বাবরি মসজিদ ধ্বংসের সময়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিব ছিলেন মাধব গোড়বোলে। পুনের বাসিন্দা গোড়বোলে ১৯৮০ ও ১৯৯০-এর শুরুর দিকে বিচার সচিব এবং প্রশাসনের বেশ কিছু উঁচু পদে কাজ করেছেন। অল্প কিছুদিন হল The Babri Masjid-Ram Mandir Dilemma: An Acid Test for India’s Constitution শীর্ষক একটি বই লিখেছেন তিনি। তাঁর সঙ্গে কথোপকথনের কিছু নির্বাচিত অংশ।
বাবরি মসজিদ রাম জন্মভূমি সংকট এবং বাবরি মসজিদ ধ্বংস নিয়ে আপনার মূলগত অবস্থান কী?
বাবরি মসজিদ ধ্বংস আইনের শাসন সম্পূর্ণ ভেঙে পড়াকেই শুধু সূচিত করে না, একই সঙ্গে এর ফলে ভেঙে পড়ে সংবিধানও। বাবরি ধ্বংস আটকাতে পারতেন তিনজন প্রধানমন্ত্রী, রাজীব গান্ধী, ভিপি সিং এবং পিভি নরসীমা রাও। যদি এঁরা সমস্যা সমাধানে যথাযথভাবে হস্তক্ষেপ করতেন তাহলে এ ঘটনা এড়ানো যেত।
আরও পড়ুন, বিশ্লেষণ: অযোধ্যা মামলায় বিচার্য বিষয়গুলি
কেন্দ্রীয় সরকার, রাজ্য সরকার, রাজ্যপাল, বিচারবিভাগ এবং আইএএস ও আইপিএস-এর মত অল ইন্ডিয়া সার্ভিস তাদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছিল। এমনকি বাবরি ধ্বংসের পর, হিন্দু ও মুসলিম এই দুই সম্প্রদায়ের অবস্থান বদলায়নি, যেন সময় থমকে দাঁড়িয়ে আছে। যদি অযোধ্যার মত আরেকটা ভয়াবহ ঘটনা ঘটে তাহলে ১৯৯২ সালে বাবরি ধ্বংসের পর ভারতের অবস্থা যেমন নড়বড়ে হয়ে গিয়েছিল, তেমনটাই হবে।
রাম জন্মভূমি আন্দোলনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত বেশ কয়েকজন এখন সরকারের বিভিন্ন পদে রয়েছেন। এর ফলে কি রায় প্রভাবিত হবে?
আদর্শ পরিস্থিতিতে সংবিধানের নীতি, বোধ এবং মূল্যবোধ তুলে ধরার জন্য কোন রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকে তাতে কিছু এসে যায় না। কারণ যেই ক্ষমতায় আসুক, তাকে সংবিধানের উপর সত্যিকারের আস্থা রাখতে হয় এবং ভারতের সার্বভৌমত্ব ও সংহতি বজায় রাখতে হয়।
কিন্তু এ কাজ করার চাইতে বলা সহজ। সংবিধানের ভিত্তি যে ধর্মনিরপেক্ষতা, তাই প্রশ্নের মুখে পড়ে গিয়েছে। সিভিল সার্ভিস, যা আইনের শাসন তুলে ধরার জন্য সবচেয়ে প্রয়োজন, তাতে সাম্প্রদায়িকতা এবং রাজনীতি ঢুকে পড়েছে, যা অতীব উদ্বেগের বিষয়। একই সঙ্গে সিভিল সোসাইটি এবং সংবাদমাধ্যমের ভূমিকাও অতীব গুরুত্বপূর্ণ।
তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নরসীমা রাও উত্তর প্রদেশে বাবরি ধ্বংসের আগে ৩৫৫ ও ৩৫৬ ধারা জারি করেননি কেন? তেমনটা হলে কি বাবরি ধ্বংস ঠেকানো যেত?
প্রধানমন্ত্রী নরসীমা রাও মনে করতেন সংবিধানের ৩৫৬ ধারা প্রতিষেধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে গ্রহণ করা যায় না। সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে আমার মত ঠিক বিপরীত। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক ও আইন মন্ত্রকের সুপারিশ মেনে ৩৫৬ ধারা এবং ৩৫৫ ধারা প্রয়োগ করে যদি উত্তর প্রদেশে রাষ্ট্রপতির শাসন জারি করা হত তাহলে বাবরি ধ্বংস আটকানো যেত।
আরও পড়ুন, সামনেই অযোধ্যা রায়, দলীয় নেতাদের জন্য আচরণবিধি জারি বিজেপির
রাষ্ট্রপতির শাসন জারি না করে উত্তর প্রদেশের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী কল্যাণ সিংকে ফ্রি হ্যান্ড দিয়ে দেওয়া হল এবং তিনি তা কাজে লাগিয়ে আক্ষরিক অর্থে মসজিদ ধ্বংসের নেতৃত্ব দিলেন। আমি আমার বইয়ে বলেথি, ১৯৫০ সালে সংবিধান লাগু হবার পর ১০০র বেশি বার ৩৫৬ ধারা জারি করা হয়েছে। এটা এমন একটা উপলক্ষ ছিল যে সময়ে তার সম্পূর্ণ প্রয়োজন ছিল এবং দুর্ভাগ্যজনকভাবে তা কাজে লাগানো হয়নি।
আর কয়েকদিন পরেই সুপ্রিম কোর্টের রায়, এখন কোন দিকে দৃষ্টি দেওয়া দরকার?
রায় যাই হোক তাকে সম্মান করতে হবে এবং মেনে নিতে হবে- এ ব্যাপারে ব্যাপক জনমত তৈরি করতে হবে। জাতীয় স্তরে মতৈক্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জাতীয় সংহতি পরিষদের বৈঠক ডাকা যেতে পারে। একই সঙ্গে নির্দ্বিধায় কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারকে স্পষ্ট করতে হবে যে কোনও রকম আইন শৃঙ্খলাভঙ্গের বিষয় কড়া হাতে দমন করা হবে।
রায়ের পর ভারতের কী অবস্থা হবে বলে মনে হয়? এখানেই কি বিষয়টার শেষ, নাকি প্যান্ডোরার বাক্স খুলে যাবে?
সুপ্রিম কোর্ট ২৪ অক্টোবর ১৯৯৪-এর রায়ে স্পষ্ট বলে দিয়েছিল জাতীয় স্বার্থেই এই প্রক্রিয়া সমাপ্তিকালে কেউ পরাজিত হবে না, যার অর্থ অন্তিম রায়ে কারোরই ক্ষোভ থাকবে না। আদালত একই সঙ্গে বলেছিল, যদি এমন কোনও সমাধান না হয় যাতে সকল পক্ষই খুশি হতে পারবে, তাহলে আমরা ভারতের মানুষ-এর সুর বেজে উঠবে না। এ রায় অবশ্য ছিল যুযুধান পক্ষের মধ্যে সমঝোতার প্রত্যাশার প্রেক্ষিতে। আমি আমার বইয়েও একই ভাবে সমস্যা সমাধানের কথা বলেছি। আমি সত্যিই আশা করি শীর্ষ আদালতের রায়ের ফলে এমনটাই হবে।