সম্প্রতি বুলেট ট্রেন প্রকল্পের একটি "পর্যালোচনা" ঘোষণা করেছেন মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী উদ্ধব ঠাকরে, যার ফলে গোটা প্রকল্পটি ঘিরেই সৃষ্টি হয়েছে সংশয়ের মেঘ। রবিবার রাতে সাংবাদিকদের ঠাকরে বলেন, "এই সরকার সাধারণ মানুষের সরকার। হ্যাঁ, আমরা বুলেট ট্রেন প্রজেক্টের পর্যালোচনা করব। আমি কি (মুম্বইয়ের) আরে কার শেড প্রকল্পের মতো বুলেট ট্রেন প্রকল্পও স্থগিত রাখছি? না, তা রাখছি না।"
ভারতের বুলেট ট্রেন নিয়ে বিতর্ক নতুন নয়। গোড়া থেকেই জমি অধিগ্রহণ নিয়ে বিতর্কে জড়িয়েছে ন্যাশনাল হাই স্পিড রেল কর্পোরেশন লিমিটেড (NHSRCL), যে সংস্থার অধীনে রয়েছে গোটা প্রকল্পটি। বিশেষ করে উপজাতি-অধ্যুষিত এলাকায় জমি অধিগ্রহণ করা নিয়ে সমস্যা দেখা দিয়েছে। আদালতে মামলা দায়ের করেছেন কিছু কৃষকও। এছাড়াও ১.১ লক্ষ কোটি টাকা ব্যয়ে আহমেদাবাদ থেকে মুম্বই পর্যন্ত রেল করিডোর বানানোর পরিকল্পনারই বিরোধিতা করেছেন অনেকেই, যদিও এই প্রকল্পের ৮০ শতাংশ অর্থই ঋণ হিসেবে দিচ্ছে জাপান।
গুজরাটে প্রয়োজনীয় ৯৪০ হেক্টর জমির বদলে অধিগৃহীত হয়েছে ৬১৭ হেক্টর; মহারাষ্ট্রে প্রয়োজন ৪৩১ হেক্টর, এখন পর্যন্ত পাওয়া গিয়েছে ৮১ হেক্টর। দাদরা ও নগর হাভেলিতে প্রয়োজনীয় ৮.৭ হেক্টরের পরিবর্তে পাওয়া গিয়েছে ৬.৯ হেক্টর।
মহারাষ্ট্রে কেন ধীরগতিতে এগোচ্ছে জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া?
এর প্রধান কারণ হলো পালঘর জেলা, যেখানে প্রকল্পের জন্য প্রয়োজন ২৮৬ হেক্টর। কিন্তু বিগত প্রায় একবছর ধরে চলছে জমি মালিকদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা, যদিও গত কয়েক মাসে জমি দিতে সম্মত হয়েছেন বেশ কিছু মানুষ, যার ফলে বর্তমানে পালঘরে অধিগৃহীত জমির পরিমাণ ৩১ হেক্টর, যেখানে প্রয়োজন ২৮৬ হেক্টরের। এই সম্মতিও সহজে পাওয়া যায় নি। ক্ষতিপূরণ বাবদ টাকা ছাড়াও দিতে হয়েছে বিভিন্ন সুবিধে, যেমন গ্রামবাসীদের জন্য চিকিৎসা পরিষেবা, এবং গ্রামের উন্নয়ন বাবদ কিছু অতিরিক্ত অর্থ।
যে ৭৩টি গ্রামে জমি প্রয়োজন, সেগুলির মধ্যে ৬৫টি গ্রামে যৌথভাবে চালানো হয়েছে জরিপের কাজ। এই যৌথ কর্মকাণ্ডের যথেষ্ট তাৎপর্য এই কারণে যে, জমির মালিক এবং প্রকল্পের ইঞ্জিনিয়াররা একযোগে এই কাজে জড়িত ছিলেন, একেবারে হাতেকলমে। সংস্থার তরফে একজন পৃথক ম্যানেজার নিযুক্ত হয়েছেন স্রেফ পালঘরের জন্য।
গুজরাটে ২০১৬ সালে সরকারের দ্বারা পরিবর্তিত জমি অধিগ্রহণ আইনের আওতায় হাইকোর্টে খারিজ হয়ে যায় কৃষকদের ১২০টি আবেদন, যার ফলে মসৃণতর হয়ে যায় অধিগ্রহণের কাজ। প্রকল্পের প্রান্তসীমা জুড়ে যে জমি, তা বিভক্ত হয়েছে সাত হাজারটি প্লটে, যেগুলি ছড়িয়ে রয়েছে গুজরাটের ১৯৫টি, এবং মহারাষ্ট্রের ১০৪টি গ্রামের মধ্যে।
নতুন মহারাষ্ট্র সরকার কি প্রকল্প বাতিল করে দিতে পারে?
এই প্রকল্পে সরাসরি কোনও অর্থব্যয় করছে না মহারাষ্ট্র, স্রেফ জমি দিয়ে সাহায্য করছে। গুজরাট এবং মহারাষ্ট্র উভয়েরই এই প্রকল্পের ২৫ শতাংশ করে মালিকানা রয়েছে। বাকি ৫০ শতাংশের মালিক ভারত সরকার। জমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত নিয়ম বদলাতে পারে রাজ্য সরকার, কিন্তু জাপানের সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের চুক্তির ওপর প্রভাব পড়তে পারবে না।
একথা সত্যি যে, সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে রাজ্যের কাছে প্রকল্পের গুরুত্ব বাড়তে বা কমতে পারে। বিজেপির দেবেন্দ্র ফড়নবিশ মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন বুলেট ট্রেন প্রকল্প ছিল তাঁর 'ওয়ার রুম', অর্থাৎ মুখ্যমন্ত্রীর দফতরের সরাসরি নজরদারিতে। প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত আধিকারিকদের মতে, এর ফলে জমি অধিগ্রহণের কাজে বড় রকমের সুবিধে হয়েছিল - বুলেট ট্রেনের সঙ্গে যুক্ত যে কোনও কাজই অগ্রাধিকার পেত সর্বস্তরেই, তা সে মুম্বইয়ের সচিবালয় হোক বা জেলা প্রশাসন।
পালঘরে রাজনৈতিক আধিপত্য শিবসেনার। সাংসদ রাজেন্দ্র গাভিত শিবসেনার সদস্য। এর আগে পালঘর এবং সংলগ্ন এলাকায় প্রকল্পের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে শিবসেনা। জমিতে কর্মরত NHSRCL আধিকারিকদের সঙ্গে বচসাতেও জড়িয়েছেন শিবসেনার নেতারা।
সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে কি বদলে দেওয়া যায় প্রান্তসীমা?
ঠিক কোথা থেকে কোথায় যাবে রেল করিডোর, তা নির্দিষ্ট করবে সরকার, কিন্তু পুঙ্খানুপুঙ্খ প্রান্তসীমা নির্ধারণ করা হয়েছে নানারকমের প্রযুক্তিগত মাপজোক এবং জরিপ ইত্যাদির পর। অর্থাৎ চাইলেই এগুলি বদলে দেওয়া যাবে না। উদাহরণ স্বরূপ ধরুন ট্র্যাকের হাই-স্পিড অংশগুলি। ৩০০ কিমি প্রতি ঘণ্টা বা তার বেশি গতিবেগ হলেই যথাসম্ভব সোজা লাইনে চালাতে হবে ট্রেন, আঁকাবাঁকা হলে চলবে না। অতএব সর্পিল হতে পারবে না ট্র্যাকের প্রকৃতি।
অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া তরান্বিত করা যায়?
জমি মালিকের অনুমতি পেলে তবেই জমি অধিগ্রহণের পন্থা অবলম্বন করেছে NHSRCL, জনস্বার্থে অধিগ্রহণের যে ক্ষমতা বিভিন্ন সরকারি সংস্থাকে আইনত প্রদান করা হয়েছে, তা প্রয়োগ না করে। রাইট টু ফেয়ার কম্পেনসেশন অ্যান্ড ট্রান্সপ্যারেন্সি ইন ল্যান্ড অ্যাকুইজিশন, রিহ্যাবিলিটেশন অ্যান্ড রিসেটলমেন্ট অ্যাক্ট (২০১৩) অনুযায়ী লাইন বসানোর কাজের জন্য প্রয়োজনে কিছু পক্ষের সম্মতি ছাড়াও ক্ষতিপূরণ দিয়ে জমি অধিগ্রহণ করা যেত। কিন্তু সংস্থা সেই পথে হাঁটবে না বলেই জানিয়েছেন আধিকারিকরা।