Advertisment

মহারাষ্ট্রে বিজেপি-শিবসেনা জোট ও তাদের টানাপোড়েন

যে আদর্শগত ঐক্য তাদের কাছাকাছি এনেছে, একই রাজনৈতিক পরিসরে কাজ করার দরুণ সেই আদর্শগত ঐক্যের কারণেই তারা পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে থেকেছে।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

বিজেপি শিবসেনা জুটি মহারাষ্ট্র বিধানসভায় ২৮৮টির মধ্যে ১৬১টি আসনে জিতেছে। কিন্তু তাদের ভোট পূর্ব জোট এখনও সরকার গঠন করতে পারেনি। কারণ শিবসেনার দাবি মেটানো বিজেপির পক্ষে সমস্যার হয়ে দাঁড়িয়েছে।

Advertisment

তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে এই দুই দল একে অপরের জোটসঙ্গী, এবং প্রায় এই পুরো সময়কাল জুড়েই তাদের সম্পর্ক টানা পোড়েনের মধ্যে দিয়ে গিয়েছে। তার অন্যতম কারণ হল যে আদর্শগত ঐক্য তাদের কাছাকাছি এনেছে, একই রাজনৈতিক পরিসরে কাজ করার দরুণ সেই আদর্শগত ঐক্যের কারণেই তারা পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে থেকেছে।

আরও পড়ুন, বিশ্লেষণ: অযোধ্যা মামলায় বিচার্য বিষয়গুলি

তিরিশ বছর আগে

১৯৮৯ সালের লোকসভা ভোটের আগে, সেনা এবং বিজেপি তাদের প্রথম নির্বাচন-পূর্ব জোট গঠন করে। তাদের জোটের ভিত্তি ছিল হিন্দুত্ব। বিজেপির পক্ষে মূল সমন্বয়কারী ছিলেন প্রমোদ মহাজন। তাঁর সঙ্গে শিবসেনার  প্রতিষ্ঠাতা বাল ঠাকরের সম্পর্ক ছিল খুবই ভাল। বিজেপির সে সময়ে মহারাষ্ট্রে পায়ের তলায় মাটি ছিল না। তারা নির্ভর করেছিল ওই অঞ্চলের জোটসঙ্গীর উপরে, অন্যদিকে শিবসেনা চেয়েছিল বিজেপির হিন্দুত্বের উপর ভর করে তৎকালীন কংগ্রেসি গড়ে সুবিধাজনক অবস্থায় পৌঁছতে।

জাতীয় দল হিসেবে লোকসভা (১৯৮৯) ভোটে বিজেপি বেশি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল, এবং পরের বথর বিধানসভা ভোটে শিবসেনাকে বেশি আসন ছাড়বে বলে প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিল তারা। যে ১৮৩টি আসনে শিবসেনা লড়েছিল, তার মধ্যে তারা জিতেছিল ৫২টিতে, ১০৪টির মধ্যে বিজেপি জিতেছিল ৪২টিতে। মনোহর জোশী বিরোধী দলনেতা হন, কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই তাঁকে চ্যালেঞ্জ জানান নিজের দলেরই ছগন ভুজাবল। ১৯৯১ সালে ভুজাবল কংগ্রেসে যোগ দেন, পদ চলে যায় বিজেপির হাতে।

আরও পড়ুন, বিশ্লেষণ: মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (RCEP)- তে কেন থাকল না ভারত?

 ক্ষমতায় থেকেও কলহ

গেরুয়া জোট ১৯৯২ সালের বাবরি ধ্বংস এবং ১৯৯৩ সালের বম্বে বিস্ফোরণের  সাম্প্রদায়িক ভাবে কাজে লাগিয়ে ১৯৯৫ সালের বিধানসভা ভোটে কংগ্রেসের সঙ্গে লড়াইয়ের ময়দানে নামে। সেনা ৭৩টি এবং বিজেপি ৬৫টি আসনে জেতে। বাল ঠাকরের ফর্মুলা ছিল যারা বেশি আসন পাবে, মুখ্যমন্ত্রিত্ব পাবে তারাই। সেই হিসেব মেনে জোশী মুখ্যমন্ত্রী হন এবং বিজেপির গোপীনাথ মুণ্ডে হন উপমুখ্যমন্ত্রী।

বিভিন্ন নীতি নিয়ে দু দলের মধ্যে ঝগড়া শুরু হয় - এবং বাল ঠাকরের রাজনৈতিক উত্তরসূরী তথা সেনার উঠতি নক্ষত্র রাজ ঠাকরে ১৯৯৬ সালে রমেশ কিনি মামলায় জড়িয়ে পড়ার পর জোট অনিশ্চয়তার মুখে পড়ে। রমেশ কিনি আত্মহত্যা মামলায় পরে খালাস পেয়ে যান রাজ ঠাকরে।

ক্ষমতার টানাপোড়েন

১৯৯৯ সালের বিধানসভা ভোটে দু দল জোটবদ্ধ হয়ে ভোটে লড়ে, কিন্তু দু দলই একে অপরের প্রার্থীদের হারানোর চেষ্টা করে যাতে নিজেরা বেশি আসন পেয়ে মুখ্যমন্ত্রী পদের দাবিদার হতে পারে। শিবসেনা ৬৯টি এবং বিজেপি ৫৬টি আসন পায়।

২৩ দিন ধরে ব্যর্থ আলোচনা চলার পর সদ্য কংগ্রেস ভেঙে তৈরি হওয়া শরদ পাওয়ারের এনসিপি কংগ্রেসের সঙ্গে জোট সরকার তৈরি করে ফেলে, যে সরকারের মুখ্যমন্ত্রী হন বিলাসরাও দেশমুখ। এরপর দীর্ঘদিন বিরোধী অবস্থানে থাকা সেনা-বিজেপি বহু ইস্যুতেই দ্বিমত থাকে। টানাপোড়েন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছয় যখন মহাজর মহারাষ্ট্রে ১০০ শতাংশ বিজেপির স্বপ্ন দেখতে থাকেন, এবং তার উত্তরে ঠাকরে বলেন, রাজ্যে পদ্ম ফুটছে শিবসেনার জোরে।

এসব সত্ত্বেও ২০০৪ সালে ফের একযোগে বিধানসভা ভোটে জোট করে সেনা-বিজেপি। শিবসেনা ৬২ আসনে জেতে, বিজেপি জেতে ৫৪ আসনে। ২০০৫ সালে সেনা-বিজেপি সরকারের এক প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী নারায়ণ রাণে সেনা ছেড়ে এক ডজন বিধায়ক নিয়ে কংগ্রেসে যোগ দেন। বিজেপি বিরোধী দলনেতার পদ পাবার ব্যর্থ চেষ্টা করে।

২০০৯ সালে কংগ্রেস-এনসিপি ফের ক্ষমতায় আসে, গেরুয়া শিবিরের মহাপতন ঘটে। কিন্তু সেবারই প্রথম বিজেপি সেনার থেকে দুটি আসন বেশি পেয়ে বিরোধী দলনেতার পদ হাসিল করে।

আরও পড়ুন, বিশ্লেষণ: প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর ফোনে ঠিক কী হয়ে থাকতে পারে?

ভারসাম্যের বদল

২০০২ সালে গুজরাট দাঙ্গার পর অটল বিহারী বাজপেয়ী যখন রাজধর্মের কথা উচ্চারণ করলেন, সে সময়ে সে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর পাশে দাঁড়ালেন ঠাকরে। তিনি বললেন, মোদী গেলে গুজরাটও যাবে। মজার ব্যাপার হল নরেন্দ্র মোদীর মাধ্যমে নয়া হিন্দু হৃদয় সম্রাটের উত্থানের ফলেই মহারাষ্ট্রের ভারসাম্য বিজেপির দিকে হেলে পড়ল।

২০১৪ সালের লোকসভা ভোটের মোদী ঢেউ কাজে সাগিয়ে সে বছরের বিধানসভা ভোটে বিজেপি আসন সমঝোতা নিয়ে কড়া মনোভাব দেখায়। এর ফলে ২৫ বছর পর প্রথম বার দু দল আলাদা আলাদা ভাবে ভোটে লড়ে। এদিকে কংগ্রেস ও এনসিপি আলাদা হয়ে যাওয়ায় ভোট হয় বহুমুখী। সেনা ৬৩ আসন পায়, বিজেপি পায় ১২২ টি আসন। দেবেন্দ্র ফড়নবীশ মুখ্যমন্ত্রী হন। কিছুদিন বিরোধী আসনে বসার পর সেনা সরকারে যোগ দেয়, তাদের ১২টি গুরুত্বহীন মন্ত্রিত্ব দেওয়া হয়।

জোটে দ্বিতীয় শ্রেণির সদস্য হয়ে থাকার জ্বালা মেটাতে কেন্দ্রে ও রাজ্যে সরকারের অংশ হওয়া সত্ত্বেও বিভিন্ন ইস্যুতে শিবসেনা সুযোগ পেলেই আক্রমণ করেছে বিজেপিকে। সে নোটবন্দি নিয়ে হোক, রাফাল নিয়ে হোক কি মহারাষ্ট্রে কৃষিঋণ মকুব ইস্যুতে হোক। উদ্ধব ঠাকরে বলেছেন শিবসেনা বিজেপির সঙ্গে থেকে ২৫ বছর নষ্ট করেছে। ২০১৭ সালে বিএমসি-র ভোটে আলাদা ভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে দু দল।

সেনার অপ্রত্যাশিত পুরস্কার

২০১৯ সালের লোকসভা ভোট যত এগিয়ে আসে, ততই দুদল একে অপরের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতে থাকে। ফেব্রুয়ারি মাসে ফড়নবীশ ঘোষণা করেন, রাজ্য সরকারে দু দলের পদ ও দায়িত্বের ভাগ হবে সমান সমান। বিধানসভা ভোটে শিবসেনা কম আসনের ভাগ মেনে নেয়, বিজেপিও একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার ইঙ্গিত দেওয়া বন্ধ করে।

কিন্তু বিধানসভা ভোটের ফল সব হিসেব পাল্টে দিয়েছে। বিজেপি ২০১৪ সালে ১২২টি আসনে জিতলেও তাদের আসনসংখ্যা এবার কমে দাঁড়ায় ১০৫ টিতে। শিবসেনার আসন ৬৩ থেকে কমে দাঁড়ায় ৫৬-তে। কিন্তু কম আসন নিয়েই দরাদরির জায়গায় চলে আসে তারা। শিবসেনার উপর যখন বিজেপি নির্ভরশীল, সে সময়েই উদ্ধব ঠাকরে ফলের দিনই বলেন, তিনি লোকসভা ভোটের আগে যে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, ক্ষমতা ভাগাভাগির ৫০-৫০ ফর্মুলা চান, এবং তা মুখ্যমন্ত্রিত্বের ব্যাপারেও লাগু হবে।

বর্তমান বিধানসভার মেয়াদ শেষ হচ্ছে ৯ নভেম্বর।

shiv sena bjp
Advertisment