রামজন্মভূমির বিতর্কিত জমিতে মন্দির প্রতিষ্ঠা হবে। বিজেপির এই দাবি বহু দিনের। দাবির স্বপক্ষে ১৯৯০ সালে এলকে আদবাণীর নেতৃত্বে রাম রথয়াত্রা করে পদ্ম শিবির। সেই সময় গুজরাটে রাম রথযাত্রা অন্দোলনে সামিল হয়েছিলেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। কিন্তু, ওই সময়ে তাঁর ভূমিকা অতটা নজরে আসেনি। পরবর্তী সময়ে সেই মোদীই হলেন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী। জড়িয়ে পড়লেন গোধরা বিতর্কে। তাঁকে নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা কম হয়নি। কিন্তু, সংগঠনে বাজপেয়ী-আদবাণীদের পরবর্তী প্রজন্ম হিসাবে ক্রমেই উঠে এলেন নরেন্দ্র মোদী। হয়ে উঠলেন বিজেপির 'পোস্টার বয়'। আর আড়ালে নয়, এদিন তাঁর হাত ধরেই হল অযোধ্যার শিলান্যাস।
অযোধ্যার আন্দোলনকারী হিসাবে চিহ্নিত না হতে চাওয়া ও প্রধানমন্ত্রী মোদী
রামমন্দির নির্মাণের আন্দোলন বিজেপির আদর্শগত লড়াই। কিন্তু, মোদী যখন গুজরাট থেকে নয়াদিল্লির দিকে তাঁর রাজনৈতিক যাত্রাপথ শুরু করেছিলেন, তখন রাম মন্দির বা হিন্দুত্বের আদর্শগত অনুগামী হিসাবে নিজেকে পরিচিত করতে আগ্রহী ছিলেন না।
এমনকী ২০১৪ ও ২০১৯-শের লোকসভা ভোট প্রচারেও অযোধ্যা যাত্রাকে এড়িয়ে গিয়েছেন নরেন্দ্র মোদী। ২০১৪ সালে বিজেপি উত্তর প্রদেশ থেকে সর্বাধিক নির্বাচনী সাফল্যের প্রত্যাশা করেছিল। কিন্তু, সেবার প্রচারে অযোধ্যার খুব কাছে গেলেও রামনগরীতে পা পড়েনি বিজেপির এই 'পোস্টার বয়ের'। ২০১৯ সালেও প্রচারে অযোধ্যা যাননি মোদী। ওই বছর ১লা মে অযোধ্যা থেকে মাত্রা ২৭ কিলোমিটার দূরে গৌসাইনগঞ্জে প্রচারে গেলেও এড়িয়া যান অযোধ্যা।
২০১৯ সালের ৯ই নভেম্বর ঐতিহাসিক অযোধ্যা রায় দেয় সুপ্রিম কোর্ট। বিতর্কিত জমিতে রামমন্দির হবে বলে জানায় সর্বোচ্চ আদালত। তারপর থেকেই মোদীর অযোধ্যা নামে ছুঁতমার্গ দুর হওয়ার শুরু। সুপ্রিম নির্দেশের পর পরই প্রধানমন্ত্রী স্পষ্ট করে দেন, তিনি অযোধ্যায় নির্মাণ উদ্যোগের চালিকা শক্তি হিসাবে পরিচিত হতে চান।
চলতি বছর ৫ই ফেব্রুয়ারী হঠাই প্রধানমন্ত্রী সংসদে কেন্দ্রীয় ক্যাবিনেটের সিদ্ধান্ত তুলে ধরেন। তিনি জানান, রামমন্দির নির্মাণের জন্য সরকার একটি ট্রাস্ট গঠন করছে। 'গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিক'এই ঘোষণা অত্যন্ত তাৎপর্যবাহী। এতদিন বিজেরির আদর্শগত দাবি বাস্তবে পরিণত করতে প্রশানিক ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। জম্মু-কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা রদ থেকে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল পেশ- সর্বক্ষেত্রেই অগ্রগণ্য ভূমিকায় দেখায় গিয়েছে শাহকে। কিন্তু, এই প্রথম বদল লক্ষ্য করা গেল।
লোকসভায় মোদী বলেছিলেন, 'রামমন্দির নির্মাণের জন্য স্বাধীন একটি ট্রাস্ট গঠন করা হল, যার নাম রামজন্মভূমি তীর্থক্ষেত্র। এই ট্রাস্টই মন্দির নির্মাণের যাবতীয় সিদ্ধান্ত নেবে।' তিক্ততা ঝেড়ে ফেলে দেশবাসীকে নতুন ভারত গড়ার আর্জি জানান প্রধানমন্ত্রী।
বিজেপির এক কার্যকর্তা জানিয়েছেন মোদী এর আগে কখনই রামজন্মভূমি আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। কার্যকর্তার কথা অনুযায়ী, 'রথযাত্রার নেতৃত্বে আদবাণীজীর পরেই ছিলেন স্বর্গীয় প্রমোদ মহাজন। তবে, মোদী ১৯৯১ সালে মুরলী মনোহর যোশীর নেতৃত্বে কন্যাকুমারী থেকে কাশ্মীর পর্যন্ত একতা যাত্রায় সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন। আদালতে বিচারাধীন মামলা অযোধ্যার আন্দোলনকারী হিসাবে কখনই পরিচিত হতে চাননি নরেন্দ্র মোদী। জাতীয়স্তরের রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার পর এটা তাঁর সচেতন সিদ্ধান্ত ছিল।'
বিজেপি, গুজরাট দাঙ্গা ও মোদী
১৯৮৪ সালের লোকসভা ভোটে অত্যন্ত হতাশজনক ফলাফল হয় বিজেপির। মাত্র দু'টি আসন পেয়েছিল পদ্ম শিবির। ঘুরে দাঁড়াতে মন্দির ইস্যুকে আঁকড়ে ধরে এই দল। ধাত্রী সংগঠন আরএসএস ও বিজেপি সিদ্ধান্ত নেয়- জাতীয়স্তরে পরিচিতি লাভ ও নির্বাচনী সাফল্যের জন্য রামমন্দির ইস্যুকেই তুলে ধরা হবে। এতে সাফল্যও আসে। ১৯৮৯ সালের লোকসভা ভোটে ৮৯ আসন পায় গেরুয়া দলটি।
এলকে আদবাণীর নেতৃত্বে রথযাত্রার সময় নরেন্দ্র মোদী বিজেপির জাতীয় নির্বাচনী কমিটির সদস্য ছিলেন। সেই সময় রথযাত্রা সোমনাথ থেকে মুম্বই পর্যন্ত সমন্বয়ের দায়িত্ব সামলেচ্ছেন তিনি। কিন্তু, কেশুভাই প্যাটেল, শঙ্করসিং বাঘেলা, কাশীরাম রানার প্রতাপে অপেক্ষাকৃত তরণ মোদীর ভূমিকা সেই সময়ে চাপা পড়ে যায়। তবে, ২০০২ সালে গুজরাট দাঙ্গা সবকিছু অদলবদল করে দেয়।
গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী পদের দায়িত্বভার নেওয়ার একমাসের মধ্যে (২৭ ফেব্রুয়ারী, ২০০২) গোধরায় ট্রেনের মধ্যে অযোধ্যার কর-সেবকরা আক্রান্ত হন। ৫৯ কর-সেবককে পুড়িয়ে মারার অভিযোগ ওঠে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে গুজরাট দাঙ্গার সূচনা। হাজারেরও বেশি মানুষ সেই দাঙ্গায় প্রাণ হারান। এদের মধ্যে বেশিরভাগই মুসলমান। মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী যদিও দাবী করেছিলেন যে, দাঙ্গা বন্ধে তিনি যাবতীয় প্রচেষ্টা করেছিলেন। তবে, তাঁর সমালোচকদের অভিযোগ, মুখ্যমন্ত্রী দাঙ্গা রুখতে সবচেয়ে বেশি উদাসীন ছিলেন।
গুজরাটের দাঙ্গা দেশে হিন্দু এবং মুসলমানদের মধ্যে গভীর মেরুকরণ করেছিল এবং মোদীর ভাবমূর্তির উপর দাগ ফেলেছিল। এই দাঙ্গা নিয়ে বিরোধী শিবির মোদীকে বারংবার আক্রমণ শানিয়েছে। এমনকী ২০০৭ সালে গুজরাট ভোটে সোনিয়া গান্ধী তাঁকে 'মত কা সওদাগর' বলেও অ্যাখ্যায়িত করেন। এইসবের কারণে জোটসঙ্গী নীতীশ কুমারের সঙ্গে বিজেপির সাময়িক দূরত্ব তৈরি হয়।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের একাংশ ২০০৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে অটল বিহারী বাজপেয়ীর অপ্রত্যাশিত পরাজয়কে গুজরাটের দাঙ্গার কারণ হিসাবে মনে করেছেন। বাজপেয়ীও টিভিতে স্বীকার করে বলেছিলেন, 'জাতীয়স্তরে গুজরাট দাঙ্গার প্রভাব পড়েছে অত্যন্ত বেশই, ঘটনার পরেই মোদীকে সরানো উচিত ছিল।' যদিও আদবাণী মোদীর প্রতি প্রবল সমালোচনাকে গুজরাট দাঙ্গা নিয়ে 'অপপ্রচারের ফল' বলেই বর্ণনা করেছিলেন।
উত্থানের কাহিনী
তাঁকে ঘিরে প্রবল সমালোচনা। এর মাঝেই মোদী বলেছিলেন যে, 'আমি আমার উপর নিক্ষেপ করা পাথরগুলি উত্থানের সিঁড়ি হিসাবে ব্যবহার করেছি।' যে কারণে তিনি নিন্দিত হয়েছিলেন পরে সেই গুজরাট দাঙ্গাই তাঁকে সর্বোচ্চ শিখরে আহোরণের সহায়ক হল। হিন্দুত্বের ধারক হয়ে উঠলেন মোদী। তাঁর নেতৃত্বেই হিন্দু ভোট বিজেপিতে কেন্দ্রীভূত হল।
যদিও হিন্দুত্বকে আকড়ে নয়, উল্টে উন্নয়নকে হাতিয়ার করেই ২০১৪ সালের লোকসভায় প্রচার চালায় মোদী ও বিজেপি। 'সংস্কৃতিক ঐতিহ্য' বলে রামমন্দির ইস্যুকে ইস্তেহারের রাখলেও তাকে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। বলা হয়েছিল, অযোধ্যাতে রাম মন্দির নির্মাণের জন্য সংবিধানের কাঠামোর মধ্যে থেকে সমস্ত সম্ভাবনা বিজেপি পর্যালোচনা করবে।
তবে, হিন্দু অনুভূতি চাগিয়ে তুলতে মন্দির ইস্যু ছাড়তে পারেনি বিজেপি। ২০১৭ সালে উত্তরপ্রদেশ ভোট জয়ের লক্ষ্যে রামমন্দির ইস্যু পদ্ম বাহিনীর তরুপের তাস হয়ে ওঠে। একেই উস্কে দিয়েছিল কেন্দ্রের মোদী সরকার। উত্তরপ্রদেশ ভোটের আগেই অযোধ্যায় রামায়ণ মিউজিয়াম গড়ার ঘোষণা করা হয়। ২০১৯ সালে লোকসভা ভোটের আগে যখন বিশ্ব হিন্দু পরিষদ মন্দির নির্মাণের কথা বলবে তখন কেন্দ্র বিতর্কিত জমির বাইরে অ-বিতর্কিত জমিতে স্থিতিশীল অবস্থা প্রত্যাহার ও উদ্বৃত্ত জমি প্রকৃত মালিকদের হাতে তুলবে দেওয়ার জন্য আবেদন জানায় সুপ্রিম কোর্টে।
Read in English
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন