Jannayak Karpoori Thakur: মঙ্গলবার (২৩ জানুয়ারি) কেন্দ্রীয় সরকার ঘোষণা করেছে, বিহারের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী কর্পুরী ঠাকুরকে মরণোত্তর ভারতরত্ন দেওয়া হবে। এবছর 'জননায়ক' বা জননেতা হিসেবে পরিচিত কর্পুরী ঠাকুরের জন্মশতবর্ষ। আরজেডি এবং জেডি(ইউ)-এর মত বিহারের প্রথমসারির রাজনৈতিক দলগুলো নিয়মিতভাবে কর্পুরী ঠাকুরের জন্য ভারতরত্ন দাবি করে আসছিল। সমাজের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া অংশের মানুষের জন্য মর্যাদা, আত্মসম্মান এবং উন্নয়নের লক্ষ্যে কর্পুরী ঠাকুর ব্যাপক সংগ্রাম করেছিলেন। আর, সেই জন্য তিনি পরিচিত। কর্পুরী ঠাকুর জন্মেছিলেন ১৯২৪ সালের ২৪ জানুয়ারি। তিনি প্রয়াত হন ১৯৮৮ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি। তাঁর রাজনৈতিক জীবন ছিল বৈপরীত্যে ভরা। তিনি নিজে নাপিত বর্ণের হওয়া সত্ত্বেও বিহারের অন্য পিছিয়ে পড়া বর্ণের নেতা হিসেবে উঠে এসেছিলেন। কিন্তু, যাদবদের মধ্যে লালু প্রসাদ, দলিতদের মধ্যে রামবিলাস পাসওয়ানের উত্থান তাঁর জায়গা কেড়ে নেয়। কর্পুরী ঠাকুর স্বল্প মেয়াদে দু'বার মুখ্যমন্ত্রী হন। তাঁর ব়্যাডিক্যাল নীতিগুলো তার মধ্যেই বিরাট প্রভাব ফেলে। যা, আজও অনুরণিত হয়।
- কর্পুরী ঠাকুর জন্মেছিলেন ১৯২৪ সালের ২৪ জানুয়ারি।
- তাঁর রাজনৈতিক জীবন ছিল বৈপরীত্যে ভরা।
- তিনি প্রয়াত হন ১৯৮৮ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি।
জীবন এবং কর্মজীবন
কর্পুরী ঠাকুরের জন্ম বিহারের সমস্তিপুর জেলার পিটানঝিয়া গ্রামে (বর্তমানে করপুরী গ্রাম নামে পরিচিত)। তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেন। সেজন্য জেলও খেটেছিলেন। স্বাধীন ভারতে, তিনি ১৯৫২ সালে প্রথমবার বিধায়ক হন। ইন্দিরার পরে কংগ্রেসের প্রতি সহানুভূতির তরঙ্গের মধ্যেও কর্পুরী ঠাকুর ১৯৭৭ সালে এমপি হন। ১৯৮৪ সালে বিধানসভা নির্বাচনে হেরে গেলেও ১৯৮৮ সালে মৃত্যু পর্যন্ত তিনি বিধায়ক ছিলেন। তিনি ১৯৬৭ সালের ৫ মার্চ থেকে ১৯৬৮ সালের ২৮ জানুয়ারি পর্যন্ত বিহারের শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন। ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে সম্মিলিত সমাজতান্ত্রিক দলের সমর্থনে কর্পুরী ঠাকুর বিহারের মুখ্যমন্ত্রী হন। কিন্তু, মাত্র ছয় মাস পরেই তাঁর সরকারের পতন ঘটে। তিনি ১৯৭৭ সালের জুন মাসে আবার বিহারের মুখ্যমন্ত্রী হন। কিন্তু প্রায় দুই বছরের মধ্যেই তাঁর সরকারের পতন ঘটে। তিনি মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি। তাঁর সরকারের পতন ঘটে একটি সংরক্ষণ নীতির কারণে। এই নীতি তিনি প্রয়োগ করেছিলেন। কিন্তু, লালুপ্রসাদ যাদব, রামবিলাস পাসোয়ানের মত বিহারের সামাজিক ন্যায়বিচারের দাবিতে সক্রিয় নেতাদের একটি গোষ্ঠী শক্তিশালী হয়ে উঠলে, কর্পুরী ঠাকুর তাঁর প্রাসঙ্গিকতা হারান। তবে তাঁর নীতিগত সিদ্ধান্ত, স্বচ্ছ ইমেজ, সরকারি অর্থের স্বচ্ছ ব্যবহারকে অস্বীকার করার উপায় নেই। যা ব্যক্তিগতভাবে কর্পুরী ঠাকুরকে বিশেষ সম্মান এনে দিয়েছিল। তাঁর সম্পর্কে একটি জনপ্রিয় গল্প হল, ১৯৫২ সালে যখন তিনি প্রথমবার বিধায়ক হন, সেবারই তিনি অস্ট্রিয়ায় পাঠানো একটি সরকারি প্রতিনিধি দলে ছিলেন। তাঁর নিজের একটি কোটও ছিল না। বন্ধুর থেকে একটি ছেঁড়া কোট ধার করে যুগোস্লাভিয়া গিয়েছিলেন। সেখানকার প্রেসিডেন্ট জোসিপ টিটো তাঁর ছেঁড়া কোট দেখে কর্পুরী ঠাকুরকে একটি নতুন কোট উপহার দিয়েছিলেন। কর্পুরী ঠাকুর ১৯৮৮ সালে মারা যান। তিন দশক ধরে বিহারে প্রথমসারির রাজনীতি করার পরও তাঁর বাড়িটি ছিল প্রায় কুঁড়েঘরের মত।
আরও পড়ুন- কলকাতা থেকে কাবুল হয়ে বার্লিন, কতটা কষ্টকর পথে ভারত ছেড়েছিলেন সুভাষ বসু?
প্রধান নীতিগত সিদ্ধান্ত
কর্পুরী ঠাকুর তাঁর সরকারের বিভিন্ন সিদ্ধান্তের জন্য বিশেষ পরিচিত। যে সিদ্ধান্তের মধ্যে একটি হল, ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষার জন্য বাধ্যতামূলক বিষয় থেকে ইংরেজির অপসারণ। তিনি অ্যালকোহল নিষিদ্ধ করেছিলেন। সরকারি চুক্তিতে বেকার ইঞ্জিনিয়ারদের নিয়োগ করেছিলেন। যার জেরে প্রায় ৮,০০০ ইঞ্জিনিয়ার চাকরি পেয়েছিল। এটি সেই সময় ঘটেছিল, যখন বেকার ইঞ্জিনিয়াররা চাকরির জন্য নিয়মিত বিক্ষোভ করছিলেন। সেই সব বিক্ষোভকারীদের অন্যতম ছিলেন বিহারের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার। এর পাশাপাশি, তিনি স্তরযুক্ত সংরক্ষণ ব্যবস্থা চালু করেছিলেন। তাঁর
এই শেষ পদক্ষেপটি বিহার তথা দেশের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছিল। ১৯৭০ সালের জুন মাসে, বিহার সরকার মুঙ্গেরি লাল কমিশন চালু করেছিল। এই কমিশন ১৯৭৬ সালের ফেব্রুয়ারির রিপোর্টে ১২৮টি 'অনগ্রসর' সম্প্রদায়ের নামকরণ করেছিল। যার মধ্যে ৯৪টি সম্প্রদায়কে 'সবচেয়ে অনগ্রসর' হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। ঠাকুরের জনতা পার্টি সরকার, কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন করেছিল। 'কর্পুরী ঠাকুর ফর্মুলা' ২৬% সংরক্ষণ দিয়েছিল। যার মধ্যে ওবিসিরা ১২% সংরক্ষণ পেয়েছিল। ওবিসিদের মধ্যে অর্থনৈতিকভাবে অনগ্রসর শ্রেণিকে দেওয়া হয় ৮% সংরক্ষণ। মহিলারা ৩% এবং 'উচ্চ বর্ণ'র দরিদ্ররা ৩% সংরক্ষণ পেয়েছিল। কেন্দ্রীয় সরকার EWS কোটা চালুর অনেক আগেই বর্ণ শুমারির দাবি এবং স্তরযুক্ত সংরক্ষণের দাবি গতি পেয়েছিল।
যার পিছনে ছিলেন কর্পুরী ঠাকুর। কিন্তু, এই 'কর্পুরী ঠাকুর ফর্মুলা'র জন্যই বেশ মূল্য দিতে হয়েছিল কর্পুরী ঠাকুরকে। আরজেডির জাতীয় মুখপাত্র জয়ন্ত জিগ্যাসু, দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে বলেছেন, 'ঐতিহ্যবাহী সংরক্ষণ নীতি পাশ হওয়ার পরে, কর্পুরী ঠাকুরকে অবমাননাকর এবং অপমানজনক স্লোগান শুনতে হয়েছিল। তার মধ্যে একটি ছিল, 'করপুরি কর পুরা, ছোড়দে গদ্দি, ধর উস্তুরা (তোমার কাজ শেষ কর, করপুরি। চেয়ার থেকে সরে যাও, ক্ষুর ধরতে যাও)।' ইগনু-র প্রাক্তন অধ্যাপক জগপাল সিং, ২০১৩ সালের একটি গবেষণাপত্রে লিখেছেন, 'কর্পুরী ঠাকুরের মত নয়। কর্ণাটকের দেবরাজ উরস তাঁর সাত বছরের শাসনের শেষ দুই বছরে, নিজের অবস্থানকে সুসংহত করার জন্য সংরক্ষণ নীতি চালু করেছিলেন।' কর্পুরী ঠাকুরের যথাযথ প্রস্তুতির অভাব সম্পর্কে উরস লিখেছিলেন, 'করপুরী ঠাকুর প্রতিরোধ করতে শেখার আগেই রিংয়ে উঠেছিলেন।' যাইহোক, ঠাকুর তাঁর ভোটারদেরকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছিলেন।
আরও পড়ুন- অপারেশন ‘সর্বশক্তি’ শুরু ভারতীয় সেনার, ‘সর্পবিনাশ’-এর আধুনিক রূপ, ভয়ংকর কিছু ঘটতে চলেছে?
কর্পুরী ঠাকুর আজ
মণ্ডল-কমণ্ডল রাজনীতি তীব্র হওয়ায় বিহারের বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা কর্পুরী ঠাকুরের উত্তরাধিকার দাবি করছেন। বিহারের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার নিজে ইবিসি সম্প্রদায়ের। তিনি দাবি করেছেন, ঠাকুরের ঘনিষ্ঠ। কেউ কেউ নীতীশের এই দাবিতে বিড়ম্বনা খুঁজে পেয়েছেন। কারণ, নীতীশের প্রজন্মের নেতারাই কর্পুরী ঠাকুরকে পাশ কাটিয়ে গিয়েছিলেন। এই বিষয়ে জয়ন্ত জিগ্যাসু বলেন, 'বিজেপি সরকার আজ ঠাকুরকে সম্মান জানাচ্ছে। কিন্তু, এটা মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে তাঁর সরকারের পতন হয়েছিল কারণ জনতা পার্টির সংঘ-আনুষঙ্গিক নেতারা কর্পুরী ঠাকুরের ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করেছিলেন। আরজেডি এবং জেডি(ইউ) বর্তমানে, সরকারের নীতির মাধ্যমে কর্পুরী ঠাকুরের উত্তরাধিকারকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।'