Advertisment

বিশ্লেষণ: বাংলা পক্ষ কি সত্যিই তৃণমূলের বি টিম?

গর্গ নিজে তৃণমূল ঘনিষ্ঠ ছিলেন, বাংলা পক্ষের পৃষ্ঠপোষকদের মধ্যে বড় অংশ এখনও তৃণমূলের সমর্থক।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Bangla Pokkho, Bengali Identity

২০১৮ সালের জানুয়ারি মাস নাগাদ বাংলা পক্ষ কাজ শুরু করে

মেট্রো স্টেশনে বাঙালি এক যুবকের হিন্দিভাষী সিআরপি কর্মীদের হাতে হেনস্থার প্রতিবাদে জমায়েত এবং মফস্বলের এক শহরে এক হিন্দিভাষী তরুণের বাঙালিবিদ্বেষী ফেসবুক পোস্টের প্রতিবাদে তার বাড়ি গিয়ে আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে গত কয়েকদিন ধরে বাংলাপক্ষ নামক সংগঠনের নাম সামনে উঠে এসেছে। বাংলাপক্ষ বেশি দিন তৈরি হয়নি। মাত্র বছর খানেক বয়সী এই সংগঠন বিভিন্ন কারণে বাংলার নানা মহলে সাড়া ফেলেছে।

Advertisment

বাংলা পক্ষের শুরু

২০১৮ সালের জানুয়ারি মাস নাগাদ বাংলা পক্ষ নামক সংগঠন কাজ শুরু করে। মূল মুখ হিসেবে সামনে ছিলেন ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিট্যুটের অধ্যাপক গর্গ চট্টোপাধ্যায়। বিভিন্ন জায়গায় খুব কম লোক নিয়ে হিন্দি আধিপত্যবিরোধী বিভিন্ন ইস্যুতে তাঁকে জমায়েত করতে দেখা যায়। একই সঙ্গে ইংরেজি ও বাংলা ভাষার টিভি চ্যানেলে তিনি তৃণমূল সমর্থক বক্তা হিসেবে প্রতিনিধিত্ব করেন। ইংরেজি টিভি চ্যানেলগুলিতে কোনও বক্তা হিন্দিতে কথা বললে তার প্রতিবাদে গর্গ বাংলায় তুমুল চিৎকৃত আপত্তির মাধ্যমে অনেকের নজরে আসেন।

আরও পড়ুন, বিশ্লেষণ: পেগাসাস স্পাইওয়ার ঠিক কী?

২০১৮ সালের এপ্রিল মাসে, বাংলা নববর্ষের দিন সোশাল মিডিয়ায় এবং ১৯ মে প্রেসক্লাবে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলা পক্ষ সরকারি ভাবে একটি দাবিসনদ প্রকাশ করে। সে দাবিসনদে দলমত নির্বিশেষে সমস্ত বাঙালিকে ৩০ দফা দাবিতে সোচ্চার হতে বলা হয়। এই দাবিসমূহ মূলত জাতীয় নীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। তার মধ্যে বাংলায় ৮৫ শতাংশ পশ্চিমবঙ্গবাসীর চাকরি সুনিশ্চিত করার দাবি যেমন রয়েছে, তেমনই রয়েছে সেনাবাহিনীতে বাংলা ব্যাটালিয়ন তৈরির দাবি এবং পশ্চিমবঙ্গের সিনেমা হলে অন্য ভাষার সিনেমায় বাংলা সাবটাইটেল তৈরির দাবিও।

শুরুর প্রভাবহীনতা, বিভিন্ন মহলে

বাংলা পক্ষের অন্যতম মুখ গর্গ চট্টোপাধ্যায় যেহেতু তৃণমূল সমর্থক হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠছিলেন, সেহেতু বাংলা পক্ষকে তৃণমূলের 'বি টিম' বলেই ধরে নেওয়া শুরু হয়েছিল। বাংলার তৃণমূল সমর্থকদের একাংশ কিছুটা সহযোগিতা করলেও, গর্গর সংগঠন বলে পরিচিত বাংলা পক্ষ ব্রাত্যই থেকে যাবে বলে মনে হচ্ছিল। কিন্তু গর্গ আবার ভাল ছাত্র, বিদেশের নানা নামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ডিগ্রিপ্রাপ্ত হওয়ায়, তাকে একেবারে উড়িয়েও দিচ্ছিলেন না কেউ কেউ, বিশেষ করে একসময়ে গর্গর সহপাঠী সমাজের এলিট অংশ।

বাংলা পক্ষ তাদের কার্যকারিতার দিক থেকে সবচেয়ে বেশি বিরোধিতা পেয়েছে বামপন্থীদের কাছ থেকে, অন্তত শুরুর দিকটায়। পরের দিকে হিন্দুত্ববাদীদের কাছ থেকেও তারা প্রতিরোধের মুখে পড়েছে, বিশেষ করে হিন্দি ভাষা ও হিন্দুত্ববাদের সঙ্গে যোগসাজশ আরও কঠোরভাবে সামনে আসার পর থেকে।

আরও পড়ুন, ইসলামিক স্টেটের নতুন প্রধান আবু ইব্রাহিম আল-হাশেমি আল-কুরেশি কে?

বাংলায় সিপিএম তথা বামপন্থীরা ভোট বা আন্দোলনের ক্ষেত্রে প্রায় কোনও জায়গা না পেলেও, তাদের সোশ্যাল মিডিয়ার সক্রিয়তা খুব কমেনি, বরং তাদের সক্রিয়তার বেশিরভাগটুকুই কেন্দ্রীভূত হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। এই অংশটি বাঙালি উগ্র জাতীয়তাবাদের উত্থান ঘটানোর অপচেষ্টার দায়ে বাংলা পক্ষকে কাঠগড়ায় তোলে।

বাংলা পক্ষের ধরন

বাংলা পক্ষ একই সঙ্গে বাংলার সংস্কৃতি তথা বাঙালি জাতীয়তার রক্ষাকর্তা হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে চায়।

কিন্তু বাংলা ভাষা, বাংলা সংস্কৃতি যেসব কারণে সারা ভারতে তথা সারা পৃথিবীতে পৃথক হয়ে থেকেছে, সেই কৃষ্টির ব্যাপারে তারা খুব তোয়াক্কা করেনি। গর্গ চট্টোপাধ্যায় নিজের সংগঠনের প্রচারের জন্য যেসব ফেসবুক লাইভ করেন, বা সোশাল মিডিয়া পোস্ট দেন, সেখানে তাঁর ভাষা একেবারেই রুক্ষ ও অমার্জিত বলে মনে হয়, যার সঙ্গে সাংস্কৃতিক বোধ ও রুচিসম্পন্ন মানুষেরা দূরত্ব রচনা করতে চান তো বটেই, একই সঙ্গে এই সংগঠনের বিরোধীও হয়ে ওঠেন এই ভাষাপ্রয়োগের জন্য। গর্গ নিজে কথা বলার সময়ে কখনও কখনও তাঁর বাক্য খেই হারিয়ে ফেলে বলেও মনে করেন তাঁর সমালোচকরা। বাংলা পক্ষের দলিল দস্তাবেজেও বিভিন্ন সময়ে ভুল বানান, ভুল ভাষার প্রয়োগ দেখা যায়। এসব নিয়ে সমালোচনা হলে সেগুলিকে পক্ষপাতিত্ব বলে উড়িয়ে দেওয়া বাংলা পক্ষের একটি চালু কৌশল।

বাংলা পক্ষের পদ্ধতি

পৃথক ও নিজস্ব আন্দোলনের সংস্কৃতি গঠনের চেষ্টার মধ্যে এখনও পর্যন্ত এ সংগঠন যায়নি। কোনও ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সঙ্গে সঙ্গে প্রতিক্রিয়া দেখানো তাদের চালু পদ্ধতি। প্রথমে উল্লিখিত দুটি ঘটনাই তার উদাহরণ। এ ছাড়া ব্যাঙ্কে বাংলা চালু করা, লোকাল ট্রেনের টিকিটে বাংলা ভাষার উল্লেখ, এ সবের দাবিতে তারা সোচ্চার হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। সম্প্রতি উঠে আসা এনআরসি ইস্যুতেও তারা বিভিন্ন জেলায় সভা সমাবেশ করছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ঠাকুরনগরে তাদের সভা, যে সভা অনুষ্ঠিত হয় তার কয়েকদিন আগেই একই ইস্যুতে সমাবেশ করতে গিয়ে বিজেপি সমর্থকদের হাতে একটি সংগঠন আক্রান্ত হওয়ার কয়েকদিন পরেই।

আরও পড়ুন, সরকারের বিরুদ্ধে কেন তথ্যের অধিকার আইন ধ্বংসের অভিযোগ আনলেন সোনিয়া গান্ধী?

কিন্তু আন্দোলনের ধরনে তারা একেবারেই গতানুগতিক, যে গতির সঙ্গে কিছুটা মিল পাওয়া যায় বিজেপি-র। বাংলা পক্ষের সমালোচকদের বক্তব্য, পুলওয়ামার ঘটনার পর, যেভাবে দক্ষিণপন্থীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে রাষ্ট্রের সমালোচকদের উপর চড়াও হচ্ছিলেন এবং তার লাইভ ফেসবুকে প্রচার করা হচ্ছিল, বাংলা পক্ষের সাম্প্রতিক ধারা সেদিকেই চলছে। মূলত বাম ও লিবারালদের দিক থেকে এই সমালোচনা উঠে আসছে। অন্যদিকে সর্বত্র হিন্দি ভাষা হঠানোর দাবিতে সোচ্চার বাংলা পক্ষ কেন উর্দু হঠাতে বলছে না, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন হিন্দুত্ববাদীদের একাংশ।

কিন্তু এসব সমালোচনাকে গুরুত্ব দিতে চাইছে না বাংলা পক্ষ। সংগঠনের এক নেতার কথায়, "আমরা যখন শুরু করেছিলাম, তখন যারা আমাদের সক্রিয় বিরোধিতা করেছিল, তাদের বড় অংশ এখন আমাদের সঙ্গে চলে এসেছে। আমরা আরও আগ্রাসী ভাবেই আমাদের আন্দোলন চালাব।"

বাংলা পক্ষের সংগঠন

সংগঠন কীভাবে চলে, সে নিয়ে বাংলা পক্ষের কোনও প্রকাশ্য নথি নেই। গঠনতন্ত্র বা কীভাবে সংগঠন তৈরি হয়, তার গঠন কী, এগুলি প্রকাশ্য নয় বলে জানিয়েছেন বাংলা পক্ষের কৌশিক মাইতি।

আরও পড়ুন, গুরুদাস দাশগুপ্ত: সংসদে নিপীড়িত মানুষের জোরালো কণ্ঠস্বর

যে কেউ সংগঠনের সহযোদ্ধা হতে পারেন, কিন্তু সদস্য হওয়া বেশ কঠিন। যাঁরা সদস্য পদ পেতে চান, তাঁদের কার্যকলাপের উপর বেশ কিছু সময় ধরে নজর রাখা হয় বলে জানিয়েছেন কৌশিক।

তবে, সাংগঠনিক দিক থেকে সম্প্রতি ধাক্কা খেয়েছে বাংলা পক্ষ। তাদের তরফে বিবৃতি দিয়ে ৬ জনকে বহিষ্কারের কথা ঘোষণা করা হয়েছে। এদিকে বহিষ্কৃত ৬ জন আবার বাংলা পক্ষ থেকে গর্গ, কৌশিক সহ ৬ জনকে বহিষ্কার করা হয়েছে বলে পাল্টা বিবৃতি দিয়েছেন।

বাংলা পক্ষের রাজনীতি, লক্ষ্য ও দিশা

এই জায়গায় সবচেয়ে বেশি গোলমাল দেখছেন অভিজ্ঞরা। বাংলা পক্ষের দাবি, বাংলায় বাংলাবাসী তথা বাংলাভাষীর অধিকার কায়েম করাই তাদের রাজনীতি। গর্গ নিজে তৃণমূল ঘনিষ্ঠ ছিলেন, বাংলা পক্ষের পৃষ্ঠপোষকদের মধ্যে বড় অংশ এখনও তৃণমূলের সমর্থক। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলের "তলানিতে ঠেকতে থাকা বিশ্বাসযোগ্যতা" কোনও অন্য ফ্রন্ট দিয়ে কিছুটা পুনরুদ্ধারের চেষ্টাতেই বাংলা পক্ষের শুরু বলে মনে করেন অনেকেই। কেউ কেউ আবার এক ধাপ এগিয়ে বলেন, উচ্চশিক্ষিত গর্গ চট্টোপাধ্যায় শিক্ষাক্ষেত্রে কোনও সুবিধা পাওয়ার জন্য এত সোচ্চার থাকেন। কিন্তু সে পরিস্থিতি পাল্টেছে। সম্প্রতি অভিযোগ উঠেছে, বাংলা পক্ষ জামাত-এ-ইসলামের ঘনিষ্ঠ। আবার এ-ও অভিযোগ উঠেছে, গর্গর সঙ্গে বৈঠক হয়েছে বিজেপির এক বড় নেতার। গর্গ নিজেই এক ফেসবুক লাইভে এ অভিযোগের উল্লেখ করে জানিয়েছেন, তাঁরা আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা করছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার আরও বাড়বে বলে মনে করছেন।

বাংলা পক্ষ তাদের ৩০ দফা দাবিসনদে সংবিধানের ৩৫৬ ধারা বাতিল করার দাবির সপক্ষে যে যুক্তি রেখেছে তা হলো, পশ্চিমবঙ্গের সরকারকে যাতে কেন্দ্রীয় সরকার না ফেলে দিতে পারে। অর্থাৎ তাদের দাবি অনুসারে, যদি ৩৫৬ ধারার মাধ্যমে অন্য রাজ্যের নির্বাচিত সরকারের পতন ঘটানো হয়, তা নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই।

বাংলা পক্ষ বিভিন্ন সমাবেশে ও প্রতিক্রিয়া আন্দোলনের সময়ে যে প্রসঙ্গ প্রায়শই উল্লেখ করে থাকে, তা হলো বাংলার অর্থনীতি অবাঙালিদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এই পরিস্থিতি কাটানোর জন্য, তাদের সবার আগের নিশানায় থাকেন বাংলায় বিহারের বাসিন্দারা। গর্গ চট্টোপাধ্যায়ের নিজের বক্তব্যে বারবার এদের দানাপুর প্যাসেঞ্জারে তুলে দেওয়ার হুমকি শোনা যায়। বাঙালিদের একাংশের মধ্যে এই দাবি অতীব জনপ্রিয়ও হয়েছে।

আরও পড়ুন, ইডেনে দিনরাতের টেস্ট: সন্ধের মুখে বেশি সুইং করবে গোলাপি বল

বিহার ও উত্তর প্রদেশের বাসিন্দাদের বিরুদ্ধে প্রাথমিক ক্ষোভের কারণ হিসেবে বাংলা পক্ষের কৌশিক মাইতির বক্তব্য, কম বেতনের এই চাকরিগুলি বাংলার ছেলেদের না দিয়ে বিহারিদের হাতে তুলে দেওয়ার মাধ্যমে বাংলাকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। বাঙালি হকারদের বদলে বিহার উত্তর প্রদেশের হকারদের জায়গা করে দেওয়া হচ্ছে, যার ফল ভুগছে সামর্থ্যহীন বাংলার ছেলেমেয়েরা। ফলে এদেরকেই প্রাথমিক নিশানা করা হচ্ছে। ক্রমশ বাংলার অর্থনীতি যাদের দখলে রয়েছে, তাদের উৎখাত করা হবে।

বাংলার বাণিজ্যপক্ষ নামে একটি সহযোগী মঞ্চও রয়েছে বাংলা পক্ষের। কিন্তু অর্থনীতি সম্পর্কিত তাদের ধারণা সে দস্তাবেজে অনুপস্থিত। বাংলার ব্যবসায়ীদের নিয়ে নেটওয়ার্ক তৈরির চেষ্টায় এই সংগঠন তৈরি করা হয়েছে বলে নথিতে জানানো হয়েছে।

অতি জাতীয়তাবাদের অভিযোগ

বাংলা পক্ষ বাল ঠাকরের শিবসেনার পথে চলছে বলে অভিযোগ করছেন অনেকেই। বাঙালি জাতীয়তাবাদের এত উগ্র মুখ বাঙালির সংস্কৃতির সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ নয় বলে মনে করছেন তাঁরা। বিশেষ করে মানকুণ্ডুর ঘটনায় বাড়ি গিয়ে চড়াও হয়ে এক ছাত্রের মায়ের উপর চাপ সৃষ্টি করে, তাঁকে দিয়ে ফেসবুক লাইভে ক্ষমা চাওয়ানোর ঘটনার সঙ্গে দক্ষিণপন্থীদের পন্থার মিল দেখতে পাচ্ছেন অনেকেই।

আরও পড়ুন, পরবর্তী প্রধান বিচারপতি এস এ বোবদে: কে তিনি?

এর সঙ্গেই যুক্ত হয়েছে নারীবিরোধী হওয়ার অভিযোগও। বাংলা পক্ষের বিভিন্ন নেতা-কর্মীদের, গর্গ চট্টোপাধ্যায় সহ, লেখা ও কথায় মহিলাদের সম্পর্কে এমন মনোভাব ব্যক্ত হয়েছে যা আধুনিক মনোভঙ্গির পরিপন্থী। লিবারালদের মধ্যে এ নিয়ে ব্যাপক বিক্ষোভ তৈরি হয়েছে।

হালকা চাল

বিষয়ের গভীরে না যাবার প্রবণতার অভিযোগ বাংলা পক্ষের বিরুদ্ধে বারবার উঠেছে। বাংলার অর্থনীতি বাঙালির হাতে দেওয়ার দাবি তুলে যেভাবে কম আয়ের বিহার উত্তর প্রদেশের বাংলাবাসীদের নিশানা করা হয়েছে, তাতে 'সফট টার্গেট' বেছে নেওয়ার সুবিধার কথা উঠে এসেছে। বড়বাজারের মত বাংলার অর্থনীতির যে প্রাণকেন্দ্র মারোয়াড়ি-গুজরাটিদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, সেখানে কোনও রকম ছাপ ফেলতে পারেনি তারা, এমনকি তেমন কোনও চেষ্টাও দেখা যায়নি।

এনআরসি নিয়ে সরব বাংলাপক্ষের নেতা গর্গ চট্টোপাধ্যায় সাম্প্রতিক এক ভিডিও সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ১৭ লক্ষ মানুষ এনআরসি থেকে বাদ পড়েছেন, এবং তাঁদের মধ্যে হিন্দু বাঙালি কতজন, তার সংখ্যাও দিয়েছেন। অথচ এনআরসি থেকে বাদ যাওয়া মানুষের সংখ্যা ১৯ লক্ষ এবং তার কোনও ডেমোগ্রাফিক বিশ্লেষণ সরকারি ভাবে পাওয়া যায় না।

গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বাংলা পক্ষের হালকা চাল এবং ভুল তথ্য প্রদান তাদের প্রশ্নের মুখে ফেলেছে।

তবু জনপ্রিয়

নানারকমের সমালোচনা ও ঘাটতি সত্ত্বেও বাংলা পক্ষ এক বছরের মধ্যে তাদের বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে নজরে আসতে সক্ষম হয়েছে, তাদের অবজ্ঞা করা যাচ্ছে না। তার মূল কারণ বাংলার কোণঠাসা অবস্থাকে এর আগে কোনও রাজনৈতিক দল বা সংগঠন তেমনভাবে বাজারজাত করতে পারেনি। এক সময়ে ভাষা ও চেতনা সমিতি সহ কয়েকটি সংগঠন সাইনবোর্ডে বাংলা লেখার দাবি সহ বেশ কিছু দাবিতে সোচ্চার হলেও, তা ছিল কলকাতা কেন্দ্রিক এবং এলিট দলভুক্ত। বাংলা পক্ষ বাংলার দাবিকে জেলায় জেলায় নিয়ে যেতে পেরেছে, বিভিন্ন ছোট বড় সমাবেশ করতে পেরেছে, এবং সোশ্যাল মিডিয়ার সৌজন্যে নিজেদের প্রাসঙ্গিক করতে পেরেছে। ট্রেনের মধ্যে কেউ বাঙালিকে কটু কথা বললে সেখানে লোক জমায়েত করে ফেসবুক লাইভ করা থেকে শুরু করে নানা ধরনের বোধগম্য পদ্ধতির আশ্রয় নিয়ে বাংলা ভাষীর কাছে সহজে পৌঁছে যেতে পেরেছে তারা। আবার রাজ্যের সমস্ত বিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা শেখানো বাধ্যতামূলক করার দাবি রাজনৈতিক দলমত নির্বিশেষে সকলের সমর্থন পেতে শুরু করেছে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ডোমিসাইল নীতি চালু করা নিয়ে তাদের আন্দোলন, এবং পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সে দাবি মেনে নেওয়াকে তাদের জয়ের মুকুটে পালক হিসেবেই দেখছেন বাংলা পক্ষের সমর্থকরা, এবং তাঁদের তীব্র সমালোচকরাও মেনে নিচ্ছেন সংগঠনের এই সাফল্যকে। এ ছাড়া এ রাজ্যে বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে বাংলা ভাষা চালু করার আন্দোলনও তাঁদের সাধারণ বাঙালিদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠার অন্যতম চাবিকাঠি বলে দাবি করছেন কৌশিক মাইতি।

আরও পড়ুন, কীভাবে মারা হল আই এস নেতা আল বাগদাদিকে?

একই সঙ্গে, তাদের সাহায্য করেছে ক্রমপরিবর্তনশীল বাস্তব পরিস্থিতি। বাংলায় ক্রমবর্ধমান অবাঙালি উপস্থিতি সর্বস্তরে বৃদ্ধি পেয়েছে, সে কথা স্পষ্ট দৃশ্যমান।

এ পরিস্থিতি বাংলা পক্ষের জনপ্রিয়তা এবং সংখ্যাগত বিকাশে সাহায্য করেছে। একই সঙ্গে গোটা দেশে আইডেন্টিটির রাজনীতির প্রাসঙ্গিকতা বৃদ্ধিও বাংলা পক্ষের সপক্ষে রয়েছে।

Advertisment