বোড়ো চুক্তির মূল বিষয়গুলি কী?

আসামের মন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা বলেন এই চুক্তির সঙ্গেই পৃথক রাজ্যের দাবির পরিসমাপ্তি ঘটল। যদিও আবসুর এক নেতা বলেছেন, "পৃথক রাজ্যের দাবি ছেড়ে দেবার কথা চুক্তির কোথাও বলা নেই।"

আসামের মন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা বলেন এই চুক্তির সঙ্গেই পৃথক রাজ্যের দাবির পরিসমাপ্তি ঘটল। যদিও আবসুর এক নেতা বলেছেন, "পৃথক রাজ্যের দাবি ছেড়ে দেবার কথা চুক্তির কোথাও বলা নেই।"

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Bodo Accord

অসমিয়াভাষীদের ক্ষোভ যখন বিজেপির উপর উপচে পড়ছে, সে সময়ে বোড়ো ভোটারদের সংহত করতে চাওয়াই এই চুক্তির উদ্দেশ্য

সোমবার কেন্দ্র, আসাম সরকার এবং জঙ্গি বলে পরিচিত ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট অফ বোড়োল্যান্ড (NDFB) সহ সমস্ত বোড়ো গোষ্ঠীগুলি উন্নয়ন ও শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করেছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ একে দীর্ঘদিনের বোড়ো সমস্যার চূড়ান্ত সমাধান বলে উল্লেখ করেছেন।

Advertisment

বোড়ো সমস্যা কী?

আসামের নোটিফায়েড তফশিলি জনজাতিদের মধ্যে বোড়ো সম্প্রদায় বৃহত্তম। আসামের মোট জনসংখ্যার ৫-৬ শতাংশ এই বোড়োরা।

বোড়োদের জন্য পৃথক রাজ্যের দাবি সামনে আসে ১৯৬৭-৬৮ নাগাদ। সে দাবি সামনে এনেছিল প্লেনস ট্রাইবাল কাউন্সিল অফ আসাম নামের একটি রাজনৈতিক দল। ১৯৮৫ সালে আসাম আন্দোলনের জেরে যখন আসাম চুক্তি হয়, তখন অনেক বোড়োরাই বিষয়টি মূলত অসমিয়াভাষীদের স্বার্থরক্ষা করবে বলে ভেবেছিলেন। ১৯৮৭ সালে উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মর নেতৃত্বে অল বোড়ো স্টুডেন্টস ইউনিয়ন (আবসু) পুনরুজ্জীবিত হয় ও বোড় রাজ্যের দাবি তোলে। ১৯৮৬ সালে তৈরি হয় সশস্ত্র বোড়ো সিকিউরিটি ফোর্স, যার নেতৃত্বে ছিলেন রঞ্জন দইমারি। পরে এরই নাম হয় NDFB। তারও পরে এ সংগঠন বিভিন্ন উপদলে বিভক্ত হয়ে যায়।

Advertisment

এবারের চুক্তিতে বলা হয়েছে, "চুক্তি স্বাক্ষরের এক মাসের মধ্যে NDFB-র সমস্ত উপদল হিংসার পথ পরিত্যাগ করে তাদের অস্ত্র সমর্পণ করবে এবং সমস্ত সশস্ত্র সংগঠন ভেঙে দেবে।"

নয়া নাগরিকত্ব আইন নিয়ে যে বিক্ষোভ চলছে, তার মাঝে এই চুক্তির রাজনৈতিক লাভ কী?

অসমিয়াভাষীদের ক্ষোভ যখন বিজেপির উপর উপচে পড়ছে, সে সময়ে বোড়ো ভোটারদের সংহত করতে চাওয়াই এই চুক্তির উদ্দেশ্য। ২০১৬ সালে অসমিয়াভাষীরা বিজেপির পক্ষে ব্যাপক ভোট দিয়েছিলেন। এখন অসমিয়া ছাত্রনেতা, সমাজকর্মীস জনপ্রিয় গায়ক ও অভিনেতা এবং বিশিষ্ট নাগরিকরা বিশাল জনসভায় বিজেপির বিরুদ্ধে মুখ খুলছেন। পূর্বদিকে, উজান আসাম, যেখানে অসমিয়াভাষীদের সংখ্যা বেশি, সেখানে এই ছবি বেশি করে দেখা যাচ্ছে। বোড়োল্যান্ড এলাকা আসামের পশ্চিম দিকে পড়ে, এবং বোড়োদের একটা বড় অংশ বিজেপির সমর্থক। বিজেপির সঙ্গী বোড়োল্যান্ড পিপলস ফ্রন্টের শীর্ষনেতা হাগরামা মহিলারি বোড়োল্যান্ড টেরিটোরিয়াল কাউন্সিলেরও শীর্ষস্থানীয় পদে রয়েছেন।

বোড়োল্যান্ড টেরিটোরিয়াল কাউন্সিল কী?

সংবিধানের ষষ্ঠ তফশিলের আওতায় এটি একটি স্বায়ত্তশাসিত বডি। এর আগে দুটি বোড়ো চুক্তি হয়েছে, এবং দ্বিতীয় চুক্তি অনুসারে বিটিসি গঠিত হয়। ১৯৮৭ সালে আবসুর নেতৃত্বে যে আন্দোলন শুরু হয়, তারই পরিণতিতে ১৯৯৩ সালে বোড়ো চুক্তি হয়, যার জেরে বোড়োল্যান্ড ইটোনমাস কাউন্সিল গঠিত হয়। কিন্তু আবসু পরে চুক্তি প্রত্যাহার করে নিয়ে ভিন রাজ্যের দাবি ফের জাগিয়ে তোলে। ২০০৩ সালে দ্বিতীয় বোড়ো চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় চরমপন্থী বোড়ো লিবারেশন টাইগার ফোর্স (BLTF), কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে। তার জেরে গড়ে ওঠে বিটিসি বা বোড়োল্যান্ড টেরিটোরিয়াল কাউন্সিল।

এবারের চুক্তিতে কী স্থির হল?

প্রাথমিকভাবে এনডিএফবির চারটি গোষ্ঠী কয়েক দশকের সশস্ত্র আন্দোলনের পর শান্তিচুক্তি করেছে। অমিত শাহের দাবি এই হিংসায় ৪০০০-এরও বেশি প্রাণহানি ঘটেছে। আবসুর সভাপতি প্রমোদ বোরো বলেছেন, "এই চুক্তির সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ দিক হল এর ফলে সশস্ত্র আন্দোলনের সমাপ্তি ঘটল। সমস্ত সশস্ত্র গোষ্ঠী এসে চুক্তি স্বাক্ষর করছে, এটা একটা বিশাল ব্যাপার।"

রাজ্যের দাবি নিয়ে প্রশ্ন করা হলে প্রমোদ বলেন, এ ব্যাপারে আবসু পরের বিশেষ কনভেনশনে সিদ্ধান্ত নেবে। আসামের মন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা বলেন এই চুক্তির সঙ্গেই পৃথক রাজ্যের দাবির পরিসমাপ্তি ঘটল। যদিও আবসুর এক নেতা বলেছেন, "পৃথক রাজ্যের দাবি ছেড়ে দেবার কথা চুক্তির কোথাও বলা নেই।"

চুক্তিতে বলা হয়েছে, "আসাম রাজ্যের সংহতি বজায় রেখে বোড়ো সংগঠনগুলির সঙ্গে তাদের দাবির ব্যাপারে সর্বাঙ্গীন ও চূড়ান্ত সমাধান বিষয়ে  সমঝোতা হয়েছে।"

অঞ্চল বিষয়ে কী স্থীর হয়েছে?

২০০৩ সালে গঠিত বিটিসির আওতাধীন এলাকা বোড়ো টেরিটোরিয়াল অটোনমাস বোর্ড (BTAD) বলে পরিচিত ছিল। সোমবার তার নতুন নাম হল বোড়োল্যান্ড টেরিটোরিয়াল রিজিয়ন (BTR)।

BTAD-র মধ্যে ছিল কোকরাঝাড়, চিরাং, বাকসা ও উদলগুড়ি জেলা, যা মোট আসামের ১১ শতাংশ ও জনসংখ্যার ১০ শতাংশ। BTAD এলাকার জনসংখ্যা নিয়ে নানা মত রয়েছে। ২০১৫ সালের আসাম ট্রিবিউনের এক রিপোর্টে রাজ্য সরকারকে উদ্ধৃত করা হয়েছে। সেখানে বিধানসভায় সরকার বলেছে, ওই এলাকায় বোড়ো ও অবোড়ো জনসংখ্যার আলাদা করে হিসেব নেই। ২০১৫ সালে ইকনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলি পত্রিকায় বলা হয়েছে, এই এলাকার মাত্র ২৭ শতাংশ বোড়ো গোষ্ঠীর। BTAD-র চারটি জেলা নিয়ে কোকরাঝাড় লোকসভা আসন, যেখানকার সাংসদ নরকুমার সারানিয়া একজন অবোড়ো।

নয়া চুক্তিতে BTAD এলাকার রদবদল ও ওই এলাকার বাইরের বোড়োদের সংস্থানের কথা উল্লিখিত রয়েছে। রাজ্য সরকার নিযুক্ত এক কমিশন বিটিএডি এলাকার বাইরে সংশ্লিষ্ট গ্রামগুলিতে জনজাতির সংখ্যাধিক্য খতিয়ে দেখে সেগুলিকে বিটিআর ভুক্ত করার সুপারিশ করবে এবং BTAD এলাকার বর্তমান অন্তর্ভুক্ত অবোড়ো জনজাতিকেও বাদ দেবার বিষয় খতিয়ে দেখে সুপারিশ করবে। হিমন্ত বিশ্বশর্মার ব্যাখ্যা, এর ফলে বিটিআর এলাকায় বোড়ো জনসংখ্যা বাড়বে ও অবোড়ো জনসংখ্যা কমবে যার জেরে সম্প্রদায়গত হিংসা কমবে।

BTAD এলাকার বাইরে থাকা বোড়ো গ্রামগুলির উন্নয়নের লক্ষ্যে সরকার একটি বোড়ো কাচারি ওয়েলফেয়ার কাউন্সিল গঠন করবে যাতে এই এলাকার বাইরের বোড়োদের প্রয়োজনীয়তা মেটানো যায়।

সোমবার যে চুক্তিগুলি স্বাক্ষরিত হয়েছে, সেগুলি ইতিমধ্যেই কার্যকর বিষয়ের সম্প্রসারিত রূপ। যেমন এর ফলে বিটিসির হাতে বেশি ক্ষমতা যাবে। ২০২০ সালের চুক্তিতে বলা হয়েছে, আসাম সরকার দেবনাগরী হরফে বোড়ো ভাষাকে রাজ্যের সহ সরকারি ভাষা হিসেবে ঘোষণা করবে।

সশস্ত্র আন্দোলনের সময়ে যেসব মামলা দায়ের করা হয়েছিল, সেগুলির কী হবে?

স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে ছিলেন রঞ্জন দইমারি। তাঁর গোষ্ঠীর নাম  NDFB(RD)। অন্য সংগঠনের মধ্যে রয়েছে NDFB (Progressive) ও NDFB(S)। ২০০৮ সালের অক্টোবর মাসে আসামে ধারাবাহিক বিস্ফোরণে ৯০ জনের হত্যার ঘটনায় রঞ্জন দইমারি ও আরও ৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। চুক্তিতে বলা হয়েছে "যেসব অপরাধ তত নৃশংস নয়, সে মামলা প্রত্যাহার করা হবে এবং নৃশংস অপরাধের মামলাগুলি এ বিষয়ক বর্তমান নীতি অনুসারে আলাদা করে পর্যালোচনা করা হবে।"

২০১৪ সালে বকসা জেলার খাগরাবাড়িতে বোড়ো উগ্রপন্থীরা ৪০ জন বাঙালি মুসলিমদের গুলি করে হত্যা করে বলে অভিযোগ। গুয়াহাটির বিশেষ এনআইএ আদালতে খুন হওয়া পরিবারের পক্ষে মামলা লড়ছেন আইনজীবী আমন ওয়াদুদ। তিনি বলেন, "কোনও সমঝোতাই এই জঘন্য গণহত্যায় অভিযুক্তদের রেহাই দিতে পারে না। চুক্তিতে বলা হয়েছে নৃশংস অপরাধ পর্যালোচনা করা হবে। শান্তির নামে ন্যায়বিচারের কণ্ঠরোধ করা যায় না।"

৩০ জানুয়ারি NDFB গোষ্ঠীগুলির ১৫০০ কর্মী রাজ্য সরকারের সামনে অস্ত্র সমর্পণ করবেন। চুক্তিতে বলা হয়েছে নয়া দিল্লি ও দিসপুর এই কর্মীদের পুনর্বাসনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। এর মধ্যে রয়েছে অনুদান, আর্থিক কাজকর্মের ফান্ডিং, বৃত্তিগত প্রশিক্ষণ ও যথাযথ সরকারি চাকরি।