আশিতে আসিও না। বৃদ্ধ হতে কে আর চায়! সারা জীবন ধরে যৌবন ধরে রাখার কৌশল যদি থাকত হাতের মুঠোয়, কী মজাই না হত! কল্পনাতে অবশ্য এ সব হতে পারে, মৃত্যুকে রোখা যায় না। জীবনেরই অঙ্গ সে। তবে বিকল্প হিসেবে অনেক দিন হাত-পা ছড়িয়ে মজায় ফুর্তিতে সুস্থ ভাবে বাঁচা যেত যদি তাহলেও মন্দ হত না। বুড়ো হয়ে গিয়েছি, কিন্তু বুড়োত্বের কোনও চিহ্নই নেই গায়ে, বা ছিঁটেফোঁটা আছে। চেহারায় এক লহমায় কারওকে মুগ্ধ করে দিতে পারি এখনও-- এই যদি হত, আহা কী ভালই না হত তাই না…!
ভারত-পাক নিয়ন্ত্রণ রেখার কাছে বাস করা হুনজাদের কথাই ধরুন, ১০০-১২০ বছর বেঁচে থাকা নাকি তাদের বাঁ-হাতের খেলা। তাদের খাওয়াদাওয়াই এমন যে, মৃত্যু সহজে আসতে পারে না ধারে-কাছে! দেখা যায়, ৬০ বছরেও কেউ কেউ বিয়ের পিঁড়িতে বসছেন। জন্মের পর থেকে হুনজাদের দীর্ঘায়ু হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। জীবনের সব কিছুতেই তা জুড়ে থাকে। ফলে গড় আয়ু তাঁদের ১০০ ছুঁয়েছে। সত্যমিথ্যা জানি না, এই খবর ছড়ানো নেট দুনিয়ায়। এই লেখার মাধ্যমে গিলগিটের কাছে হুনজাদের গ্রামে আপনাদের নিয়ে যাওয়ার কোনও ইচ্ছাই আমার নেই। তার উপর লকডাউন চলছে! চলুন এই অবসরে এবং বিষয়টা যখন উঠেই গিয়েছে, তখন একটু বয়স নিয়ে আলোচনা করা যাক।
কতদিন একটা মানুষ বাঁচতে পারে প্রকৃতির নিয়মে? সে ব্যাপারে রেকর্ড করেছেন ফ্রান্সের জিন কালমেট। তিনি ১৯৯৭ সালে যখন মারা গেলেন-- তাঁর বয়স মাত্র ১২২ বছর ১৬৪ দিন। আমার-আপনার মতো কেউ এই স্বপ্ন দেখতে পারবে না। আমরা তো চল্লিশ পেরোলেই চালশে, তবে কালমেটের বয়স নিয়ে নাড়াচাড়া হচ্ছে এ সংক্রান্ত গবেষণার ফলে। রিসার্চ বলছে মানুষ ১৫০ বছরও বাঁচতে পারে। সেই জন্যে পরিবেশ তার সহায় হতে হবে তার। ১৫০ বছর বাঁচার কথা শুনে যাঁদের হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে, তাঁদের জন্য এই লেখাটা উৎসর্গ করছি।
জুন মাসের ৩০ তারিখ একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে ডেমোগ্রাফিক রিসার্চ জার্নালে। কাজটি করেছেন, গবেষক মাইকেল পিয়ার্স এবং প্রোফেসর আদ্রিয়ান রাফটেরি। এঁরা ইউনিভার্সিটি অফ ওয়াশিংটনের। এঁদের যে পূর্বাভাস, তাতে আপনি নেচে উঠতে পারেন। গবেষকরা জানাচ্ছেন, ২০২০ থেকে ২১০০ সাল পর্যন্ত বাড়তে থাকবে মানুষের বেঁচে থাকার সময়। ১২২ বছর বাঁচার কালমেটের রেকর্ড ভেঙে যাওয়ার ১০০ % সম্ভাবনা। ১২৪ বছরের আয়ু পেরনোর সম্ভাবনা ৯৯ %। ১২৭ বছরের আয়ু পেরতে পারে ৬৮ %। আর ১৩০ বছরের আয়ু বা আয়ুর আইফেল টাওয়ার স্পর্শ করার সম্ভাবনা থাকছে ১৩ শতাংশ।
আরও পড়ুন কোভিডের অ্যান্টিবডি টেস্ট কাজ করে কী ভাবে, এই পরীক্ষা কতটা নির্ভুল
১২০ থেকে ১৫০
আরেকটি গবেষণায় উঠে এসেছে মানসিক চাপ, প্রবল ব্যায়াম, অসুস্থ হয়ে পড়ার মতো বিষয়গুলি কীভাবে বয়সকালের উপর প্রভাব বিস্তার করে, তার খুঁটিনাটি। সিঙ্গাপুর নির্ভর বায়োটেক সংস্থা গেরো (GERO) এই গবেষণাটি করেছে। টিম পিরকভ (Tim Pyrkov) কাজটির নেতৃত্বে ছিলেন। পিরকভ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে একটি ইমেলে এ সংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তরে জানান, 'বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে লড়াই করার ক্ষমতা কমে যায়, এই লড়াইয়ের ক্ষমতা কত দিন থাকছে, তার উপরেই নির্ভর করছে আয়ু। আমরা তারই বিচার-বিশ্লেষণ করেছি।' এই লড়াইয়ের ক্ষমতার একটি সূচক রয়েছে। যার নাম DOSI, Dynamic Organism State Index। পিরকভ বলছেন, রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে আয়ুর আভাস পাওয়া যায়।
জীবনের মেয়াদ
১০০ বছর বেঁচে আছেন, এমন মানুষজনের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। কিন্তু বয়স ১১০ পেরিয়ে অনেকেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছেন, ১১০ পেরনোদের সংখ্যাটা তলানিতে ঠেকছে। ইউনিভার্সিটি অফ ওয়াশিংটনের গবেষকরা যে পদ্ধতির উপর নির্ভর করে ২১০০ সালের আয়ুর হিসেব করেছেন, তা হল বেসিয়ান (Bayesian) পরিসংখ্যান, যা একটি সম্ভাবনার তত্ত্ব। তথ্য বিশ্লেষণ করে সম্ভাবনা খাড়া করে এই পদ্ধতি। অষ্টাদশ শতাব্দীর অঙ্কবিদ থমাস বেসিয়ানের তত্ত্ব এটি। বেসিয়ান গুরুত্বহীন তথ্যকে কী ভাবে পরিসংখ্যান পদ্ধতিতে ব্যবহার করা যায়, তা-ই দেখান।
আগামীতে আয়ু কত হবে, তার বিশ্লেষণে ম্যাক্স প্লাঙ্ক ইনস্টিটিউট অফ ডেমোগ্রাফিক রিসার্চের তথ্য কাজে লাগিয়েছেন গবেষকরা। দশটি ইউরোপীয় দেশের সুপার সেন্টিনারিদের সম্পর্কে ইনফরমেশন দিয়েছে ওই সংস্থা। কানাডা, জাপান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তথ্যও দিয়েছে।
১১০-এ পৌছানোর পরে
১১০ বছর বয়স পেরোনোর পর ১১৪ বছরে কত জন পৌঁছতে পারেন, কিংবা ১২৭ বছর থেকে ১৩৫ বছরে কত জন পা রাখতে পারেন, এ ব্যাপারে গবেষণায় আলো ফেলা হয়েছে। দেখা গিয়েছে, ১১০ থেকে ১২০ বছর পর্যন্ত বাঁচেন ১০ লাখের মধ্যে এক জন। ৩ কোটি ২০ লক্ষের একজন ১৩৫ বছর বাঁচতে পারেন। কিন্তু ১১০ বছরে পৌঁছতে পারেন এমন মানুষের সংখ্যাটা এর চেয়ে অনেক কম। স্বাভাবিক ভাবেই ১৩৫ বছরে পৌঁছানো মানুষজনের সংখ্যাটা আরও কম হবে বৈকি।
আরও পড়ুন তিমির বমি ভীষণ দামি, কেন এত দাম? জানলে অবাক হবেন
কেন ১৫০, কেন নয়
গেরো-র গবেষণা থেকে ১৫০ বছর বাঁচার যে অনুমান বেরিয়ে এসেছে, তার পিছনে রয়েছে বড় অসুখ না থাকার মতো বিষয়। স্বাভাবিক ভাবেই কোনও বড় রোগ না থাকা বা নীরোগ মানুষ বেশি দিন বাঁচবেন। সবই নির্ভর করছে প্রতিরোধশক্তির উপর। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে তা কমবেই। একটা সময় গিয়ে শূন্য হয়ে যাবে, এবং মৃত্যু ডেকে আনবে। প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর থেরাপি করে দেখা গিয়েছে, আয়ু বাড়ছে।
জীবন এক মায়ার নাম। বেঁচে থাকা এক অনন্ত ইচ্ছা। দাদা, আমি বাঁচতে চাই…. এই ইচ্ছার জন্য মানুষের প্রাণপণ লড়াই। যো জিতা ওহি সিকন্দর। কে জিতবে কে হারবে, কে সেঞ্চুরি করবে, কে করবে না, তা যেন এক স্রোতের মতো, পরিবর্তনশীল। তবে এই করোনাকালে মৃত্যু যখন মাথার কাছে ফণা তুলে দাঁড়িয়ে, তখন শত বছরের বেশি জীবনের এই আলোচনা হাস্যকর কিনা জানি না।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন