লোকসভা নির্বাচনের আগেই মোদী সরকারের বিরাট চমক। এবার বিজেপির ফোকাস ৪০০ আসন। লক্ষ্যপূরণে মাঠে নেমেছে মোদী সরকার। কেন্দ্রের একের পর এক পদক্ষেপ আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি লক্ষ্যঅর্জনে সাহায্য করবে বলেই মনে করছন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা।
এই ধারাবাহিকতায় শুক্রবার বিজেপি তেলেঙ্গানা ও অন্ধ্রপ্রদেশে জয়ের লক্ষ্যে বিরাট এক পদক্ষেপ নিয়েছে। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী পিভি নরসিমা রাওকে দেশের সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান 'ভারতরত্ন' দিয়ে সম্মানিত করার কথা ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী মোদী।
প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় ২০১৯ সালে ভারতরত্ন পাওয়ার পর, বিজেপি অপর এক প্রবীণ কংগ্রেস নেতা এবং প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী পি.ভি. নরসিমা রাওকে দেশের সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান প্রদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে নরসিমা রাওকে ভারতরত্ন দেওয়া আসলে ২৪ -এর লোকসভা নির্বাচনের আগে বিজেপির একটি সুপরিকল্পিত রাজনৈতিক পদক্ষেপ। পি.ভি. নরসিমা রাওকে ভারতরত্ন প্রদান নিয়ে ইতিমধ্যেই গান্ধী পরিবারকে নিশানা করেছে বিজেপি।
প্রধানমন্ত্রী মোদী বহুবার কংগ্রেস এবং গান্ধী পরিবারের বিরুদ্ধে রাওকে অপমান করার অভিযোগ তুলেছেন। এমন পরিস্থিতিতে কংগ্রেস তাঁকে যে সম্মান প্রদান করেনি, বিজেপি সেই সম্মান তাঁকে প্রদান করছে। অন্যদিকে, বিজেপির এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে রাওয়ের নিজ রাজ্য অন্ধ্রপ্রদেশের ভোটারদের মন জয়ের মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছে গেরুয়া শিবির।
প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী চৌধুরী চরণ সিং, পিভি নরসিমা রাও এবং বিখ্যাত কৃষি বিজ্ঞানী এবং দেশের সবুজ বিপ্লবের জনক ডঃ এম এস স্বামীনাথনকে দেশের সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান 'ভারত রত্ন' দিয়ে সম্মানিত করা হবে। শুক্রবার 'এক্স'-এ একটি পোস্টের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নিজেই এই ঘোষণা করেছেন এবং তিনজনের অবদানের কথা স্মরণ করেছেন।
কয়েকদিন আগে 'জননায়ক' কার্পুরী ঠাকুর এবং প্রাক্তন উপ- প্রধানমন্ত্রী লালকৃষ্ণ আদবানিকে ভারতরত্ন প্রদানের ঘোষণা করেছিল মোদী সরকার। বিজেপি কেন চৌধুরী চরণ সিং, এমএস স্বামীনাথনকে ভারতরত্ন দিচ্ছে?
রাওয়ের প্রশংসায় কী বললেন মোদী?
প্রধানমন্ত্রী মোদী বলেন, 'একজন বিশিষ্ট পণ্ডিত এবং রাজনীতিবিদ হিসেবে নরসিমা রাও বিভিন্ন পদে অধিষ্ঠিত থাকার সময় দেশের সেবা করেছেন। অন্ধ্র প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এবং বহু বছর ধরে সাংসদ ও বিধায়ক হিসাবে তিনি যে কাজ করেছেন তার জন্যও তিনি আজও স্মরণীয় হয়ে আছেন।' মোদী আরও বলেছিলেন যে তাঁর দূরদর্শী নেতৃত্ব ভারতকে অর্থনৈতিকভাবে উন্নত করতে সাহায্য করেছে। ভারতের সমৃদ্ধি ও উন্নয়নের তাঁর অবদানের কথা তুলে ধরে মোদী বলেন, 'প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নরসিমা রাওয়ের কার্যকাল গুরুত্বপূর্ণ। এই সময় ভারত বিশ্ববাজারে এবং অর্থনৈতিক ভাবে নতুন যুগের সূচনা করেছিল।' প্রধানমন্ত্রী বলেছেন যে ভারতের বিদেশনীতির পাশাপাশি ভাষার ক্ষেত্রেও তাঁর অবদান উল্লেখযোগ্য"। উল্লেখ্য, নরসিমা রাও ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
সনিয়া গান্ধীর প্রতিক্রিয়া
শুক্রবার কংগ্রেস সংসদীয় দলের প্রধান সনিয়া গান্ধী প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী পিভি নরসিমা রাওকে 'ভারতরত্ন' প্রদানের ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছেন। সনিয়া গান্ধী বলেন, 'আমি সরকারে এই সিদ্ধান্তকে (ঘোষণা) স্বাগত জানাই'। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে তিনি বিদেশমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রী সহ আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন ছিলেন। তিনি ১৯৭১ থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত অন্ধ্রপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন।
গান্ধী পরিবারের সঙ্গে রাওয়ের দূরত্ব সবারই জানা
নরসিমহা রাওকে ভারতের অর্থনৈতিক সংস্কারের জনক বলা হলেও গান্ধী পরিবারের সঙ্গে তাঁর দূরত্ব সর্বজনবিদিত। এমনকি বিজেপি এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বারবার কংগ্রেসের বিরুদ্ধে নরসিমা রাওকে উপেক্ষা করার অভিযোগ করেছেন।
বিজেপির দক্ষিণ ভারত প্রচার
নরসিমা রাও ছিলেন অবিভক্ত অন্ধ্র প্রদেশের একজন সিনিয়র কংগ্রেস নেতা এবং দক্ষিণ ভারতের প্রথম ব্যক্তি যিনি প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন হন। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীকে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে এই কথা বলতে ভোলেননি প্রধানমন্ত্রী মোদী। প্রধানমন্ত্রী মোদী টুইট করে বলেছেন, 'অন্ধ্রপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এবং বহু বছর ধরে সাংসদ ও বিধায়ক তাঁর কাজের জন্য নরসিমা রাওকে আজও স্মরণ করা হয়।'
লোকসভা আসনের নিরিখে বিজেপি দক্ষিণ ভারতের তেলেঙ্গানা এবং অন্ধ্র প্রদেশের আসনগুলির একটি বড় অংশের দিকে নজর রাখছে৷ বিজেপি চন্দ্রবাবু নাইডুর টিডিপি এবং অভিনেতা-রাজনীতিবিদ পবন কল্যাণের জনসেনা পার্টি (জেএসপি) এর সঙ্গেও অবিরাম যোগাযোগ রেখে চলেছে।
বিজেপির ফোকাস ৪০০ আসনে
লোকসভা নির্বাচনের আর বেশি সময় বাকি নেই। এবারের নির্বাচনে ৪০০ আসনের লক্ষ্য নিয়ে প্রস্তুতিতে ব্যস্ত বিজেপি। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি ৩০৩ টি আসন জিতেছিল। এখন যেহেতু বিজেপি ৪০০ আসন জয়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে, এটা স্পষ্ট যে বিজেপিকে ভোটের শতাংশ বাড়াতে হবে এবং নতুন আসনও জিততে হবে যেখানে বিজেপি আগে কখনও জিততে পারেনি।
কেসিআর রাওকে ভারতরত্ন দেওয়ায় প্রশংসা করেছেন
তেলেঙ্গানার উপমুখ্যমন্ত্রী মাল্লু ভাট্টি বিক্রমার্কা এবং ভারত রাষ্ট্র সমিতির (বিআরএস) সভাপতি ও তেলেঙ্গানার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী কে. চন্দ্রশেখর রাও শুক্রবার প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী পিভি নরসিমা রাওকে 'ভারতরত্ন' পুরস্কার দেওয়ার ঘোষণার প্রশংসা করেছেন। দেশের উন্নয়নে নরসিমা রাও-এর অসামান্য অবদানের কথা স্মরণ করে বিক্রমার্ক বলেছেন যে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীকে দেশের সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান দেওয়া তেলেঙ্গানা এবং কংগ্রেসের জন্য গর্বের বিষয়। তিনি প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীকে এই পুরস্কার দেওয়ার জন্য কেন্দ্রকে ধন্যবাদ জানান।
কর্পুরী ঠাকুর
কর্পুরী ঠাকুর অনগ্রসর শ্রেণী অর্থাৎ ওবিসি সম্প্রদায়ের এক জননেতা। বিহারে মোট ৪০টি লোকসভা আসন রয়েছে। বিহারের মোট জনসংখ্যার ৪৫ শতাংশেরও বেশি অনগ্রসর শ্রেণীর অন্তর্গত। কর্পুরী ঠাকুর দেশে প্রথমবারের মতো অনগ্রসর শ্রেণীর জন্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে সামাজিক ন্যায়বিচারের একটি নতুন দিক নির্দেশ করেন। এদিকে নীতীশ কুমার আবার এনডিএ জোটের অংশ হয়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে,ভারতরত্নের জন্য কর্পূরী ঠাকুরের নাম অনুমোদন পিছিয়ে পড়া শ্রেণীর ভোটারদের উপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলবে বলেও ধারণা রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের।
চৌধুরী চরণ সিং
বিরোধী নেতারা প্রায়ই বলেছেন যে কৃষক সম্প্রদায় এবং জাট সম্প্রদায় বিজেপি এবং প্রধানমন্ত্রী মোদীর নীতিতে অসন্তুষ্ট। এমন পরিস্থিতিতে চৌধুরী চরণ সিংকে ভারতরত্ন দেওয়ার কথা ঘোষণা করা হয়েছে। চৌধুরী চরণ সিং জাট সম্প্রদায়ের নেতা ছিলেন এবং তিনি ছিলেন একজন কৃষক। উত্তরপ্রদেশের মোট ৮০ টি লোকসভা আসন রয়েছে। জাট সম্প্রদায় পশ্চিম ইউপিতে অত্যন্ত প্রভাবশালী, যাদের কৃষি খাতে উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে। জল্পনা আরএলডি প্রধান জয়ন্ত চৌধুরীও এনডিএ জোটের অংশ হতে পারেন। এমন অবস্থায় জাট ও কৃষকদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা লক্ষ্যেই চৌধুরী চরণ সিংকে ভারতরত্ন সম্মান প্রদান করছেন মোদী সরকার। লোকসভা নির্বাচনে তার সুফল দেখা যাবে বলেই আশাবাদী গেরুয়া শিবির। জাট সম্প্রদায় ও কৃষকরাও এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন।
এমএস স্বামীনাথন
সবুজ বিপ্লবের জনক এম এস স্বামীনাথনের প্রভাব সারা দেশ জুড়ে। কিছুদিন আগেই তিনি প্রয়াত হয়েছেন। কিন্তু পাঞ্জাব, হরিয়ানা এবং তামিলনাড়ুর মতো কৃষিপ্রধান রাজ্যগুলিতে এমএস স্বামীনাথনের নাম আজও স্মরণ করা হয়। লোকসভা আসনের নিরিখে বলি, তামিলনাড়ুতে ৩৯টি, পাঞ্জাবের ২৩টি এবং হরিয়ানায় ১০টি লোকসভা আসন রয়েছে। এমএস স্বামীনাথন কৃষি ও কৃষক সম্প্রদায়ের অন্তর্গত ছিলেন। এমন পরিস্থিতিতে বিজেপির এই সিদ্ধান্তে কৃষকদের আকৃষ্ট করার ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। বিজেপির এই সিদ্ধান্তকে কৃষক দলগুলো স্বাগত জানিয়েছে।
লালকৃষ্ণ আদবানি
রামমন্দির আন্দোলনের নেতাদের কথা বললে লালকৃষ্ণ আদবানির নাম উঠে আসবে সবার আগে। বিরোধীরা ক্রমাগত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে লালকৃষ্ণ আদবানিকে উপেক্ষার অভিযোগ করে আসছেন। আদবানিকে ভারতরত্ন দেওয়ার সিদ্ধান্তে বিরোধীদের এই পদক্ষেপ ব্যর্থ হয়েছে। সারা ভারতে আদবানির অসংখ্যা গুণমুগ্ধ রয়েছে। কারণ তিনি বিজেপির জাতীয় পর্যায়ের নেতা ছিলেন। কেন্দ্রের এই সিদ্ধান্ত বিজেপির মধ্যে আদি এবং নব্য দ্বন্ধ দূর করবে।