তৃণমূলে ‘মুষল-পর্ব’ চলছে! শুভেন্দু অধিকারীর তৃণমূল ত্য়াগ স্রেফ সময়ের অপেক্ষা! একুশের মহারণের মুখে অতিমারীর দাপটে কাবু বঙ্গভূমিতে ‘দলবদলের খেলা’ ঘিরে উথালপাতাল বঙ্গ রাজনীতি। শুভেন্দু অধিকারীর সঙ্গে তৃণমূলের সম্পর্কের বাঁধন আলগা হতেই মমতা বাহিনীর একাধিক নেতা-মন্ত্রীকে ‘বেসুরো’ হতে দেখা যাচ্ছে। আবার, তৃণমূলের সঙ্গে অসন্তোষ সামনে এনে পদ্ম পতাকা হাতে তুলে নিয়েছেন বিধায়ক মিহির গোস্বামী। বিজেপি শিবির থেকে প্রায়শই হুঙ্কার ধেয়ে আসছে, তৃণমূলের একাধিক নেতা-মন্ত্রী নাকি তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। এমন টানটান প্রেক্ষাপটে তুফান তুলেছে বঙ্গ রাজনীতি।
তৃণমূলের নেতা-মন্ত্রীরা যেভাবে বেসুরো হচ্ছেন, তাতে একুশের নির্বাচনের আগে দুর্গ রক্ষা করাও অন্য়তম বড় চ্য়ালেঞ্জ ঘাসফুল শিবিরের, এমনটাই মত রাজনৈতিক মহলের একাংশের। অথচ, ৩৪ বছরের বাম দুর্গ তছনছ করে বাংলায় পরিবর্তন আনা এই তৃণমূলেই অন্য় দলের নেতারা সাড়ম্বরে যোগদান দিয়েছেন একসময়। ২০১১ সালের পর ঘাসফুল শিবিরের জয়জয়াকারের সঙ্গে সঙ্গে বহু রাজনৈতিক নেতাই নিজেদের রাজনৈতিক আদর্শকে জলাঞ্জলি দিয়ে মমতার দলে নাম লিখিয়েছেন। ফিরে দেখা যাক ১০ বছর আগে, বাংলার তৃণমূলের জয়যাত্রার সঙ্গে কীভাবে দলবদলের রাজনীতি হয়েছে এই বঙ্গভূমিতে।
বাংলায় পরিবর্তন (প্রথম তৃণমূল সরকার ২০১১-১৬):
প্রায় ৩৪ বছরের বাম জমানার বিলুপ্তি ঘটিয়ে বাংলার মসনদে বসলেন তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্য়োপাধ্য়ায়। পরিবর্তনের জোয়ার তখন বাংলাজুড়ে। ২৯৪টি বিধানসভা আসনের মধ্য়ে ২২৭টিতেই ঘাসফুল ফুটিয়ে নতুন ইতিহাস তৈরি করে ফেললেন মমতা বন্দ্য়োপাধ্য়ায়। আর এই অভূতপূর্ব উত্থানের পরই শুরু হয়ে যায় দলবদল (পড়ুন, দল ভাঙানোর খেলা)।
শুরুটা হয়েছিল দুই কংগ্রেস বিধায়কের হাত ধরে। নির্বাচন মিটতেই তাঁরা তৃণমূলে যোগ দেন। এরপর একে একে অনেক নেতাই দল বদলে মমতা বন্দ্য়োপাধ্য়ায়ের আদর্শে উজ্জীবীত হলেন।
আরও পড়ুন: শুভেন্দু-তৃণমূল জট অটুট, বঙ্গ রাজনীতিতে কেন চর্চায় অধিকারী গড়?
২০১১ সালের জয়ের পর ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে আরও এক বিরাট সাফল্য়ের মুখ দেখল মমতা বাহিনী। বাংলায় ৪২টি আসনের মধ্য়ে ৩৪টিই নিজেদের দখলে রাখল তৃণমূল। এরপর আবারও কংগ্রেস ও সিপিএমের নেতা-কর্মীদের তৃণমূলে যোগদানের রীতিমতো হিড়িক পড়ে গেল।
ষোলোয় দলবদলের ঢেউ:
সালটা ২০১৬। তৃণমূল সরকারকে হঠাতে বাম-কংগ্রেস মরিয়া হয়ে উঠল। কিন্তু বিরোধী গর্জনকে নস্য়াৎ করে বাংলায় নিজেদের ক্ষমতা অটুট রাখল মমতার তৃণমূল। তবে, আসন সংখ্য়া সামান্য় কমল। ২১১টি আসনে জিতে বাংলায় পথচলা শুরু হল দ্বিতীয় মমতা সরকারের।
এ বছরই একাধিক নেতা তৃণমূলে সাড়ম্বরে যোগ দিলেন। প্রাক্তন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি মানস ভুঁইয়া হাত ধরলেন মমতা বন্দ্য়োপাধ্য়ায়ের। কংগ্রেসের ৪৪ জন বিধায়কের মধ্য়ে ১৭ জন তৃণমূলে চলে গেলেন। উপনির্বাচনেও ঘাসফুলের জয়ের ধারা অটুট রইল।
আরও পড়ুন: কী করবেন শুভেন্দু? ‘মাথাব্যথা’ তৃণমূলের, অঙ্ক কষছে বিজেপি
তৃণমূলে প্রথম ‘ধাক্কা’, সৌজন্য়ে মুকুল:
অন্য় দলের ‘ঘর ভেঙে’ যেখানে তৃণমূলে যোগদানের হিড়ক পড়ত, সেই তৃণমূলে প্রথম কাঁপুনি ধরালেন একদা মমতা বন্দ্য়োপাধ্য়ায়ের অন্য়তম প্রধান সৈনিক ও ঘাসফুল শিবিরের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড মুকুল রায়। ২০১৭ সালের নভেম্বরে মুকুল রায়ের তৃণমূল ত্য়াগ শোরগোল ফেলে দিয়েছিল বঙ্গ রাজনীতিতে। এরপর? মুকুলের হাত ধরে একাধিক তৃণমূল নেতারা পদ্মশিবিরে নাম লেখাতে শুরু করলেন। মুকুল রায় নিঃসন্দেহে বিজেপির কাছে বড় উপহার বটেই।
২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনের মুখে তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দিলেন অর্জুন সিং, সৌমিত্র খাঁ, অনুপম হাজরারা। মুকুলের হাত ধরেই এই দলবদল বলে ব্য়াখ্য়া রাজনীতির কারবারিদের একাংশের। এরপর? উনিশের নির্বাচনে বাংলায় ১৮ আসনে পদ্মফুল ফুটিয়ে বিজেপির অভাবনীয় উত্থানে রীতিমতো ‘ধাক্কা’ খেল শাসক শিবির। ‘চাণক্য়ে’র বাজিমাতেই বিজেপির এহেন ‘বড় জয়’ বলেই মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশ। উনিশের নির্বাচনে বঙ্গে বিজেপির উত্থানের পর মুকুল রায়ের হাত ধরে এ যেন তৃণমূলে রীতিমতো ভাঙন ধরে গেল।
একের পর এক পুরসভা ‘হাতছাড়া’ হতে শুরু করল তৃণমূলের। তারপর পাল্টা ‘পুনরুদ্ধার’ করতে আসরে নামল মমতা বাহিনী। এই সময় একাধিক তৃণমূলের নেতা বিজেপিতে যোগ দিতে শুরু করলেন। যার মধ্য়ে অন্য়তম মমতার ‘প্রিয় কানন’ শোভন চট্টোপাধ্য়ায়, রাজারহাট-নিউটাউনের বিধায়ক সব্য়সাচী দত্ত। এমন সময়ে, দুর্গ বাঁচাতে ও বাংলার রাশ নিজেদের হাতে ধরে রাখতে ভোটকুশলী প্রশান্ত কিশোরের শরণাপন্ন হয়েছে তৃণমূল শিবির।
একুশে কুরুক্ষেত্র:
উনিশের নির্বাচন যদি সেমিফাইনাল ম্য়াচ হয়ে থাকে, তাহলে ফাইনালের আসর বসছে আর কয়েকমাস বাদে। ২০২১ সালে বাংলায় আরেক পরিবর্তন করতে মরিয়া গেরুয়াশিবির। তৃণমূল-বিজেপি বাগযুদ্ধ এখন রোজনামচা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভোট যত এগিয়ে আসছে, রাজনৈতিক চাপানউতোর ততই নয়া মাত্রা পাচ্ছে। এমন আবহে বড় চমক শুভেন্দু অধ্য়ায়। এদিকে, এমন আবহে তৃণমূলে অসন্তোষ প্রকাশ করে প্রথম বিধায়ক হিসেবে বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন মিহির গোস্বামী। ওদিকে, রাজ্য়ের বনমন্ত্রী রাজীব বন্দ্য়োপাধ্য়ায়ও দলের ভূমিকা নিয়ে বেসুরো মনোভাব দেখাচ্ছেন। ভোট যত এগোবে, আরও অনেক ‘রঙ্গ’ই ঘটবে বঙ্গ রাজনীতিতে, আরও অনেক নাটকীয় মুহূর্তের হয়তো সাক্ষী হতে চলেছে রাজ্য় রাজনীতি, অন্তত এমনটাই পর্যবেক্ষণ রাজনৈতিক মহলের একাংশের।
Read the full story in English
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন