অযোধ্যা রায়: মণ্ডল-করমণ্ডল রাজনীতির বৃত্ত সম্পূর্ণ
রাম মন্দিরের দাবি তোলা বিজেপির প্রভাব বাড়তে থাকে অবিভক্ত মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান এবং অবিভক্ত উত্তর প্রদেশে। অবিভক্ত উত্তরপ্রদেশ ও অবিভক্ত বিহারের মোট ১৩৯টি আসনে কার্যত ধুয়ে মুছে যায় কংগ্রেস।
রাম মন্দিরের দাবি তোলা বিজেপির প্রভাব বাড়তে থাকে অবিভক্ত মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান এবং অবিভক্ত উত্তর প্রদেশে। অবিভক্ত উত্তরপ্রদেশ ও অবিভক্ত বিহারের মোট ১৩৯টি আসনে কার্যত ধুয়ে মুছে যায় কংগ্রেস।
শনিবারের অযোধ্যা রায় ভারতীয় রাজনীতির কয়েক দশকের পুরনো এক ধরনের বৃত্ত সম্ভবত সম্পূর্ণ করল। সে রাজনীতি মণ্ডল-করমণ্ডলের। সম্ভবত এক নতুন পরস্থিতির তৈরিও হল এবার।
Advertisment
মণ্ডলের পক্ষাবলম্বী শক্তি- যাঁরা সামাজিক ন্যায়বিচার ও পরিচিতির রাজনীতির ধ্বজাধারী, তাঁরা এবারের লোকসভা ভোটে বিজেপির ব্যাপক জয়ের পর অস্তিত্বের সংকটে পড়েছেন। এবং সুপ্রিম কোর্টের রায়ে তিন দশক আগের করমণ্ডল অথবা হিন্দুত্বের রাজনীতি নিয়ে যে আইনি সংকট তাতে যবনিকা পড়েছে।
৮-এর দশকের শেষে ও ৯- এর দশকের গোড়ায় দুটি রাজনৈতিক শক্তিই কংগ্রেসের পুরনো রাজনীতিক ধরনকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছিল। যে ধাক্কা শতাব্দী প্রাচীন দল আর কখনওই সেভাবে সামলে উঠতে পারেনি। তার পর থেকে ৯টি লোকসভা ভোট হয়েছে, একটিতেও কংগ্রেস একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারেনি। অন্যদিকে এই ৯টি নির্বাচনের মধ্যে ৬টিতে মণ্ডল ও করমণ্ডল শক্তি সরকার গঠনের দিকে এগিয়েছে।
Advertisment
মণ্ডল রাজনীতির জাতি ভিত্তিক সংরক্ষণের দাবি ছিল পুরনো, অন্যদিকে বিজেপি প্রথম করমণ্ডলকে রাজনৈতিক অস্ত্রের জোগান দিয়েছে- ১৯৮৬ সালে রামজন্মভূমি ন্যাসের প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নিয়ে এসেছে তৈরি হওয়া সুযোগ কাজে লাগিয়েছে তারা।
জরুরি অবস্থা পরবর্তীতে জনতা সরকারের সমাজবাদী অংশ প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর বিরুদ্ধে দুর্নীতি ইস্যুতে লড়াইয়ে ভি পি সিংয়ের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল। অন্যদিকে ১৯৮৯ সালের ভোটের আগে হিমাচল প্রদেশের পালামপুর কনভেনশনে রাম মন্দিরের দাবি তুলেছিল বিজেপি।
রাজীব গান্ধী ক্ষমতাচ্যুত হবার পর এই শক্তিগুলি কংগ্রেসের ছেড়ে যাওয়া রাজনৈতিক শূন্যস্থান পূরণ করবার জন্য লড়াই শুরু করে। ভিপি সিং সরকারের সমাজবাদী অংশ জাতি ভিত্তিক সংরক্ষণের দাবিতে মুখর হয়। অন্যদিকে বিজেপি, যারা বাইরে থেকে সরকারকে সমর্থন করছিল, তারা রামমন্দিরের দাবিতে সরব হয়। ১৯৯০ সালে ভিপি সিং ওবিসি সম্প্রদায়ের সংরক্ষণের কথা ঘোষণা করার, এল কে আদবানির রথযাত্রা মণ্ডল নেতা লালু প্রসাদ এবং মুলায়ম সিং যাদবের সরাসরি সংঘাতের মুখে পড়ে।
রাজনীতির নতুন যুগ শুরু হল, মণ্ডল ও করমণ্ডল শব্দদ্বয় দেশের রাজনীতির অভিধানে জায়গা নিল, দুটি ধারণার মধ্যে দ্বন্দ্ব আরও তীব্র হল। বোফর্স ইস্যু- যা রাজীব গান্ধীকে ক্ষমতাচ্যুত করেছিল, তা পিছনে চলে গেল। হিন্দি বলয়ের রাজ্যগুলিতে কংগ্রেসের জায়গায় স্থান নিতে থাকল মণ্ডল ও করমণ্ডল।
বাবরি মসজিদ ধ্বংসের উত্তর প্রদেশে ও বিহারে কংগ্রেসের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। সামাজিক ন্যায়বিচার তথা পরিচিতির রাজনীতির নেতা বলে পরিচিত মুলায়ম, লালু, কাঁসিরামরা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করতে থাকেন, প্রভাব হারাতে থাকে কংগ্রেস। এদিকে রাম মন্দিরের দাবি তোলা বিজেপির প্রভাব বাড়তে থাকে অবিভক্ত মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান এবং অবিভক্ত উত্তর প্রদেশে। অবিভক্ত উত্তরপ্রদেশ ও অবিভক্ত বিহারের মোট ১৩৯টি আসনে কার্যত ধুয়ে মুছে যায় কংগ্রেস।
রাজনৈতিক লড়াইয়ে ধর্মনিরপক্ষতা বনাম সাম্প্রদায়িকতার ন্যারেটিভ নিয়ে এসে মণ্ডল শক্তিগুলির মধ্যে কিছুটা প্রভাব বিস্তার করে কংগ্রেস। এই কৌশলের ফলেই ১৯৯৬ সালে গঠিত প্রথম বিজেপি সরকারের স্থায়িত্ব ছিল মাত্র ১৩ দিন।
এর পর বিজেপিও তাদের কৌশল বদলায়। রাম মন্দির নিয়ে নিজেদের বক্তব্য কিছুটা পরিবর্তন করে তারা, ১৯৯৮ ও ১৯৯৯ সালে তারা মিত্রশক্তি অর্জন করে। তবে কংগ্রেস ফের ধর্মনিরপেক্ষতা বনাম সাম্প্রদায়িকত ইস্যু সামনে এনে বিজেপিকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত ক্ষমতার বাইরে রাখতে সক্ষম হয়।
করমণ্ডলের সীমাবদ্ধতা ২০০৯ সালে প্রকাশ্যে চলে এল, যখন এল কে আদবানির নেতৃত্বাধীন বিজেপি ১৯৯১ সাল থেকে সে সময়কালের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ ফল করল।
গোটা বিষয়টা নিজের রাজ্য গুজরাট থেকে থেকে দেখছিলেন নরেন্দ্র মোদী। বিজেপির হিন্দুত্বের রাজনীতির সঙ্গে আগ্রাসী জাতীয়তাবাদের মিশেলে সে রাজনীতির নতুন অর্থ দিলেন তিনি।২০০৭ সালে গুজরাট ভোটে জেনারেল পারভেজ মুসারফের বিরুদ্ধে কঠোর আক্রমণ করে তিনি আগেই হাত পাকিয়ে নিয়েছিলেন। লোকসবা ভোটে আদবানি নেতৃত্বাধীন বিজেপির পরাজয় জায়গা করে দিল করমণ্ডল ও জাতীয়তার যোগফলে গঠিত হিন্দুত্ব ২.০-র রাজনীতিকে।
বিজেপির কাছে শনিবারের ফল ৩০ বছর আগে ১৯৮৯ সালে পালামপুরে প্রস্তাবের পরিণতি প্রাপ্তি। অযোধ্যায় রাম মন্দিরের জন্য বিহারের দলিত কমলেশ্বর চোপালের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন ১৯৮৯ সালের ১০ নভেম্বর। অযোধ্যার রায় বেরোল সে ঘটনার ৩০ বছর পূর্তির আগের দিন।
এখন দেখার বিজেপি এবার সকলের জন্য এক আইন বিষয়ে তাদের যে প্রতিশ্রুতি, তা পালনে কতটা সক্রিয় হয়। ৩৭০ ধারা অবলুপ্তি, এনআরসি, এবং নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল ইঙ্গিত দিচ্ছে বিজেপি এখন করমণ্ডল ও জাতীয়তাবাদের মেলবন্ধন ঘটানোর নতুন পথে হাঁটতে চলেছে। ২০১৪ সাল থেকে বিজেপি দেখিয়ে দিচ্ছে মণ্ডলবাহিনী ভারতীয় রাজনীতির নতুন ধারায় কতটা অপ্রাসঙ্গিক। ২০১৯ সালের ভোটের ফল দেখিয়ে দিচ্ছে মণ্ডলবাদীদেরও নতুন পথের সন্ধান করতে হবে।