খলিস্তানি জঙ্গি হরদীপ সিং নিজ্জরের খুনের ঘটনায় ভারত-কানাডা কূটনৈতিক সংঘাতে নয়া মোড়। এবার কানাডার ৪১ জন কূটনীতিককে দেশে ফিরিয়ে নিল জাস্টিন ট্রুডো। নয়াদিল্লি কানাডিয়ান কূটনীতিকদের দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য এর আগে রীতিমতো সময় বেঁধে দেয়। ২০ অক্টোবরের মধ্যে ভারতে থাকা কানাডার কূটনীতিকদের দেশে ফিরে যেতে হবে, ট্রুডো সরকারকে কড়া বার্তা দিয় ভারত। সময়সীমা অতিক্রম হয়ে যাওয়ার কারণে কানাডা ভারতে থাকা ৪১ জন কূটনীতিককে দেশে ফিরিয়ে নিয়েছে। এরপরই ভারত-কানাডা কূটনৈতিক সংঘাত চরম আকার ধারণ করেছে। ভারতের বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ সামনে এনেছে কানাডা।
‘ভারত আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ করেছে, লক্ষ লক্ষ মানুষ ভারতের এই সিদ্ধান্তের ফলে সমস্যার সম্মুখীন হবে’… এমনই মন্তব্য করে ভারতের বিরুদ্ধে সুর চড়িয়েছেন জাস্টিন ট্রুডো। এক সংবাদ সম্মেলনে ট্রুডো বলেন, ‘ভারত সরকার ভারত ও কানাডার লক্ষ লক্ষ সাধারণ মানুষের জীবনকে ‘অবিশ্বাস্যরকম কঠিন’ করে তুলছে। তিনি বলেন, ‘ভারত মৌলিক নীতি লঙ্ঘন করেছে’।
ট্রুডো দাবি করেছেন যে ভারত যে পদক্ষেপ নিয়েছে তা আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী। তিনি বলেন, ‘ভারত সরকার একতরফাভাবে ভারতে কানাডার ৪১ জন কূটনীতিকের কূটনীতিককে দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার যে নির্দেশ দিয়েছে তা ভিয়েনা কনভেনশন লঙ্ঘন। আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করেছে ভারত।’ কানাডার প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এটি এমন একটি বিষয় যা নিয়ে বিশ্বের সব দেশেরই ‘উদ্বিগ্ন’ হওয়া উচিত। কানাডার তরফে সে দেশের নাগরিকদের তিনটি ভারতীয় শহর সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছে। বলা হয়েছে, এই শহরগুলিতে ‘অতি সাবধানে’ চলাফেরা করুন। এই তিন শহর হল চণ্ডীগড়, বেঙ্গালুরু এবং মুম্বই।
জাস্টিন ট্রুডো আরও বলেছেন, যে ভারতের এই সিদ্ধান্ত দু’দেশের মধ্যে ভ্রমণ ও বাণিজ্য সম্পর্ককে প্রভাবিত করবে। এর পাশাপাশি কানাডায় পড়তে আসা ভারতীয় ছাত্রদের জন্যও এই সিদ্ধান্ত সমস্যার সৃষ্টি করবে। কানাডায় ভারতীয় বংশোদ্ভূত ২০ লাখ মানুষ বাস করেন। এটি কানাডার মোট জনসংখ্যার পাঁচ শতাংশ। একই সময়ে, বিদেশ থেকে কানাডায় পড়াশুনার জন্য সবচেয়ে বেশি সংখ্যক শিক্ষার্থী ভারতীয়, যা প্রায় ৪০ শতাংশ। ভারত এর আগে ভিয়েনা কনভেনশন লঙ্ঘনের অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছিল।
জুন মাসে কানাডার ব্রিটিশ কলম্বিয়া প্রদেশে খুন হন খলিস্তানপন্থী নেতা হরদীপ সিংহ নিজ্জর। এর পর কানাডার পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো অভিযোগ করেন, খলিস্তানি নেতা খুনের নেপথ্যে ভারতের হাত রয়েছে। মন্তব্যের পর থেকে ভারত-কানাডা টানাপোড়েন অব্যাহত। দুই দেশ থেকেই অপর দেশের শীর্ষ কূটনীতিকদের বহিষ্কার করা হয়েছে। আমেরিকার মাটিতে এনিয়ে সুর চড়িয়েছেন বিদেশমন্ত্রী এস জয়শংকর। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, “কানাডা বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আখড়া হয়ে উঠেছে। যা খুবই উদ্বেগজনক। আমাদের উচিত এই নিয়ে প্রশ্ন তোলা। ভারত সব সময় এর বিরোধিতা করবে।”
ভারত-কানাডার মধ্যে এই সংঘাত আবহে ভারত সরকার দেশে থাকা ৪১ জন কূটনীতিককে কানাডায় ফিরিয়ে নেওয়ার সময়সীমা বেঁধে দেয়। কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো খালিস্তানি সন্ত্রাসবাদী হরদীপ সিং নিজ্জার খুনে ভারতের যোগ থাকার অভিযোগ সামনে এনেছিলেন। এরপর থেকেই দুই দেশের সম্পর্ক প্রায় তলানিতে ঠেকে। কানাডার বিদেশসচিব জোলি ১৯ অক্টোবর কূটনীতিকদের ফোন করে দেশে ফেরার কথা জানান।
সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, “ভারতের কর্মকাণ্ডের কারণে আমাদের কূটনীতিকদের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে আমরা তাদের ভারত থেকে ফিরিয়ে নিয়েছি। ভারত ছেড়ে যাওয়া ৪১ জন কূটনীতিকের পাশাপাশি তাদের পরিবারের সদস্যও রয়েছেন ৪২ জন।” পাশাপাশি জোলি বলেন, কূটনীতিক ফেরানোর এই নির্দেশ “অযৌক্তিক এবং নজিরবিহীন এবং স্পষ্টভাবে এই পদক্ষেপ ভিয়েনা কনভেনশনের নীতিবিরুদ্ধ”।
নিজ্জর খুনে ভারত কানাডার প্রধানমন্ত্রীর দাবি প্রত্যাখ্যান করেছে এবং বলেছে এটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। কানাডায় শীর্ষ ভারতীয় কূটনীতিককে বহিষ্কারের প্রতিবাদে ভারতও পাল্টা জবাব দেয়। ভারতও এক কানাডিয়ান কূটনীতিককে ৫ দিনের মধ্যে দেশ ছাড়ার নির্দেশ দেয়। সেই থেকেই ভারত ও কানাডার সম্পর্কের অবনতি শুরু হয়। ভারত ট্রুডোর সন্দেহকে অযৌক্তিক বলে উড়িয়ে দিয়েছে।
কানাডায় কতজন ভারতীয় ছাত্র পড়াশোনা করে?
৩১ ডিসেম্বর, ২০২২-এর তথ্য অনুসারে, কানাডায় প্রায় ৩ লাখ ২০ হাজার ভারতীয় ছাত্র কানাডায় পড়াশুনা করছেন। তাদের মধ্যে ২,০৯,৯৩০ জন স্নাতক স্তরে হচ্ছে। ৮০,২৭০ জন স্নাতকোত্তর স্তরে পড়াশুনা করছে। ২৮,৯৩০ জন ডিপ্লোমা এবং সার্টিফিকেট কোর্সের জন্য সেদেশে পড়াশুনা করছেন।
ইমিগ্রেশন, রিফিউজিস অ্যান্ড সিটিজেনশিপ কানাডা (আইআরসিসি) ঘোষণা করেছে যে সাময়িকভাবে ভিসা পরিষেবা স্থগিতের সিদ্ধান্ত কেবলমাত্র বেঙ্গালুরু, চণ্ডীগড় এবং মুম্বইয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। তবে, ইন-পার্সন কনস্যুলার পরিষেবাগুলি দিল্লির কানাডা হাই কমিশনে চালু থাকবে বলে জানানো হয়েছে। ভারতের তিনটি শহরে ভিসা এবং কনস্যুলার পরিষেবা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর কানাডার জন্য ভারতীয়দের ভিসার আবেদন কমে যাবে। এই ভিসা আবেদনের মধ্যে একটা বড় অংশ ভারতীয় পড়ুয়াদের তরফে করা হয়ে থাকে যারা কানাডার বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে পড়তে ইচ্ছুক।
অর্থনীতিতে অবদান
খালিস্তান ইস্যুতে ভারত ও কানাডার মধ্যে সম্পর্ক তিক্ত হয়েছে। ভারত সরকারের বিজ্ঞপ্তির পর কানাডা তার ৪১ জন কূটনীতিককে ফিরিয়ে নিয়েছে। শুধু তাই নয়, কানাডা চণ্ডীগড়, মুম্বাই এবং বেঙ্গালুরুতে তার কনস্যুলেটগুলিতে ভিসা এবং কনস্যুলার পরিষেবা বন্ধ করে দিয়েছে। আমেরিকার পরে, বেশিরভাগ ভারতীয় পড়ুয়া কানাডায় পড়াশোনা করছেন। ৩১ ডিসেম্বর, ২০২২ পর্যন্ত, ভারতের বাইরে অধ্যয়নরত ছাত্রদের ৩৯.৫% কানাডায় পড়াশুনা করছেন।
এ ছাড়া বিপুল সংখ্যক ভারতীয় ছাত্রছাত্রী ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডে পড়াশোনা করতে যান। কানাডায় উচ্চ শিক্ষার সুযোগ সেই সঙ্গে ২০২৩ সালে কানাডা পোস্ট-গ্রাজুয়েশন ওয়ার্ক পারমিট এক্সটেনশন প্রোগ্রাম ঘোষণা করেছে, যার অধীনে আন্তর্জাতিক পড়ুয়ারা স্নাতক হওয়ার পর তিন বছর পর্যন্ত সেদেশে থাকতে পারবেন, কাজের সুযোগঅর্জন করতে পারবে্ন এবং কানাডায় সম্ভাব্য নিরাপদ কর্মসংস্থানের সুযোগ পেতে পারবেন। প্রতি বছর ভারত থেকে পড়াশুনার কারণে যে সকল পড়ুয়া কানাডায় যান তারা কানাডার অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। যার পরিমাণ প্রায় ১০ বিলিয়ন কানাডিয়ান ডলার।
চাকরি ক্ষেত্রেও এগিয়ে ভারতীয় পড়ুয়ারা
কানাডা বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ কিন্তু এখানে জনসংখ্যা খুবই কম। কানাডার জনসংখ্যা ৪ কোটিরও কম। কানাডা সাধারণত বিদেশি পড়ুয়াদের সব সময়ের জন্য স্বাগত জানায়। এতে কানাডার অর্থনীতি লাভবান হয়। ২০২২ সালে কানাডায় প্রায় ৩,৭০,০০০ চাকরির জন্য আন্তর্জাতিক পড়ুয়াদের নির্বাচন করা হয়েছিল। এর মধ্যে ভারতীয় ছাত্রের সংখ্যা ছিল ১,৭০,০০০।