাকৃত নতুন মানসিক স্বাস্থ্য আইন নিয়ে সচেতনতা নেই, তাঁরা সোজাসুজি ভারতীয় দণ্ডবিধির আশ্রয় নেন। তবে ৩০৯ ধারার অভিযোগ পরবর্তীকালে বরিষ্ঠ আধিকারিকদের সঙ্গে আলোচনার পর সরিয়ে নেওয়া হয় বলে জানিয়েছেন বিডের পুলিশ সুপার হর্ষ পোদ্দার।
এই আইনের ব্যবহারে কী সমস্যা হতে পারে?
চেন্নাইয়ের মনস্তত্ত্ববিদ ডক্টর লক্ষ্মী বিজয়কুমার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার Network on Suicide Research and Prevention-এরও সদস্য। তিনি বলেন এই ধারা প্রয়োগের ফলে আত্মহত্যার চেষ্টা যিনি করেছিলেন তাঁর চিকিৎসায় দেরি হতে পারে, কারণ হাসপাতালগুলি মেডিকো-লিগ্যাল কেসের ক্ষেত্রে পুলিশের সবুজ সংকেতের দিকে তাকিয়ে থাকে।
অসৎ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ পুলিশের কাছে ঘটনা না জানানোর শর্তে অতিরিক্ত অর্থ নিতে পারে, এবং পুলিশের দুর্নীতিপরায়ণ আধিকারিকও এরকম ক্ষেত্রে টাকা পয়সা নিতে পারেন। এ সবের সঙ্গেই যুক্ত হবে ইতিমধ্যেই ট্রমার মধ্যে থাকা রোগীর ও তাঁর পাশের লোকজনের উপর মানসিক পীড়নের দিকও। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পৃথিবীর মাত্র ২৪টি দেশের আইনে এ রকম ধারা রয়েছে।
এর কি অন্য দিকও রয়েছে?
সেরকম একটা সম্ভাবনা রয়েছে বলেই ২-১৭ সালের মানসিক স্বাস্থ্য আইনের সঙ্গেই বিরাজ করছে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০৯ ধারা।
নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক এক বরিষ্ঠ পুলিশ আধিকারিক বলেন, “অনেক সময়ে মানুষ সরকারি দফতরে এসে নিজেদের দাবি পূরণ না হলে আত্মহত্যার হুমকি দেন। এরকম ক্ষেত্রে যেখানে ওই ব্যক্তির আত্মহত্যার কোনও ইচ্ছা নেই, কেবলমাত্র ব্যবস্থাকে ব্ল্যাকমেল করার জন্য এই উপায়ের আশ্রয় নেন, তেমন ক্ষেত্রে এই ধারা প্রয়োগ করা হয়ে থাকে।”
একজন বরিষ্ঠ আইপিএস অফিসার বলেন, ৩০৯ ধারা বাতিল হয়ে গেলে এ ধরনের ব্যক্তিদের বিরুদ্ধ ব্যবস্থা নেওয়ার কোনও উপায় থাকবে না। পুলিশ সুপার হর্ষ পোদ্দার বলেন, “৩০৯ ধারা পুনর্সংজ্ঞায়িত করা যেতে পারে যেখানে আইন শৃঙ্খলার ক্ষেত্রে এই বিধি প্রয়োগ করা যাবে কিন্তু সত্যিকারের মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যায় যাঁরা ভুগছেন, তাঁদের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যাবে না।”
অতীতে ৩০৯ ধারা বাতিলের কী ধরনের চেষ্টা করা হয়েছে?
এই আইন বাতিলের প্রয়াস চালাচ্ছেন ডক্টর বিজয় কুমার। তিনি বলেন, এ প্রক্রিয়া দীর্ঘদিন যাবৎ চলছে। ১৯৭১ সালে আইন কমিশন ৪২ তম রিপোর্টে এই ধারা বাতিলের সুপারিশ করে। ১৯৭৮ সালে তা রাজ্যসভায় পাশ হলেও লোকসভায় পাশ হওয়ার আগে অধিবেশন সংসদ ভেঙে যায়, ফলে বিল তামাদি হয়ে পড়ে।
১৯৯৬ সালে গিয়ান কাপুর বনাম পাঞ্জাব সরকার মামলায় সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চ ৩০৯ ধারার সাংবিধানিকতার পক্ষে রায় দেয়। তবে ২০০৮ সালে আইন কমিশন তাদের ২১০ তম রিপোর্টে বলে, আত্মহত্যার চেষ্টার ঘটনায় চিকিৎসা ও মানসিক যত্নের প্রয়োজন, শাস্তি নয়। ২০১১ সালে সুপ্রিম কোর্ট কেন্দ্রকে সুপারিশ করে, এই ধারা বাতিলের ব্যপারে বিবেচনা করা হোক।
২০১৪ সালে রাজ্যসভায় এক প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের রাষ্ট্রমন্ত্রী হরিভাই পারথিভাই চৌধরি বলেন সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভারতীয় দণ্ডবিধি থেকে ৩০৯ ধারা বাতিল করার। ১৮টি রাজ্য ৪ টি কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল আইন কমিশনের সুপারিশের পক্ষে মত দিয়েছে বলে জানান তিনি। তবে এখনও বিষয়টি আইনি মীমাংসায় পৌঁছয়নি।