British engineer Harley Dalrymple-Hay imagined underwater train: শহর কলকাতা। এই শহর বহুদিন ধরেই স্বপ্ন দেখত, বিলেতের মত এখানেও জলের নীচ দিয়ে ট্রেন ছুটবে। যা এক করে দেবে যমজ শহর কলকাতা আর হাওড়াকে। সেই আদ্যিকালের রবীন্দ্র সেতু আর পরবর্তীকালে বিদ্যাসাগর সেতু আছে বটে। তা দিয়েই দুই শহরের মধ্যে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ হয়। কিন্তু, সে তো মোটরযানের ব্যবহারের জন্য। কলকাতা তথা রাজ্যবাসীর, হাওড়া-কলকাতার মধ্যে ট্রেন চলাচলের সেই স্বপ্ন পূরণ করল কলকাতা মেট্রো। উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী।
তবে এত সময় লাগার কিন্তু, কথা ছিল না। কারণ, একশো বছর আগেই এভাবে ট্রেন চলাচলের পরিকল্পনা করে ফেলেছিলেন বাংলায় জন্ম নেওয়া এক ব্রিটিশ ইঞ্জিনিয়ার। তিনি হলেন, স্যার হার্লি ডালরিম্পল-হে। তিনি কলকাতা আর হাওড়াকে যুক্ত করতে ১০ স্টপেজের ১০.৬ কিলোমিটার (৬.৫ মাইল) ভূগর্ভস্থ রেলপথের কল্পনা করেছিলেন। কিন্তু, পর্যাপ্ত তহবিলের অভাব এবং শহরের মাটির ভূতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে সন্দেহ থাকায় এই বিরাট পরিকল্পনা কখনও বাস্তবায়িত হয়নি।
যাইহোক, একশো বছর পরে হলেও তাঁর সেই পরিকল্পনা অবশেষে সার্থক করল কলকাতা মেট্রো। যে কলকাতা মেট্রোর বয়স ১৫০ বছরের চেয়েও বেশি বয়সি ভারতীয় রেলের হাঁটুর সমান বললেও কম বলা হয়। ভারতে মেট্রো রেল প্রথম চালু হয়েছিল কলকাতায়। সেটা ছিল একটা রেকর্ড। সময়টা ছিল ১৯৮৪ সালের অক্টোবর। সেই সময় মেট্রো চলত মাত্র ৩.৪ কিলোমিটার পথ। ছিল পাঁচটি স্টেশন। এখন অবশ্য সেসব কেবলই অতীত। ৩১ কিলোমিটারেরও বেশি নেটওয়ার্ক, ৩৬টিরও বেশি স্টেশন নিয়ে তৈরি কলকাতা মেট্রো ফের রেকর্ড গড়ল বুধবার- ৬ মার্চ, ২০২৪। এই নতুন রেকর্ড হল, দেশে প্রথমবার জলের নীচ দিয়ে মেট্রো চলাচলের।
নদীর তলদেশের জোড়া টানেলগুলো ৫২০ মিটার দীর্ঘ এবং কলকাতা ও হাওড়াকে সংযুক্তকারী ৪.৮ কিলোমিটার (২.৯৮ মাইল) মেট্রোপথের অংশ। এটি নদীর উপরিভাগের ৫২ ফুট নীচে অবস্থিত। ঘণ্টায় ৩,০০০-এরও বেশি যাত্রী পরিষেবা দেবে বলে দাবি মেট্রো কর্তৃপক্ষের। মেট্রোর এই আন্ডারওয়াটার অংশ হাওড়া এবং পূর্ব কলকাতার সল্টলেকের মধ্যে একটি দীর্ঘ মেট্রোপথের ভাগ। যা ১৯২১ সালে স্যার হার্লি ডালরিম্পলের নকশার প্রতিফলন।
কিন্তু, স্যার হার্লি শুধুমাত্র একটি মেট্রোপথেরই ডিজাইনই করেননি। তিনি কলকাতার জন্য একটি সম্পূর্ণ ভূগর্ভস্থ রেলপথের মাস্টারপ্ল্যান বানিয়েছিলেন। যে রেলপথের লাইন মধ্য কলকাতা ছাড়িয়ে উত্তর এবং দক্ষিণের বিস্তীর্ণ অঞ্চল পর্যন্ত ছড়ানোর কথা ছিল। বিষয়টি 'ক্যালকাটা টিউব রেলওয়ে' নামে একটি বইয়ে স্যার হার্লি বিস্তারিত জানিয়েছেন। তাঁর এই বই কলকাতার জটিল এবং সূক্ষ্ম রঙিন মানচিত্রের ভাণ্ডার। এখানে রয়েছে মেট্রোপথের অঙ্কন। রয়েছে, টিউব রেল তৈরির জন্য বিস্তারিত খরচের অনুমানও।
তিনি একশো বছর আগেই সব স্টেশনে চলমান সিঁড়ি এবং ফ্যান বসানোর সুপারিশ করেছিলেন। স্যার হার্লি লিখেছেন, 'ট্রেনে এবং ভূগর্ভস্থ স্টেশনগুলোয় আরামদায়ক তাপমাত্রা বজায় রাখার প্রশ্নটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, কলকাতায় বছরের নির্দিষ্ট ঋতুতে ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বেশ বেশি থাকে।' স্যার হার্লি যখন কলকাতায় ভূগর্ভস্থ মেট্রো রেলের পরিকল্পনার কথা ভাবেন, সেই সময় অবশ্য লন্ডন, প্যারিস এবং নিউ ইয়র্কে ভূগর্ভস্থ মেট্রোরেল চালু হয়ে গিয়েছিল।
১৮৬৩ সালের ১০ জানুয়ারি, মেট্রোপলিটান রেলওয়ে, লন্ডনের প্যাডিংটন (যাকে তখন বিশপস রোড বলা হত) এবং ফারিংডন স্ট্রিটের মধ্যে বিশ্বের প্রথম ভূগর্ভস্থ রেলপথ চালু করে। বিশ্বের প্রথম নদীর তলদেশে টানেল বা টেমস টানেল ১৮৪৩ সালের জানুয়ারিতে চালু হয়েছিল। ব্যস্ত নদীর তলদেশে পণ্য পরিবহণের অনুমতি দেওয়ার জন্য স্যার মার্ক ব্রুনেল এবং তাঁর ছেলে ইসামবার্ড নামে একজন ইঞ্জিনিয়ার এটি তৈরি করেছিলেন। যদিও তাঁদের অর্থ ফুরিয়ে গিয়েছিল, তাই শুরুতে, এটি পথচারীদের আকর্ষণ করতে খোলা হয়েছিল।
১৯২১ সাল নাগাদ, লন্ডনে টেমসের নীচে ১০টি টানেল চালু হয়েছিল। যেখানে পথচারীদের জন্য রাস্তা, মোটরযানের পথের পাশাপাশি চালু করা হয়েছিল রেলপথও। সেই হিসেবে ১৯২১ সালে স্যার হার্লি যখন কলকাতার জন্য এই পরিকল্পনা করেছিলেন, তখন সেটা ইউরোপের কাছে কোনও বড় ব্যাপার ছিল না। তবে, কলকাতা আর ভারতের কাছে অবশ্যই বড় ব্যাপার ছিল।
স্যার হার্লি ১৮৬১ সালে পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি এডিনবার্গে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েন। তারপর লন্ডনে আন্ডারগ্রাউন্ড রেলপথ নির্মাণে যোগ দেন। তিনি বেকারলু লাইন, হ্যাম্পস্টেড টিউব এবং পিকাডিলি লাইনে কাজ করেছিলেন। সেই সময়ে ব্রিটিশ ভারতে ক্ষমতাসীন ইম্পেরিয়াল লেজিসলেটিভ কাউন্সিল সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, কলকাতায় একটি টিউব রেল তৈরি করা হবে। ১৯২১ সালে স্যার হার্লিকে সেই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল।
সেই সময় অবশ্য কলকাতা আর ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী ছিল না। কিন্তু, এটি ছিল বাণিজ্যের একটি ব্যস্ত কেন্দ্র। হাওড়ায় কলকারখানা গড়ে উঠছিল। এই দুই শহরে কাজ করার জন্য সারা ভারত থেকে লোকজন আসতেন। কিন্তু, গণপরিবহণ খুবই কম ছিল। সেই সময়ে কলকাতা ও হাওড়ার মধ্যে একমাত্র সড়ক যোগাযোগ ছিল হুগলিজুড়ে একটি পন্টুন ব্রিজ। নৌকোও যাত্রীদের নদী পার করিয়ে দিত। বিখ্যাত হাওড়া ব্রিজটি এরপর ১৯৪৩ সালে চালু হয়।
মজার কথা হল, স্যার হার্লি কলকাতায় পা না-দিয়েই শহরের জন্য টিউব রেলের নকশা বানিয়েছিলেন। তিনি একজন সহকারিকে পাঠিয়েছিলেন। সেই সহকারির দায়িত্ব ছিল, সমস্ত প্রয়োজনীয় তথ্য জোগাড় করা। যাতে কলকাতায় টিউব রেলপথ নির্মাণের প্রশ্নে এবং হাওড়ার পার্শ্ববর্তী পুরসভার ব্যাপারে সরকারের কাছে বিস্তারিত রিপোর্ট জমা দেওয়া সম্ভব হয়। স্যার হার্লির প্রস্তাবিত নেটওয়ার্কের প্রথম অংশের লক্ষ্য ছিল পূর্ব কলকাতার কাছেই বাগমারিকে হাওড়ার বেনারস রোডের সঙ্গে যুক্ত করা। কিন্তু, খরচ ধরা হয়েছিল আনুমানিক ৩.৫ মিলিয়ন পাউন্ড। যা অত্যন্ত ব্যয়বহুল হওয়ায় পরিকল্পনা বাতিল করা হয়।
১৯৪৭ সালের ডিসেম্বরে, দ্য ক্যালকাটা মিউনিসিপ্যাল গেজেট শহরের টিউব রেলের স্বপ্নের সমাপ্তির খবর প্রথম পাতায় প্রকাশ করে। একটি বৈঠকের পর কলকাতা পুরসভার এক কাউন্সিলর বলেছিলেন, 'এর চেয়ে বরং একটি ওভারহেড (মাটির ওপরের) রেলপথই ভালো। তাছাড়া পলিমাটি, কাদামাটি এবং নরম মাটির ওপর হুগলির নীচে একটি টানেল তৈরি সম্ভব কি না, তা নিয়েও সন্দেহ ছিল।' তারপরই, ভারতের প্রথম জলের নীচে রেলপথের পরিকল্পনার আনুষ্ঠানিকভাবে সমাপ্তি ঘটে।
আরও পড়ুন- মাওবাদী কার্যকলাপের অভিযোগ, বেকসুর খালাস দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক
তাঁর টিউব রেল পরিকল্পনাটি সেই সময় দিনের আলো না দেখলেও, স্যার হার্লি কলকাতায় তাঁর পরিকল্পনার একটি ছাপ রেখে গেছেন। ১৯২৮ সালে, কলকাতা শহরের বিদ্যুৎ সরবরাহকারী সংস্থা, সিইএসসি তাঁকে কলকাতা থেকে হাওড়ায় বিদ্যুতের তার পাঠানোর জন্য হুগলি নদীর নীচে একটি টানেল তৈরি করতে অনুরোধ করে। স্যার হার্লি চ্যালেঞ্জটি গ্রহণ করেন। শর্ত ছিল সিইএসসি এমন একজন ঠিকাদারকে কাজটি দেবে, যাঁকে তিনি (স্যার হার্লি) বিশ্বাস করেন। সিইএসসি সেই প্রস্তাবে রাজি হয়। আর, ১৯৩১ সালে কলকাতায় প্রথম আন্ডারওয়াটার টানেল তৈরি হয়।