ভারতবর্ষ সূর্যের এক নাম। সূর্য বড় প্রিয় আমাদের, তাই সব সময় সূর্য-তুলনা। হবেই বা কেন, সূর্য না থাকলে, পৃথিবী থাকত না। এই সভ্যতা কিংবা অসভ্যতা কিছুই থাকত না, এই ক্ষুদ্র মসিজীবীর জন্মের জাগতিক কোনও প্রশ্নও থাকত না। কিন্তু সূর্য থেকেও কখনও কখনও সাবধান থাকতে হয়। সূর্য-সতর্কতার সমীকরণ আবিষ্কার করতে হয়। একটি গবেষণাপত্র বলছে, সূর্য আমাদের শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে জড়িয়ে পড়া ইন্টারনেট-ব্যবস্থার সত্য়নাশ ঘটিয়ে দিতে পারে। ACM SIGCOMM 2021 সম্মেলনে এই গবেষণাপত্রটি সামনে এসেছে। গত মাসে কাজটি হলেও, এ নিয়ে সারা পৃথিবী ক্রমে ক্রমে গভীর চিন্তায় ডুবছে। সোলার স্টর্ম বা সৌর ঝড়ের কথা বলছে ওই গবেষণা। যা কি না হামলা চালাতে পারে স্যাটেলাইট, ভূগর্ভস্থ ম্যামথ কেবল নেটওয়ার্কে। তাতেই ইন্টারনেট মুখ থুবড়ে পড়ার সমূহ আশঙ্কা।
সোলার স্টর্ম বা সৌর ঝড় কী বস্তু?
সূর্যের পরিধি থেকে অতি চৌম্বকীয় পার্টিক্যল ছিটকে বেরিয়ে এসে এই সৌর ঝড়ের জন্ম দেয়। এই সব কণা ঘণ্টায় বহু লক্ষ কিলোমিটার পেরিয়ে যেতে পারে। পৃথিবীতে এসে পৌঁছতে ১৩ থেকে পাঁচ দিন সময় লাগতে পারে এগুলির। পৃথিবীর পরিবেশ মানুষকে এ থেকে রক্ষা করবে। কিন্তু কণাগুলির প্রবল বৈদ্যুতিক তরঙ্গ, যা ঝাঁপ কাটবে, এর সঙ্গে পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তির একটি টানাপোড়েন তৈরি হবে। মনুষ্য-সৃষ্ট কাঠামোয় প্রভাব পড়বে ভালই। ইন্টারনেটেও গুরুতর বিঘ্ন ঘটতে পারে, তবে সে জন্য সৌর-কণা কণামাত্র দুঃখিত হবে না, তারা নির্মোহ!
না, অনেকের কাছে সোলার স্টর্ম নতুন মনে হলেও, এটা অতি পুরাতন ব্যাপার। প্রথম সৌর ঝড় নথিভুক্ত হয়েছে ইন দ্য ইয়ার অফ এইটটিন ফিফটি নাইনে। পৃথিবীতে সৌর-কণাগুলি পৌঁছেছিল সে বার ১৭ ঘণ্টায়। তখন ইন্টারনেটের নাম-নিশান ছিল না, কিন্তু টেলিগ্রাফ নেটওয়ার্ক রীতিমতো ঝমেলায় পড়েছিল, বৈদ্যুতিক ঝটকার অভিজ্ঞতাও হয়েছিল তীব্র মাত্রায়। ১৯২১ সালে সোলার স্টর্ম হয়েছিল আরও একবার, তখন নিউইয়র্কের টেলিগ্রাফ, রেল ব্যবস্থায় তার প্রভাব পড়েছিল। একটি সৌর কণা-ঝড় হয়েছিল ১৯৮৯ সালে। কানাডার কাবাকের পাওয়ার গ্রিড ব্যবস্থা সেই ঝড়ে গোঁত্তা খেয়ে পড়ে।
২০১৩ সালের একটি রিপোর্ট বলছে, যদি ১৮৫৯ সালের মতো কোনও সৌর ঝড় এখন মার্কিন মুলুকে হামলা করে, তবে ২ বছর পর্যন্ত বিদ্যুৎবিহীন হয়ে থাকতে পারে বাইডেনের দেশ। অর্থনৈতিক ক্ষতি হতে পারে সর্বাধিক ২৬০ কোটি ডলার। গত তিন দশকে প্রযুক্তি ক্ষেত্রে প্রভূত উন্নতি হয়েছে, কিন্তু আমাদের এই অনন্যসাধারণ যোগাযোগ-পরিকাঠামো সৌর ঝড় অদৌ ঠেকাতে পারবে কি না এবং এ ব্যাপারে তার শক্তি কতটা, সেই সম্পর্কে গবেষণা হয়েছে নাম-মাত্র। 'সূর্যের এই কণা-গতিবিধি শতবর্ষের চক্রে আবর্তিত। যা হ্রাস-বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে চলে। গত তিন দশকে প্রযুক্তির এই উল্লম্ফন-পর্যায়ে এই সৌর-গতিবিধি কমতিতে ছিল, আগামী সময়ে নিয়ম মোতাবেক বাড়বে। শুধু বাড়বে বলা ভুল, আমরা হয়তো জীবদ্দশার সবচেয়ে শক্তিশালী সোলার স্টর্ম দেখব, হতে পারে এমনও।' জুম কলে বললেন ওই গবেষণাপত্রের লেখিকা সঙ্গীতা আবদু জ্যোতি। ক্যালিফোর্নি বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রোফেসর তিনি।
ভারত এবং ইন্টারনেট
সমুদ্রগর্ভে থাকা কেবলগুলির ( submarine cable) ভয় বেশি। মডেলিং গবেষণা দেখিয়েছে কোন দেশের কেবল নেটওয়ার্ক কতটা প্রভাবিত হবে এই সৌর ঝড়ে। দেখা যাচ্ছে, ভারতের সমুদ্রগর্ভে থাকা কেবলগুলির সবচেয়ে কম সমস্যায় পড়ার সম্ভাবনা। গবেষণা এও বলছে, ' যদি চরম ধাক্কা খায় যোগাযোগ-ব্যবস্থা, তাও কিছু আন্তর্জাতিক কানেক্টিভিটি জারি থাকবে। বড় বিপর্যয়ে মুম্বই, চেন্নাইয়ের মতো শহরগুলিতে নেট-যোগাযোগ থাকবে।'
মার্কিন মুলুক, যোগাযোগের এক স্বর্গ, তার চেয়ে ভারতে প্রভাব অনেক কম পড়বে, গবেষণা বললেও, তারা সোলার স্টর্মের তীব্রতা কতটা মানে কতটা মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে এটি, তা নিয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছয়নি। যে সব দেশ নিম্ন অক্ষরেখায় রয়েছে, তাদের ঝুঁকি কম, একথা বললেও, আরও গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে প্রকৃত আলো আবিষ্কারে-- জানাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা।
আরও পড়ুন- গুজরাটের নতুন মুখ্যমন্ত্রীর দৌড়ে কারা, নেপথ্যে কোন সমীকরণ?
আচ্ছা জানেন কি নেটের উপর আমরা কতটা নির্ভরশীল? সকলেই নিশ্চয়ই হ্যাঁ-হ্যাঁ করে উঠবেন। কারণ, এই লেখাটাই আপনারা পড়তে পেতেন না যদি-না নেট থাকত। লেখাটা তো তুচ্ছাতিতুচ্ছ ব্যাপার, লক্ষ লক্ষ কোটি ডলারের অর্থ-কাঠামো দাঁড়িয়ে রয়েছে এই অন্তর্জালের উপর। মানে আমি আপনি আমরা সবাই অন্তর্জালে বন্দি হয়ে রয়েছি। অথবা নিজেদের মানুষ-মৎস্যও ভাবতে পারেন, জালে বন্দি না ভেবে, ভাবা যায়-- এক ইন্টারনেটের সমুদ্রে আমরা ঘুরে বেড়াচ্ছি, অন্তর্জলের (জাল নয়) প্রাণি-- বললে হয়তো কিম্ভূত শোনাবে--। মার্কিন মুলুকে ইন্টারনেটে এক দিনের বিঘ্ন ঘটলে ক্ষতি কত হবে জানেন কি? ৭০০ কোটি ডলার, এমন হিসেব বেরিয়ে এসেছে সম্প্রতি। সৌর ঝড়ের নতুন গবেষণাপত্র তাই মার্কিন দেশকে ঘোরতর সাবধানবাণী দিচ্ছে। যেমন করে করোনাকে কড়ে আঙুল দেখিয়ে, তুমুল তাচ্ছিল্য করে আমেরিকা বুঝেছে ভুলের পাহাড়ে চড়ে ফেলেছিল তারা, যার মাসুল দিয়ে, ডোনাল্ড ট্রাম্পকেও টাটা দেখাতে হয়েছে, তাই ভুলের পুনরাবৃত্তি আশা করি তারা করবে না। ভারতও 'পিঠ পুড়ছে ফিরে শোও' এই জাতীয় ভাব নিয়ে থাকবে না। ব্যবস্থা নেবে, তৈরি থাকবে সৌর ঝড়ের জন্য়, কোমর কষে।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন