Advertisment

বিশ্লেষণ: অযোধ্যা মামলায় বিচার্য বিষয়গুলি

এলাহাবাদ হাইকোর্টের ২০১০ সালের রায়ের ভিত্তিতে অযোধ্যা মামলার রায় দেবে সুপ্রিম কোর্ট। এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায়ের কোন কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সুপ্রিম কোর্টে পরীক্ষিত হল?

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

রাম জন্মভূমি-বাবরি মসজিদ নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায় বেরোতে চলেছে দ্রুতই। ২০১০ সালে এলাহাবাদ হাইকোর্টের তিন বেঞ্চের রায়ের বিরুদ্ধে আবেদনের ভিত্তিতে এই রায় দেবে শীর্ষ আদালত। বিচারপতি শিবগত উল্লা খান, বিচারপতি ধরমবীর শর্মা এবং বিচারপতি সুধীর আগরওয়াল রায় দিয়েছিলেন, অযোধ্যার বিতর্কিত ২.৭৭ একর জমি ভগবান রামলালা বিরাজমন, নির্মোহী আখড়া এবং সুন্নি সেন্ট্রাল ওয়াকফ বোর্ডের মধ্যে সমান তিন ভাগে ভাগ করে দেওয়া হোক।

Advertisment

এই রায় দেবার সময়ে এলাহাবাদ হাইকোর্ট এই মামলার সঙ্গে যুক্ত ৩০টি প্রশ্নের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ৮টি বিষয় দেখেছিল। যে আটটি বিষয়ে হাইকোর্ট আলোচনা করেছিল, যা সুপ্রিম কোর্টের আবেদনের কেন্দ্রীয় বিষয়ও বটে, সেগুলি একবার দেখে নেওয়া যাক।

আরও পড়ুন, পরবর্তী প্রধান বিচারপতি এস এ বোবদে: কে তিনি?

১৯৮৯ সালে হিন্দু পক্ষ রামলালা বিরাজমন যে দাবি করেছিল তা কি সময়সীমায় আবদ্ধ?

তামাদি আইন অনুসারে কোনও পক্ষকে ৬ বছরের মধ্যে তাদের দাবি জানাতে হয়। এলাহাবাদ হাইকোর্টের তিন বিচারপতিই একমত হয়েছিল রামলালার তরফে যে দাবি করা হয়েছে তা সময়সীমায় আবদধ নয়। তাঁরা বলেছিলেন, যদি এ মামলা তেমনই হত, তাহলে দেওয়ানি কার্যবিধিতে সমস্ত বিষয়ে আদালতকে সমস্ত বিষয়ে রায় ঘোষণ করতে হত, প্রাথমিক বিষয়গুলিতে যা-ই জানা যাক না কেন।  নির্মোহী আখড়া এবং সুন্নি ওয়াকফ বোর্ডের দুটি মামলা সময়সীমা আবদ্ধ বলে স্থির হয়।

১৮৮৫ সালের মামলায় কি জমির অধিকারের বিষয়টি সমাধিত?

১৮৮৫ সালে মহান্ত রঘুবর দাস রাম চবুতরা এলকায় একটি মন্দির বানানোর অনুমতি চান। বাবরি মসজিদের মুতাওয়ালি মহম্মদ আশগর এর বিরোধিতা করেন। তিনি জমির কয়েক ইঞ্চির এদিক ওদিক নিয়ে আপত্তি তুললেও তেমন আপত্তি জানাননি। মামলা খারিজ হয়ে যায়, আদালত বলেছিল ওই এলাকায় মন্দির বানানোর অনুমতি দিলে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে দাঙ্গা বাধবার সম্ভাবনা থাকবে।

রামলালার তরফ থেকে যুক্তি দেওয়া হয়েছে ১৮৮৫ সালের মামলা এমন একটি বিষয় নির্ধারিত করে দিয়েছে, যা নিয়ে ফের কোনও বিচার হতে পারে না। ২০১০ সালে বিচারপতি খান বলেন, ওই নির্দেশ ছিল স্থিতাবস্থা বজায় রাখার নির্দেশ এবং সেথান থেকে কোনও আইনি বিষয় নির্ধারিত হয়নি, যার জেরে মুসলিম পক্ষ বাঁধা পড়ে গিয়েছেন। বিচারপতি শর্মা বলেন, মহান্ত এবং মুতাওয়ালি সমস্ত পক্ষের হয়ে মামলা করেছেন এমনটা বলা চলে না, ফলে ওই রায়ে কোনও পক্ষই বাঁধা পড়ে নেই।

সৌধ কবে গঠিত হয়েছিল, কে বানিয়েছিল, জমির মালিকানা কার ছিল?

হিন্দু পক্ষের দাবি, জমির মালিকানা সর্বদাই তাদের ছিল, ফৈজাবাদের জেলা শাসক ১৯৪৯ সালে ওই এলাকা সিল করে দেওয়ায় এবং জমি বাজেয়াপ্ত করায় তারা উৎখাত হয়। তাদের দাবি সম্রাট বাবর একটি মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। মুসলিম পক্ষের দাবি ১৫২৮ সালে মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন বাবরের সেনাপতি মীর বাকি। তিনি এই সম্পত্তি সুন্নি ওয়াকফ সম্পত্তি হিসেবে দান করেন, এবং তার পর থেকে তারাই এর অধিকারী।

আরও পড়ুন, সামনেই অযোধ্যা রায়, দলীয় নেতাদের জন্য আচরণবিধি জারি বিজেপির

বিচারপতি খান এবং বিচারপতি আগরওয়াল বলেছিলেন দুটি দাবির কোনওটির সপক্ষেই পুরোপুরি প্রমাণ মেলেনি। বিচারপতি খান ইউরোপিয় ভূগোলবিদ জোসেফ টিফেনথালার-এর ১৭৮৬ সালের ভাষ্যের উপর নির্ভর করে বলেছিলেন এই কাঠামো তৈরি হয়েছিল ১৭৮৬ সালের আগে, কিন্তু তা যে ১৫২৮ সালে নির্মিত, তার কোনও ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই। বিচারপতি শর্মা বলেছিলেন, বাবরের নির্দেশে এর নির্মাণ করেছিলেন মীর বাকি, কিন্তু তা যে ১৫২৮ সালেই ঘটেছিল, তার কোনও সুনির্দিষ্ট প্রমাণ মেলেনি।

এ মসজিদ কি প্রাচীন কোনও হিন্দু মন্দিরস্থলে বানানো হয়েছিল?

এলাহাবাদ হাইকোর্টের তিন বিচারপতি এ ব্যাপারে ভিন্ন মত ধারণ করেছিলেন। বিচারপতি খান বলেছিলেন, মসজিদ নির্মাণের জন্য কোনও মন্দির ধ্বংস করা হয়নি, মসজিদ নির্মিত হয়েছিল দীর্ঘদিন ধরে শায়িত মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের উপর এবং মসজিদ বানানোর জন্য তার কিছু উপাদান ব্যবহৃতও হয়েছিল। তিনি বলেন, হিন্দুরা আগে বিশ্বাস করত যে বিতর্কিত বিশাল এলাকার ক্ষুদ্র একটি স্থানে রাম জন্মেছিলেন, যার জেরে হিন্দুরা বিশ্বাস করতে শুরু করেন গোটা বিতর্কিত এলাকাই রামের জন্মভূমি। বিচারপতি খান বলেন, ১৮৫৫ সালের আগেও রাম চবুতরা এবং সীতা রসুইয়ের অস্তিত্ব ছিল এবং হিন্দুরা সেখানে প্রার্থনা করতেন। তাঁর এই বক্তব্যই গোটা জমি তিনভাগ করে দেওয়ার ভিত্তি।

বিচারপতি আগরওয়াল বলেন, সৌধ কেবলমাত্র মুসলিম সম্প্রদায়ের সদস্যরাই ব্যবহার করতেন না, এবং ১৮৫৬-৫৭ সালের পর বাইরের অংশ কেবলমাত্র হিন্দুরা ব্যবহার করতেন এবং ভেতরের অংশে দুই সম্প্রদায়ের মানুষই প্রার্থনা করতেন।

বিচারপতি শর্মা জোর দিয়ে বলেন, মসজিদ হিন্দু মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের উপর তৈরি হয়েছিল। ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর সৌধ ধ্বংসের পর আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া যেসব তথ্য পেয়েছিল তার উপর নির্ভর করে তিনি বলেন, যে ২৫৬টি খোদাই করা লেখা পাওয়া গিয়েছে, তার সবই একাদশ ও দ্বাদশ শতাব্দীতে দেবনাগরী ভাষায় লিখিত। এ ছাড়াও এএসআইয়ের প্রাক্তন ডিরেক্টর জেনারেল ডক্টর রাকেশ তিওয়ারির সাক্ষ্যের উপর নির্ভর করেছিলেন তিনি। রাকেশ তিওয়ারির মতে, একটি পুরনো মন্দির ধ্বংস করে সেখানে মসজিদ তৈরি করা হয়েছিল।

আরও পড়ুন, কেন পেগাসাস কাণ্ডে এবার আদালতে গেল হোয়াটসঅ্যাপ

১৯৪৯ সালের ২২-২৩ ডিসেম্বর কি সেখানে বিগ্রহ ও অন্যান্য পূজার উপকরণ নিয়ে যাওয়া হয়, না কি আগে থেকেই ওগুলি সেখানে ছিল?

বিচারপতি খান ও বিচারপতি শর্মা উভয়পক্ষই একমত হয়েছিলেন যে সেদিনই প্রথম ওখানে বিগ্রহ প্রতিষ্ঠিত হয়। বিচারপতি আগরওয়াল বলেন, বিগ্রহ প্রতিষ্ঠার নির্দিষ্ট দিন এখনও প্রমাণিত হয়নি। বিচারপতি আগরওয়াল বলেন, ২২ ডিসেম্বর ১৯৪৯-এর আগেও রাম চবুতরায় বাইরের আঙিনায় মূর্তি ছিল এর প্রমাণ রয়েছে।

বাইরের আঙিনার মধ্যে কি রাম চবুতরা, ভাণ্ডার এবং সীতা রসুই পড়ে? ১৯৯২ সালে কি এগুলিও ধ্বংস করা হয়েছিল?

১৮৮৫ এবং ১৯৫০ সালের মানচিত্রের উপর নির্ভর করে তিন বিচারপতিই একমত হন যে বাইরের আঙিনায় এই তিনটি কাঠামো ছিল। তিন পক্ষই মেনে নেয় যে ৬ ডিসেম্বর ১৯৯২ সালে এগুলি সবই ধ্বংস করা হয়।

সম্পত্তির মালিকানা কার ছিল, কার নামে ছিল?

বিচারপতি আগরওয়াল বলেন, মধ্যবর্তী চবুতরা কোনও নির্দিষ্ট পক্ষের নামে ছিল না। তিনি বলেন, বাইরের চবুতরায় হিন্দুদের প্রার্থনার অধিকার একশো বছরেরও বেশি সময় ধরে, কিন্তু ভেতরের চবুতরায় তেমন কিছু ছিল না।

বিচারপতি শর্মা বলেন, ওয়াকফ বোর্ডের রাজস্বের ভিত্তিতে এ কথা বলা যায় না যে সম্পত্তির অধিকার একমাত্র হিন্দুদেরই ছিল। তিনি বলেন, মসজিদের স্তম্ভের অনেক হিন্দু দেবদেবীর ছবি রয়েছে, যা থেকে বোঝা যায় এ সম্পত্তি একমাত্র মুসলিমদেরই ছিল না। তিনি বলেন, মুসলিমরা এই সম্পত্তির একক দাবি করতে পারে না, যেহেতু মুসলিম সহ সকলেই এ স্থান পরিদর্শন করছিলেন। তিনি বলেন হিন্দুরা প্রমাণ করতে পেরেছেন যে সৌধ গঠিত হবার পরেও তাঁরা সেখানে পুজো করতেন, এবং বাইরের চবুতরায় সম্পূর্ণ মালিকানা তাঁদেরই ছিল।

আরও পড়ুন, সানাউল হক: উত্তর প্রদেশের ছেলের আল কায়েদার উপমহাদেশীয় প্রধান হয়ে ওঠার কাহিনি

বিচারপতি খান বলেন, মুসলিমর একথা প্রমাণ করতে পারেননি যে বাবর এখানে মসজিদ বানানোর নির্দেশ দিলেও সে সম্পত্তি বাবরেরই ছিল। হিন্দুরাও এ কথা প্রমাণ করতে পারেননি যে মন্দির ধ্বংস করার পর গঠিত মসজিদ স্থলে কোনও নির্দিষ্ট মন্দির ছিল। তিনি বলেন, বিতর্কিত ভূমির বর্তমান এবং অতীত মালিকানা উভয় পক্ষেরই।

বাবরি মসজিদ কি যথার্থ কোনও মসজিদ?

বিচারপতি আগরওয়াল বলেন, ১৯৫০ সালে বর্তমান বিতর্ক ওঠার আগে অন্তত ২০০ থেকে ২৫০ বছরের বেশি সময় ধরে সৌধটি মসজিদ হিসেবেই পরিচিত ছিল। তিনি বলেন, যখনই হিন্দু পক্ষ মামলা করেছে, তখনই তারা এটিকে মসজিদ বলে উল্লেখ করেছে, এবং ১৯৫০ সাল পর্যন্ত এ ব্যাপারে কোনও বদল ঘটেনি।

বিচারপতি শর্মা বলেন, ঐতিহাসিক তথ্যের উপর নির্ভর করে বলা যায়, একটি মন্দির ধ্বংস করেই মসজিদ নির্মিত হয়েছিল। তিনি বলেন, উদ্ধার হওয়া ২৫৬টি প্রত্নসামগ্রী থেকে পুরোপুরি প্রমাণিত হয়েছে যে মসজিদ নির্মাণের সময়ে হিন্দু মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ ব্যবহৃত হয়েছে, যা ইসলামবিরোধী।

বিচারপতি খান বলেন, অন্য কারও জমির উপর নির্মিত হয়েছে বলে ওই মসজিদকে যথার্থ নয় বলে দেওয়া যায় না। তিনি বলেন, মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ দিয়ে মসজিদ নির্মাণ কাঙ্ক্ষিত নয়, কিন্তু তার জন্য আইনের চোখে কোনও মসজিদকে মসজিদ নয় বলে দেওয়া যেতে পারে না।

supreme court Ram Temple Babri Mosque Ayodhya
Advertisment